somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অণুবীক্ষু

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সদানন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামফলকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মতিন। সদানন্দ’র ‘ন’-টা কোনভাবে মুছে গিয়েছে। এখন সেখানে দেখাচ্ছে “সদা ন্দ” প্রাথমিক বিদ্যালয়। হাঁসিতে ফেটে পড়ল মতিন। সদান্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়, সদন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয় - চিৎকার করতে করতে স্কুলের মাঠের দিকে ছুটে গেল সে।
ছেলেরা মাঠে খেলছে। মাঠের এক কোণায় নেকু আর বসুকে খুঁজে পেল মতিন। মার্বেল খেঁলছে ওরা। নেকু আর বসু মতিনের খুব ভাল বন্ধু। তবে নেয়ামত আলী থেকে একজনের নাম কিভাবে নেকু হয়ে গেল তা ভেবে পায় না মতিন। সেটাও না হয় মেনে নেয়া গেল, কিন্তু বশির মৃধা কিভাবে বসু হয়ে গেল সেটা ভাবতে গেলে মাথায় গিট্টু লেগে যায় মতিনের।
‘মইত্যা, এত দেরি করলি কেন?’ বসু জিজ্ঞেস করল।
‘আর কইস না, মা-র ভাত রানতে দেরি হইল। তোর হাতে এত্ত মার্বেল কেন রে বসু? নেকুরে আজকেও হারাইছস?’
‘হ। আয় তোরেও হারামু।’
‘ইশ, আমারে হারাইব! কোনদিন হারাইছস আমারে?’
স্কুলের ঘন্টা বাজার আগ পর্যন্ত মার্বেল খেলল তারা। ঘন্টা দিতেই সবাই মাঠ ছেড়ে দৌড়ে ক্লাসে চলে গেল। ঘন্টা দেয়ার পরেও দেরি করে ক্লাসে ঢুকলে আগে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি ছিল। তখন অবশ্য এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। মতিনের কাছে অবশ্য বসে থাকার চেয়ে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেই বেশি ভাল লাগত। কিন্তু নিয়ম এখন বদলেছে। দেরি করে ঢুকলে ঠাস ঠাস দুটো বেতের বাড়ি খেতে হয়। তাই পারতপক্ষে কেউ এখন দেরি করে ক্লাসে আসে না।
ক্লাসে ঢুকে একেবারে পেছনের বেঞ্চে বসে আশেপাশে তাকাল মতিন। পাঁচদিকে টিন দিয়ে ঘেরা একটা ক্লাসরুমে দশটা বেঞ্চের উপর তারা পঁচিশ-ত্রিশ জন ছেলেমেয়ে বসে আছে। ছেলেদের প্রায় সবাই তার মত জামা-কাপড় পরে আছে; নীল শার্ট আর যেমন খুশি প্যান্ট। মতিন তার হাফপ্যান্টের দিকে তাকাল। এই একটিমাত্র কালো হাফপ্যান্টই তার আছে। তবে এতে তার কোন সমস্যা হয় না। তিন-চারদিন পরপর যখন প্যান্ট ধুয়ে দেয় তখন বেশি প্রয়োজন হলে গামছা পরে, নয়তো কিছু না পরেই তার চলে যায়। এসব কথা মনে পড়তেই মতিনের খেয়াল হল আজকে ক্লাস শেষ করে নদীতে যেতে হবে গোসল করতে। তবে অন্যান্য ছেলেদের সাথে তার প্রধান পার্থক্য হল তার পায়ে কোন স্যান্ডেল নেই। পুরো ক্লাসে সর্বোচ্চ হয়তো দুজন খুঁজে পাওয়া যাবে যাদের স্যান্ডেল নাই, মতিন তার মধ্যে একজন।
প্রথমে বাংলা ক্লাস। কমলকান্ত স্যার নাম ডাকা শেষ করতে না করতেই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং হেডমাস্টার সদানন্দ বাবু ক্লাসে ঢুকলেন। সবাই লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সদানন্দ বাবু যথেষ্ট বয়ষ্ক, বয়স সত্তরের কোঠায় হলেও যথেষ্ট শক্ত লোক। তার হাতে জোড়া বেতের মার যে খেয়েছে সে-ই শুধুমাত্র বুঝতে পারবে এ বয়সে তার গায়ে কত জোর। সদানন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা তিনি নিজে। আজ থেকে প্রায় পয়ত্রিশ বছর আগে নিজ বাড়ির উঠানেই দক্ষিণমুখো স্কুলঘরটি তুলেছিলেন। গ্রামের মোড়ল মাতব্বরদের সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস থাকলেও সবই যে শুধুমাত্র ফাঁকা বুলি, তা বুঝতে বেশিদিন সময় লাগেনি সদানন্দ বাবুর। শুধুমাত্র তার নিজের প্রচেষ্টায় আজ পর্যন্ত টিকে আছে স্কুলটি। অবশ্য শুধু টিকে আছে বললে ভুল হবে, অজপাড়াগায়ের স্কুল হিসেবে অবস্থা যথেষ্ট ভাল। গতবছর ক্লাস ফাইভে একজন বৃত্তি পেয়েছে। এবারও পাবে বলে সবার ধারণা।
‘বস বস, আর দাঁড়ায়া কি করবি? তোদের আদব কায়দার কি কিছু আর বাকী আছে?’ হাত নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বললেন সদানন্দ বাবু।
সব ছেলেমেয়েদের মত কমলকান্ত স্যার-ও চুপ করে রইলেন।
সদানন্দ বাবু বলে যেতে লাগলেন, ‘স্কুলের নামফলকে একটা “ন” কে মুছে ফেলেছে?’
