ভীড় গিজগিজ সদরঘাটটা পার হবার সময়ও বুঝতে পারিনি কি বিষ্ময়কর, আলৌকিক আর আনন্দময় এক জল যাত্রা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আগেও বলিছিলাম ইদানিং ঢাকা শহরটা ছেড়ে যেত ইচ্ছে করেনা। এ শহরটার ওপর, এখানকার মানুষগুলোর ওপর এমনই মায়া পরে গেছে। তবু যেতে হয়ে কাজে। সেদিন ছিলো বৃহ:বার রাতে অফিসের কাজ গুছিয়ে তাই সোজা সদরঘাট।
সদরঘাট পৌছে আগে থেকে বুক করা সুন্দরবন-৮ লঞ্চের একটি সিংগেল কেবিন উঠি। রাত নটার দিকে লঞ্চ ছাড়ে ব্যস্ত ঢাকা, জল কেটে এগুতে থাকে সে প্রমত্তা পদ্মা-মেঘনার দিকে। কেবিনের লাইটটা অফ করে চোখ বন্ধ করি, রাত জাগার প্রস্তুতি নিতে। আকাশে থাকবে দ্বাদশীর চাদ। উথাল পাথাল নদীর মাঝে এমন চাদের রাতে ঘুমোনো বড় ধরনের পাপ। তাই একটা চা খেয়ে নেই শরীরটাকে চাংগা করি।
রাত সাড়ে ১০ টার দিকে লঞ্চ মুন্সীগঞ্জ পার হয়ে পরে মেঘনা নদীতে। মোল্লা সল্টের ঝকঝকে নিয়ন সাইন যখন অস্পষ্ট হয়ে আসে ঠিক তখনি ছাদে উঠে যাই আমি। চার তলার ছাদের উপরে তখন ঝুম নিরবতা। কার দায় পরেছে যে নিশুতি এ রাতে লঞ্চের ছাদে উঠবে সাধের ঘুম রেখে? মাঝে একবার এক হুজুর উঠলেন। নামাজ শেষে বললেন-ভাই, লাফ টাফ দিয়েন না নদীতে। সম্ভবত আমার আচড়নে তার সন্দেহ হয়েছে। আমি হেসে বলি -কি যে বলেন হুজুর, এরকম চাদের আলো, আমার এ আনন্দময় জীবন ছেড়ে আমি কোন দু:খে বেছে নেবো মৃত্যুর মতো অনিশ্চিত বস্তকে? তিনি কথা বাড়ান না, নেমে যান নীচে।
এরপর নিরবতা সংগী করে লঞ্চের নেভিগেশন লাইটটাতে হেলান দিয়ে বসি পা ছড়িয়ে। হুহু বাতাসে গা শীতল হয়ে আসে নিমিষে। এবার অবসর হলো আকাশটার দিকে তাকাবার। আহা এইতো সেই বিশাল চাদ যার জন্য এতো ওদেখলেপনা আমার। আমি চেয়ে রই চাদের পানে, দেখি বুড়ির চড়কা কাটার দৃশ্য। জীবনে কত জায়গায় যে চাদনি রাত কাটিয়েছি তার ঠিক নেই কিন্ত জলের ওপর বসে চাদে দেখার যেন কোন তুলনা হয়না। আম তাই প্রাণ ভরে দেখি আমার চাদকে। দেখি চাদের আলোয় আলোকিত হওয়া জল, মেঘনার ছলকে ওঠা রুপালী জল। দুরে অষ্পষ্ট হয়ে দেখা যায় কোন এক অচেনা বন্দরের আলো। আমি সে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি, ভাবি একদিন ঠিক চলে যাবো অচেনা সে বন্দরে। কেউ আটকাতে পারবেনা আমায়।
চাদপুর মোহনাটা পার হয়ে লঞ্চ চলে আসে পদ্মায়। একটা সময় আসে যখন চারদিকে জল আর ওপরে বিশাল চাদ ছাড়া কিছুই দেখা যায়না। শুধু মাঝে মাঝে ইলিশ ধরার নৌকাগুলো পাশ দিয়ে হুশ করে চলে যায়। আমি পাগল হয়ে যাই। চাদনী রাত, পাপীর মন। আমি ডুবে যাই ফ্যান্টাসীতে, আমি নানা কিছু ভাবি। আমার ফেলে আসা সুন্দর সময়গুলোকে 'রিক্যাপ' করি। আমার অনাগত দিনগুলোর জন্য পরিকল্পনা করি। আর তাকিয়ে থাকি জলের দিকে, বহমান জল। কি স্বতস্ফূর্ত আর সাবলীল। কি সুন্দর বয়ে যায় সে আমার দুপাশ দিয়ে।
রাত ৩ টার দিকে পদ্মা পার হয়ে লঞ্চ ঢোকে মেহেন্দীগন্জ এর কাছে কীত্তনখোলার শাখা নদীতে। এবার দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ছোট সরু নদী, পাশে বিস্তির্ন ধান/পাট ক্ষেত। দুর থেকে সে নদীকে মনে হয় চুলের ফিতের মতো, যেনো চুলের বিনুনি কেটে সে বয়ে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে। আমি দেখি বিশাল ক্যানভাসে প্রকৃতির সযতনে আকা জলরং এ আকা ছবি। আহা! কোন শিল্পী একেছে সে ছবি? কে সে জন? আমি দেখি আর আবগে কেপে কেপে উঠি। লঞ্চ একেবেকে চলে সামনের দিকে। পাইলট জল মাপার বাশটা হাতে নিয়ে একটু পর পর হাক দেয়- চল্লিশ! মানে এখানে চল্লিশ হাত পানি আছে। মাষ্টার সে অনুযায়ী লঞ্চ চালান। চরমোনাই পীর সাহেবের ঘাট যখন পার হই, তখনই আজান হয় ফজরের। আমি তন্ময় হয়ে শুনি- আস সালাতু খায়রুম মিনান নাউ........ম। এর মিনিট বিশেক পরই লঞ্চ এসে ভীড়ে বরিশাল টার্মিনালে।
আমি আমার জীবনের অন্যতম একটি স্বরনীয় জল ভ্রমণ শেষ করে নেমে পরি গন্তব্যের উদ্দ্যেশে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