নিরবতা অব্যাহত থাকল।
‘কথা বলিস না কেন রে ফাজিলের দল? আমি জানি তোদের মধ্যে কেউ একজন এ কাজ করেছে। তোদের মত পৌংটা পোলাপান আমি আজ পর্যন্ত অন্য কোন ক্লাসে দেখি নাই।’
সদানন্দ বাবু এসব কথা আর বাড়াতে চাইলেন না। তিনি জানেন এদের জ্ঞান দিয়ে তেমন লাভ হবে না। গত পয়ত্রিশ বছরে তার অর্জিত অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা হল, “গাধাকে আর যা কিছুই করা যাক, মানুষ করা যায় না।”
ওদিকে ক্লাসের পেছনে বসে মতিন হাঁসি আর থামাতে পারছে না। মাথা নিচে নামিয়ে সমানে হেঁসে যাচ্ছে সে। সে জানে গতকাল সে যে কাজটা করেছে তা কোন কাকপক্ষীও জানে না। ‘সদান্দ স্কুলের সদান্দ স্যার,’ নিজের মনেই আওড়াতে লাগল মতিন।
‘এখন কাজের কথায় আসি,’ হেডমাস্টার সাহেব বলতে লাগলেন। আমার স্কুলের এক ছাত্র এবছর ডাক্তারি পাশ করেছে। নাম আশিকুর রহমান।’ একথা বলার সাথেসাথে হেডমাস্টার সাহেবের বুকের ছাতি যে ফুলে গেল তা ক্লাসের সবাই টের পেল।
‘তো, আশিকুর রহমান আজ সকালে স্কুলে আসছিল। আমার পা ছুঁয়ে সালাম করল। কি ভদ্র ছেলে রে বাবা! সে স্কুলকে একট অণুবীক্ষণ যন্ত্র উপহার দিয়েছে।’
‘কি যন্ত্র স্যার?’ দশ-বারোজন ছেলেমেয়ে একসাথে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল।
‘অণুবীক্ষণ যন্ত্র। ঐটা দিয়ে ছোট একটা জিনিস অনেক বড় দেখা যায়। ধর তোর মাথার উঁকুন ওইটার মধ্যে রাখলে তুই হাতির সমান বড় দেখতে পাবি, বুঝছিস?’
সবার মধ্যে অবিশ্বাসের ছায়া দেখা গেল।
‘কি? বিশ্বাস হচ্ছে না?’ হেডমাস্টার সাহেব একটু খুশিই হলেন। ‘তেদের বিজ্ঞান স্যারকে বলে দিয়েছি আজকে তোদের ক্লাসে নিয়ে আসবে। সে দেখিয়ে দিবে কিভাবে ওটা ব্যাবহার করতে হবে। সাবধানে দেখবি তোরা, ঐটা কিন্তু বড় বড় বিজ্ঞানীরা ব্যাবহার করে। কেউ খোঁচাখুঁচি করবি না, ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে স্যার,’ সবাই চিৎকার করে বলল।
‘আচ্ছা আমি তাহলে গেলাম, কেউ দুষ্টামি করবি না কিন্তু,’ বলে সদানন্দ বাবু ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
‘কাম নাই কোন! উঁকুণ দেখাইব হাতির মতন! হাতি দেখতে চাইলে জ্যাতা হাতি দেখি, উঁকুণ দিয়া হাতি বানানোর কি দরকার?’ মতিন ফিসফিস করে নেকুকে বলল।
বাংলার পরে ইংরেজী, তারপরে বিজ্ঞান। বাংলা আর ইংরেজী ক্লাস করতেই সবাই যেন হাঁপিয়ে উঠল। কখন বাইরে গিয়ে লাটিম ঘুরাবে অথবা মার্বেল খেলবে সে চিন্তা সবার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিজ্ঞান স্যার সাইফুল্লাহ্ বক্স স্যার তুলনামূলক কমবয়স্ক একজন শিক্ষক। ছাত্ররা সবাই তাকে বাক্স স্যার বলে ডাকে। অবশ্যই নিজেদের মধ্যে।
বক্স স্যার ক্লাসে ঢুকতেই ক্লাসের সবাই তার হাতের ঐ অদ্ভুতদর্শন বস্তুটার দিকে তাকিয়ে রইল। বক্স স্যার চেয়ারে বসে হাতের বস্তুটা টেবিলে রাখলেন। ছেলেমেয়েরা ঘাড় যতটা সম্ভব উঁচু করে দেখার চেষ্টা করতে থাকল।
‘আজ আমাদের কোন পড়া নাই। আমরা এই অণুবিক্ষণ যন্ত্রটা চিনব আজকে,’ বক্স স্যার বললেন।
সবার মধ্যে প্রবাহিত আনন্দের শীহরণটা তীক্ষè চিৎকারে রূপ নিল। যাদের সামনে বই-খাতা খোলা ছিল তারা সেসব বন্ধ করে দিল।
‘ওই মতিন, যা একটা পেয়ারা পাতা নিয়ে আয়,’ মতিনকে শেষ বেঞ্চে ঘুমুতে দেখে বক্স স্যার তাকে ডেকে বললেন।
বাক্স স্যারের ডাক শুনে ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল মতিন। ‘কি স্যার? কই যামু?’
‘ক্লাসে ঘুমালে কথা শুনবি কিভাবে? যা একটা পেয়ারা পাতা নিয়ে আয়। কচি দেখে আনবি।’
‘ও, এক্ষনি আনতেছি স্যার।’
মতিন স্যারদের রুমের সাথে লাগোয়া পেয়ারা গাছ থেকে কাঁচা-ও না, পাকা-ও না টাইপ একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে এল। বক্স স্যার বুকপকেট থেকে একটা ব্লেড আর কাঁচের কি যেন একটা বের করলেন। পাতাটার একটা খুব ছোট অংশ খুব পাতলা করে কাটলেন। সেই পাতলা করে কাটা অংশটা এক ফোঁটা পানি দিয়ে কাঁচের সাথে লাগিয়ে তার উপর পাতলা একটা প্লাস্টিক বসিয়ে দিলেন।
‘এই যে কাঁচের টুকরার উপরে আমি পাতাটা রাখলাম, এই কাঁচকে বলে স্লাইড, কি?’
সবাই চিৎকার করে বলল, ‘সেলাইড।’
বক্স স্যার বলে চললেন, ‘অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে ছোট জিনিসকে বড় দেখা যায়। আমরা এখন পেয়ারা পাতার মধ্যে কি আছে তা দেখার চেষ্টা করব, ঠিক আছে?’ এ কথা বলে তিনি টেবিলটা টেনে হিঁচড়ে জানালার পাশে নিয়ে গেলেন। সেখানে বসা ছেলেমেয়েরা খুশি হলেও বিপরীত পাশের সবার মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাথে একটা চোখ লাগিয়ে কি যেন ঘোরাতে লাগলেন বক্স স্যার। কেউ কিছু না বুঝলেও হাঁ করে তার অদ্ভূত কর্মকান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকল। মতিন বিরক্ত হয়ে লক্ষ্য করল সে নিজেও হাঁ করে তাকিয়ে আছে বস্তুটার দিকে।
‘কাজ শেষ,’ চোখ উপরে তুলে বললেন বক্স স্যার। এখন তোরা একজন একজন করে আয়, দেখে যা। সামনে থেকে সবাই একে একে যেতে থাকল।
মতিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কাম নাই!’
বক্স স্যার সবাইকে বলে দিতে থাকলেন কিভাবে দেখতে হবে। কাউকে বলছেন, এখানে চোখ রাখ, কাউকে বলছেন, এখানে হাত দিবি না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কেউই চোখ রেখে কিছু দেখতে পাচ্ছে, বা পেলেও কিছু বুঝতে পারছে বলে মনে হল না। বড় বড় বৈজ্ঞানিকদের কাজ, আমরা বুঝুম ক্যামতে? সবাই ভাবছে মনে মনে।
অনিচ্ছা সত্বেও যখন মতিন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রাখল, সে-ও তেমন কিছু বুঝতে পারল না। লম্বা লম্বা কিছু আঁকিবুঁকি আর গোলগোল কিছু বুদবুদের মত কিছু বস্তু দেখে না বোঝাটাই স্বাভাবিক। মতিন জানে না, কেন যেন এই অদ্ভূত আঁকিবুঁকি তার খুব পছন্দ হল। তার কাছে অবাক ঠেকল, একটা গাছের পাতার মধ্যে এতকিছু থাকে কিভাবে? এতো তার জানা জগতের বাইরে আরেকটা নতুন জগত। হঠাৎ করেই আবিষ্কার করা এ নতুন জগতের রাজার আসনে নিজেকে বসিয়ে দিল মতিন। এট্টুক একটা পাতার মধ্যে কত্তকিছু, পুরা একটা দুনিয়া, নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে সে।
‘মইত্যা, সর, আমি দেখুম,’ পেছন থেকে নেকু বলল।
‘একটু দাঁড়া, আরেকটু দেখি,’ চোখ না সরিয়েই বলল মতিন।
‘অনেক দেখছস, সর এখন!’ মতিনকে আস্তে করে ধাক্কা দিল নেকু।
‘আমি কইছি না একটু দেইখা চইলা জামু? ধাক্কা দিলি ক্যান?’ বলে মতিন নেকুর চাপায় জোরে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল। নেকু এরকম আচরনের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। উল্টে মেঝেতে পরে গেল সে।
আবার আপনমনে দেখতে লাগল মতিন। তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এখন। নেকুর উপরে, তার মায়ের উপরে, সবার উপরে। এই নতুন জগতটা কেন তাকে কেউ আগে দেখায় নি? এ চমৎকার জগত থেকে কেন তাকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে সবাই? আর এখন একটু দেখতে চাইলেও নেকু এসে তার সাথে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিল! সে যখন আবার মনযোগ দিয়ে অদ্ভূত আঁকিবুঁকিগুলো দেখতে শুরু করেছে ঠিক তখনই বক্স স্যারের চিৎকার তার কানে গেল।
‘এই মতিন, নেকুকে মারলি কেন তুই?’
‘স্যার ও তো আগে আমারে ধাক্কা দিছে!’
‘আমি দেখিনাই কি হইছে?’ বলে বেত হাতে নিয়ে ঠাস করে মতিনের পিঠে একটা ঘা বসিয়ে দিলেন তিনি। ‘যা ভাগ, তোর আর দেখা লাগবে না, পাজি কোথাকার!’
অন্য কেউ হলে হয়তো মুখ গোমড়া করে এক কোণায় গিয়ে বসে থাকত। মতিন যদিও পেছনে কোণায় গিয়ে বসল, তার মন খারাপ না। এরকম মার সে সবসময়ই খায়। মাঝেমধ্যে নিজেই গর্ব করে বলে, একটু আকটু মাইর না খাইলে ভাত হজম হয় না। কোণায় বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবতে লাগল মতিন, এট্টুক একটা পাতা, তার মধ্যে এতকিছু! ক্যামতে?
দুপুর দুটায় আধাঘন্টার টিফিন পিরিয়ড। তার অন্য অনেক বন্ধুর মত টিফিন পিরিয়ডে কিছু খায় না সে। মার্বেল খেলে আর দৌড়াদৌড়ি করে সময় চলে যায়। কিন্তু আজ মার্বেল খেলায় কোন একটা ঝামেলা হয়েছে। ঠিকমত খেলতে পারছে না মতিন। তারচেয়ে অনেক খারাপ খেলোয়ার বসুর কাছেও ছয়টা মার্বেল হারার পরে আর খেলার কোন মানে হয় না। তাই খেলায় ইস্তফা দিয়ে মাঠের এক কোণায় এসে বসল মতিন। একটা ঝরে পড়া পাতা হাতে নিয়ে আনমনে শুধু একটা কথাই ভাবতে লাগল সে, এই পাতার মধ্যে এতকিছু! অর্ধেক সবুজ আর অর্ধেক লালচে পাতাটার উপরে আপনমনেই হাত বোলাতে লাগল সে।


২.
সাইফুল্লাহ্ বক্স স্যার হাঁসের মাংশ দিয়ে আটার রুটি খাচ্ছেন। আজ তার মনটা খুব ভাল। নসিমপুরে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে তার একটা শালা এসেছে একজোড়া বিশাল আকারের হাঁস নিয়ে। তার শ্বশুরবাড়িতে আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, হাঁস আছে কয়েক শ’। আর বাড়ির লোকজন হাঁসের সাথে থেকে থেকে কেমন যেন হাসের মত হয়ে গিয়েছে। তাদের কথা শুনলে সাইফুল্লাহ্ বক্স স্যারের মনে হয় মদ্দা হাঁস যেন প্যাঁক-প্যাঁক করছে। হাঁসের রানের একটুকরা চর্বিওয়ালা মাংশ মুখে দিতেই দরজায় শব্দ শুনলেন তিনি।
‘কেরে, মতিন? ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’ মুখে খাবার নিয়েই জিজ্ঞেস করলেন বক্স স্যার।
‘স্যার, একটা কথা কইতাম,’ মতিন মৃদুস্বরে বলল।
‘আয়, ভেতরে আয়। কি কথা? কারো সাথে মারামারি কইরা বিচার নিয়া আসছিস নাকি?’
‘না স্যার,’ বলে মতিন বক্স স্যারের টেবিলের সামনে বসল। মতিন মাথা ঘুরিয়ে স্যারদের রুমে বসে থাকা বাকী স্যার-আপাদের দেখল। সবাই তার দিকে বিরক্ত নিয়ে একবার তাকিয়েই আবার খাওয়ায় মন দিচ্ছে।
‘তোর হাতে এসব কি পাতা-ছাতা, ফালা এগুলো! বক্স স্যার কপাল কুঁচকে বলল।
‘না স্যার, আজকে ওই যে একটা যন্ত্র দেখাইলেন না অণুবীক্ষু যন্ত্র,ওইটায় আমি আবার একটু দেখুম এই পাতা গুলা কেমন দেখায়।
বক্স স্যার হো হো করে হেঁসে উঠলে মতিন অবাক হয়ে আগ্রহী মুখ নিয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
‘ওইটা তো অণুবীক্ষু না,অণুবীক্ষণ যন্ত্র। আর তুই পড়াশোনায় এত মনযোগী কেমনে হলি, সারাদিন তো মাবেল নিয়াই দৌড় পারস।
মতিন বুঝতে পারল না এখানে পড়াশোনায় মনযোগী হওয়ার কি আছে। এটা তো তার কাছে মার্বেল খেলার মতই, বরং আরও বেশি মজার লাগছে। সে হা করে তাকিয়ে রইল কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে।
বক্স স্যার খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে বক্স থেকে একটা পান বের করে মুখে দিতে দিতে বললেন, এদিকে আয় । তিনি মতিনকে নিয়ে আর অণুবীক্ষণ যন্ত্রটা নিয়ে জানালার পাশের একটা টেবিলে বসলেন। পরবর্তি দশ মিনিটে স্যার তাকে আবার শেখালেন কিভাবে লাইট, রেজল্যুশন ঠিক করতে হয়। মতিনকে একটা বড়ই পাতা দেখতে সাহায্য করলেন।
সেই থেকেই শুরু। মতিন প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডে হাজির হয় স্যারদের রুমে। তার হাত পকেট থাকে নানা আজগুবি জিনিসে পরিপূর্ণ। আর সাইফুল্লাহ বক্স স্যারও মহা আনন্দে এটাওটা মতিন কে দেখান। ভুল বললাম, আসলে তিনিই মহা আনন্দে ওসব দেখেন অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে। আর এ নিয়ে অন্যান্য শিক্ষকেরা প্রথম দিকে শুধুমাত্র আড়চোখে তাকালেও আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়। একদিন তো আব্দুর রহিম স্যার তাকে বলেই বসলেন, ‘এসব কি করেন স্যার? বিচ্ছু পোলাপান, লাই দিয়া মাথায় উঠাইতেছেন! এত দামি একটা যন্ত্র, কোনদিন দেখবেন ভাইঙ্গা গুড়াগুড়া কইরা ফেলছে।’
জবাবে বক্স স্যার বললেন, ‘ছাত্র মানুষ, আগ্রহ করছে একটু দেখাই। গ্রামের স্কুল, ছাত্রদের তো তেমন কিছু দিবার পারি না। ছেলেটার যেহেতু সখ, দেখুক।’
আব্দুর রহিম স্যার সন্তুষ্ট হলেন, না অসন্তুষ্ট হলেন বোঝা গেল না। চোখমুখ কুঁচকে চা-য়ে টোস্ট বিস্কিট ডোবালেন।


৩.
‘মা, তোমার নাম শাপলা ক্যান?’ সকালবেলা খেতে বসে মতিন তার মা-কে জিজ্ঞেস করল। এই পৌষ মাসের শীতের শকালে পোড়া মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেতে গিয়ে মতিনের আঙুল ঠান্ডায় জমে গিয়েছে, কিন্তু তার কোন অনুভূতি নেই। অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। মতিন একটা পোড়া মরিচ তুলে নিয়ে একটা কামড় বসিয়ে দিল। তার মা-কে চুপ করে থাকতে দেখে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে সে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘বল না মা, তোমার নাম শাপলা ক্যান?’
শাপলা বেগম তার একমাত্র ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এ ধরনের “রঙ্গের কথা” তার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে অনেকদিন আগেই। কিন্তু তার এই পাগল ছেলেটার এরকম উদ্ভট কথাবার্তা শুনলেই তার মনে হয় - দুনিয়াতে বেঁচে থাকার মধ্যে একটু হলেও সুখ আছে। ছেলের পাতে আরও কিছু পান্তা-ভাত তুলে দিয়ে তিনি বললেন, ‘ছোট কালে আমার নাম আছিল আমেনা।’
মতিন মুখে ভাত নিয়েই তার মা-কে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘হাঁচা? তাইলে ওইটা শাপলা হইল ক্যামনে?’
শাপলা বেগম একটু বিরক্ত হলেও বলতে লাগলেন, ‘আমার শাপলা ফুল খুব পছন্দ আছিল। তোর নানার বাসায় তো দেখছিস, কত্ত শাপলা ফুল ফোঁটে পুকুরে! আমি সারা দিন পুকুর পাড়ে বইসা থাকতাম আর শাপলা দেখতাম। আর সুযোগ পাইলেই পুকুরে নাইমা ফুল তুইলা আইনা খেলতাম, মালা বানাইতাম। এ নিয়া মা-র হাতে কত মাইর খাইছি!’ বলতে বলতে আনমনা হয়ে যান শাপলা বেগম।
‘মা, নানু মারলে তুমি ব্যাথা পাইতা?’
‘হ, ব্যাথা তো পাইতাম-ই।’
‘তাইলে আমারে যে মারো, আমি ব্যাথা পাই না?’ মুখ টিপে বলল মতিন।
‘মাইর খাওনের কাম করস দেইখাই তো মারি। ব্যথা পাওনের কাম করবি না, তাইলেই তো মাইর খাবি না।’
‘আচ্ছা হইছে, তারপর কি হইছে সেইটা কও।’
‘বাজান, মানে তোর নানা আমারে শাপলা কইয়া ডাকত। আমি সবসময় শাপলার মালা গলায় পইরা থাকতাম তো! পরে মা তো মইরা গেল, আমেনা বইলা ডাকার কেউ আর থাকল না। তারপর থেকেই আমার নাম পুরোপুরি শাপলা হইয়া গেল।’ বলতে বলতে শাপলা বেগমের গলা ধরে আসে।
মতিনের মাথায় একটা মজার প্রশ্ন খেলে গেল। ‘মা, শাপলা ফুলের পাপড়ির মধ্যে কি থাকে জানো?’
ছেলের অদ্ভূত কথায় এখন আর বিরক্ত হয় না শাপলা বেগম। বরং একটু একটু ভালই লাগে। আসলে এসবের জন্যই তো বেঁচে আছেন তিনি। তবুও মুখে কৃত্তিম ভাব নিয়ে বললেন, ‘কি কস এইসব হাবিজাবি? শাপলা ফুলের পাপড়ির মধ্যে আবার কি থাকব? উল্টাপাল্টা কথা না কইয়া ভাত খা।’
‘না মা, উল্টাপাল্টা কথা না। আমাদের স্কুলে একটা যন্তর আনছে, অণুবীক্ষু যন্তর নাম। ওইটার মধ্যে দিয়া সবকিছু বড় বড় দেখা যায়। পাতার মইধ্যে কি আছে, ফুলের মইধ্যে কি আছে সবকিছু। পিপড়ার থেইকাও ছোটছোট জিনিস ওইটার মধ্যে দিয়া বিশাল বড় দেখা যায়। বড়ই পাতা, আম পাতা, কাঠাল পাতার মধ্যে কি থাকে জানো? আমি দেখছি। কত্ত কিছু! লম্বালম্বা, গোলগোল কি কি যে থাকে ছোট্ট একটা পাতার মধ্যে! না দেখলে তুমি চিন্তাই করতে পারবা না মা।’
মতিনের কথা শুনে শাপলা বেগম কিছুই বুঝতে না পারলেও তার মনটা ভাল হয়ে গেল। ছেলেটা নিশ্চয়ই পড়াশোনায় মন দিচ্ছে। ছেলেটাকে নিয়ে তার কত্ত ইচ্ছা ছিল! কিন্তু একেবারেই পড়াশোনা করে না মতিন। কত বকাঝকা, মারধোর! কোন লাভ হয় নি। মার্বেল থেকে কোনভাবেই আলাদা করা যায় নি মতিনকে। আর এখন কি যন্ত্রের কথা বলছে অণুবীক্ষু না কি, যা-ই হোক, শুনে মনটা ভাল হয়ে গেল শাপলা বেগমের।
‘মা, কি ভাবতাছো? শোনো, আমি আইজকা গিয়াই দেখমু শাপলার মধ্যে কি আছে। খাড়াও, একটা শাপলা তুইলা আনি।’ বলে মতিন খাওয়া শেষ না করেই ছুটল তাদের পাশের বাড়ির পুকুরের দিকে। যেখানে এই পৌষ মাসেও ফুঁটে আছে অনেক অনেক শাপলা। তার মায়ের শত চিৎকার চেচামেচির দিকে মোটেও কর্ণপাত না করে সে তার পরনের সার্ট আর হাফপ্যান্ট খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুকুরের ঠান্ডা পানিতে। ডুব সাঁতারে কয়েক সেকেন্ডেই বিশাল পুকুরের মাঝখানে গিয়ে ছিড়ে নিয়ে এল একটা ধবধবে সাদা শাপলা।
শাপলা বেগম পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে আজকে আর রাগ করতে পারলেন না। হঠাৎ করেই তার মনে হল সে চলে গিয়েছেন তার শৈশবে। বাবা-মায়ের বাধা অমান্য করে শাপলা নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছেন। আসলে কতই বা বয়স হয়েছে তার? শহরে মেয়েরা এবয়সেও পড়াশোনা করে অনেকে! সে-ও তো চেয়েছিল কারো ঘাড়ের উপর চড়ে বসে না থাকতে! জীবনটাকে নিজের মত করে সাজাতে! শাপলা বেগম সচেতন ভাবেই এসব ভাবনায় ইস্তফা দিলেন। কেন যে কষ্টের কথাগুলো না চাইলেও লাফ দিয়ে তার মনে চলে আসে?
‘মা, আমি বিকালে আইসাই তোমারে কইতাছি এইটার মইধ্যে কি আছে।’ মায়ের বিস্ময়মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকটু মজা করে মতিন বলল, ‘আমি একটা বৈজ্ঞানিক মা, বৈজ্ঞানিক।’ ভেজা শরীরে জামা-কাপড় পরে শাপলাটা গলায় ঝুঁলিয়ে মতিনকে দৌড়ে চলে যেতে দেখে বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল শাপলা বেগমের। ছেলেটার এসব কথা শোনার জন্য আরও অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছা হয় তার।


৪.
টিফিন পিরিয়ডে মতিন গলায় শাপলা ঝুঁলিয়ে দশম দিনের মত দাঁড়াল স্যারদের রুমের সামনে। অন্যান্য দিনের মতই সাইফুল্লাহ্ বক্স স্যার হাতের ইশারায় ভেতরে যেতে বলল তাকে। আর অন্যরা আড়চোখে তাকিয় ভ্র“ কূঁচকালো।
আগের মতই সবকিছু রেডি করে আইপিসে চোখ রাখল মতিন। এখন ধীরে ধীরে দাগগুলো বুঝতে পারে মতিন। লম্বালম্বা, গোলগোল দাগগুলোর একটা নিজস্ব মানে তৈরি করে নিয়েছে মতিন নিজের মনেই।
স্যারদের রুম থেকে সবাই বের হয়ে গেলে সাইফুল্লাহ বক্স স্যার মতিনকে ডাকলেন বের হবার জন্য।
‘আসতেছি স্যার, আর এক মিনিট,’ চোখ না সরিয়েই বলল মতিন।
বক্স স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চক-ডাস্টার হাতে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। ছেলেটার উপর আস্থা হয়ে গিয়েছে তার। প্রতিদিন সবকিছু ঠিকঠাক করে মুছে-টুছে সাফ করে রাখে ছেলেটা। পানটা মুখে দিয়ে ক্লাস ফাইভের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।
মতিন সবকিছু গুছিয়ে রাখার জন্য স্লাইডটা খুলতে যাবে, ঠিক তখনই তার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। এইটা যদি মা-রে দেখাইতে পারতাম, মা কত্ত খুশি হইত! মতিন মনে মনে বলল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভাবনা এল তার মাথায়। সে যদি অণুবীক্ষু যন্ত্রটা নিয়ে একদৌড়ে বাসায় গিয়ে আবার একদৌড়ে চলে আসতে চায় তাহলে সময় লাগবে সর্বোচ্চ দশ মিনিট। যদিও দশ মিনিট দেরি করলেও স্যার মার দিতে ছাড়বে না - এটা মতিন ভাল করেই জানে। ‘খাইলাম না হয় মাইর, কি আর হইব? কিন্তু মায় তো একটু খুশি হইব,’ ফিসফিস করে বলে মতিন চারদিকে তাকাল। না, কেউ নেই। সবাই ক্লাসে চলে গিয়েছে। চুপিচুপি মতিন অণুবিক্ষণ যন্ত্রটা সার্টের ভেতরে লুকিয়ে ধরে রেখে স্যারদের রুম থেকে বের হবার জন্য পা বাড়াল।
মতিন যেই রুম থেকে বের হল, সাথে সাথেই সে আব্দুর রহিম স্যারের মুখোমুখি পড়ে গেল। সবসময় মুখে বিরক্ত ভাব নিয়ে থাকা আব্দুর রহিম স্যার মতিনের বেঢপ হয়ে ফুলে থাকা পেটের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন।
‘স্যার, আমি একটু স্যর, ঐ...’ তোতলাতে লাগল মতিন।
‘মইত্যা, এইটা কি? বাইর কর, এখনি বাইর কর!’
মতিন আস্তে আস্তে অণুবিক্ষণ যন্ত্রটা বের করল সার্টের ভেতর থেকে।
‘মইত্যা, কি করছিস তুই? অণুবীক্ষণ যন্ত্র চুরি করছিস?! আমি আগেই জানতাম এরকম কিছু একটা হবে। রাখ, ওইটা রাইখা আমার সাথে চল!’
‘স্যার, আমি চুরি করতে এইটা নেই নাই...’
‘চুপ ফাজিল কোথাকার!’ মতিনকে থামিয়ে দিয়ে হাত থেকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রটা খপ করে হাতে নিয়ে আলমারির উপরে রেখে দিলেন। মতিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন সাইফুল্লাহ্ বক্স স্যার যেখানে ক্লাস নিচ্ছে সেখানে।
‘স্যার, দেখেন আপনার বৈজ্ঞানিক। অণুবিক্ষণ যন্ত্র চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পরেছে।’ আব্দুর রহিম স্যারের কথা শুনে দরজার দিকে তাকাল বক্স স্যার।
‘কি বলেন স্যার, কি হয়েছে?’ বক্স স্যার অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।
‘অণুবীক্ষণ যন্ত্র সার্টের ভেতরে নিয়ে পালাতে যাচ্ছিল স্যার। আমি ধরছি। আপনারে আগেই বলছিলাম লাই দিয়ে মাথায় তুইলেন না। শুনেননাই তো আমার কথা। এখন দেখেন,’ সবজান্তার মনোভাব নিয়ে একদমে বলে গেলেন আব্দুর রহিম স্যার।
‘কিরে মতিন, তুই অণুবীক্ষণ যন্ত্র চুরি করছিলি?’ চোখ কপালে তুলে বললেন বক্স স্যার।
‘না, স্যার, আমি একটু বাড়িতে নিয়া আবার নিয়া আসতাম স্যার,’ মতিন কি বলবে ভেবে পেল না।
‘দেখছেন স্যার, দেখছেন? বাসায় নিয়া আবার নিয়া আসতাম! এখনও কি আপনার বিশ্বাস হয় না? আমি বুঝি না এই পোলাডার জন্য আপনার এত মায়া কেন? চোর একটা।’ বলেই আব্দুর রহিম স্যার রুমের ডেস্ক থেকে বেতটা তুলে নিয়ে ঠাস ঠাস করে মতিনের পায়ে পিটাতে পিটাতে বলতে লাগলেন, ‘আর চুরি করবি? আর করবি চুরি?’
মতিনের সেই একই কথা, ‘আমি চুরি করি নাই স্যার, চুরি করি নাই।’
বক্স স্যার থামাল আব্দুর রহিম স্যারকে। মেরে সম্ভবত তার পোষায় নি। গজগজ করে বলতে লাগলেন, ‘আমি আবারো বলি স্যার, পোলাপানেরে এত লাই দিয়েন না।’ বলে বেতটা রেখে চলে গেলেন তিনি। তার রাগ যে আসলে কার উপরে তা ঠিকভাবে বোঝা গেল না। আব্দুর রহিম স্যার চলে গেলে বক্স স্যার মতিনকে ক্লাসে যেতে বললেন। কিছুই ঢুকছে না তার মাথায়। এই ছেলের তো চুরি করার কথা না। কিন্তু হাতেনাতে ধরা পরেছে, আবার নিজমুখে স্বীকারও করেছে। মাথা থেকে এসব ভাবনা ছুড়ে ফেলে ক্লাসের দিকে মনযোগ দিলেন বক্স স্যার।
মতিন ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ পেছনের বেঞ্চে বসে রইল। সে টের পাচ্ছে তার গাল বেয়ে পানি পড়ছে। পা দুটো ব্যাথায় টনটন করছে। কিন্তু সে জানে এই চোখের জলের উৎস তার পায়ের ব্যাথা নয়। মানুষ যে মনে ব্যথা পেতে পারে তা মতিন এতদিন জানলেও আজকে প্রথম তা অনুভব করতে পারল। এরকম খারাপ তার কখনোই লাগে নি। মতিন খুব চেষ্টা করল তার মাথাটা ঠান্ডা করতে। কিন্তু তার মনটা যেন শপথ করেছে আর ভাল হবে না। মতিন খাতা বের করে একটা শাদা পৃষ্ঠায় লিখল, ‘আব্দুর রহিম স্যার খারাপ।’ সারা পৃষ্ঠায় লিখে ভরিয়ে ফেললে তার মনটা একটু ভাল লাগল। মন ভাল হতেই তার মনে পড়ে গেল অণুবীক্ষু যন্ত্রের কথা। আজকের পরে তার এ বন্ধুটার সাথে আর দেখা হবে না। এ কথা ভাবতেই তার মনটা আরও খারাপ লাগল। সে জানে এরকম একটা যন্ত্রের অনেক দাম।
আমার ওইটা কিনাই লাগব, মনে মনে বলল মতিন। সে এটা ছাড়া অন্য কোনকিছু নিয়েই ভাবতে পারছে না।
মতিন মাথা ঠান্ডা করে ভাবার চিন্তা করল সে কি করবে। তার সামনে তিনটা পথ খোলা আছে। প্রথমত, সে এরকম মন খারাপ করে বসে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, অণুবীক্ষুর কথা ভুলে গিয়ে আগের মত মার্বেল নিয়ে বসে থাকতে পারে। না, অণুবীক্ষুর কথা সে ভুলতে পারবে না। অন্য কোনকিছুতে মনযোগ দেয়া সম্ভব না তার পক্ষে। আর আরেকটা কাজ যেটা সে করতে পারে তা হল এখন থেকেই একটা অণুবীক্ষু যন্ত্র কেনার জন্য প্রস্তুতি নেয়া। কিন্তু টাকা কোথায়? গ্রামের অন্য লোকের মত হালচাষ করে সে কখনোই ওটা কিনতে পারবে না। আর পারলেও ওটা দিয়ে বৈজ্ঞানিক হতে পারবে না। তবে সে পড়ালেখা করে যদি কখনো টাকা উপার্জন করতে পারে তাহলে সবই সম্ভব। আর বৈজ্ঞানিক হতে হলে তো পড়াশোনা করতেই হবে। ওই যন্ত্রের উপর কতকিছু লিখা থাকে ইংরেজীতে, সে পড়াশোনা না করলে ওসব তো পড়তে পারবে না। কিন্তু মতিন জানে, চাকরি-বাকরি করে অণুবীক্ষু কিনতে হয়তো অনেক দেরি হবে। কিন্তু মজা করে অণুবীক্ষু চালাতে হলে এছাড়া আর কোন উপায় নেই মতিনের।
মতিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। শাপলার পাপড়িতে পোকাটা যেভাবে হামাগুড়ি দিয়েছে, সেভাবে হামাগুড়ি দিয়ে এগুনোর চিন্তা এখন মতিনের মাথায়।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×