ছোটবেলার একটা কথা মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে। তখন ক্লাস ওয়ান বা টুতে পড়ি। যেদিন যেদিন পরীক্ষা থাকত বা কঠিন কোন ক্লাস থাকত, সেদিন স্কুল শুরুর আধঘন্টা আগেই মারাত্মক পেটব্যাথা শুরু হত। বিছানার এপাশ থেকে ওপাশ গড়াতে গড়াতে বিছানাটাকে কাপড়ের পুটলির মত করে ফেলতাম। আম্মু যদিও বুঝতে পারত, অভিনেতা হিসেবে তার ছেলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, কিন্তু বুঝে আর কি করবে? ছেলে কাটা কৈ মাছের মত তপড়াতে থাকলে মনে দয়ার উদ্রেক হবে না এরকম মা সম্ভবত একটাও পাওয়া যাবে না- তা বাস্তব হোক আর অভিনয়ই হোক।
‘থাক বাবা, তোকে আজ স্কুলে যেতে হবে না।’ আম্মু আমাকে শান্ত হওয়ার জন্য বলত।
এক কথাতেই শান্ত হয়ে গিয়ে আমার অভিনয় প্রকাশ করে দেয়ার মত বোকা ছেলে আমি না। উহ্ আহ্ জাতীয় শব্দ করতে করতে গড়াগড়ির বেগ আরও বাড়িয়ে দিতাম। আর একটু পরপর বলতে থাকতাম, ‘আজকে খুব দরকারি ক্লাস আছে, যেতেই হবে।’
আম্মু যখন ধমক দিয়ে বলত, যাওয়া লাগবে না, তখন কথা একটু বন্ধ হত কিন্তু গড়াগড়ি চলতেই থাকত। স্কুল ফাঁকি দেয়ার জন্য শরীরের সব শক্তি খরচ করতে রাজি আমি।
তখন আম্মু চলে যেত আমার জন্য এটা-ওটা বানাতে। লেবুর শরবত বানাত, নুডল্স বানিয়ে দিত। আমি গাপুশ-গুপুশ সব খেয়ে বলতাম, ‘উহু, ভাল লাগছে না। নাউমির বায়োমিল খাব।’
নাউমি আমার ছোটবোন। তখন ওর বয়স এক-দেড় বছর। দুনিয়ার মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের খাবার ছিল ওর জন্য কিনে আনা বায়োমিল। এমনও দেখা গেছে, একটা কৌটা কিনে আনার পরের দিনই তিন ভাগের দু ভাগ উধাও! তাই আমার জন্য বায়োমিল সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল। কিন্তু মারাত্মক (Severe) পেটব্যাথায় আক্রান্ত ছেলের অসুখ ভাল করার জন্য আম্মুকে বায়োমিল দিতেই হত।
দুই চামচ বায়োমিল খেয়ে আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতাম। ততক্ষেণে স্কুলে একটা পিরিয়ড শেষ নিশ্চয়ই। আমি মহা আনন্দে একাএকাই মনপোলি বা মার্বেল খেলা শুরু করে দিতাম।
আমার ঐ আনন্দ অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। ক্লাস টু-এর মাঝামাঝি সময়ে আব্বু মিডেল-ইস্ট থেকে ফিরে এল। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আব্বু তার ছেলের রোগের জন্য মহা-ঔষধ আবিষ্কার করে ফেলল। আমাদের বাসায় বড় একটা রেঞ্চ আছে। প্রায় তিন ফুট লম্বা তো হবেই। আব্বু ওটা হাতে নিয়ে কটমট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পেট ব্যাথা না? সামনে আয়। তোর পেটের নাট-বোল্ট সব টাইট দিয়ে দিই।’
আব্বুর মুখেই এমন টাইট খেয়ে আর পেট ব্যাথায় ভোগা যায় না। বিড়ালের মত খাট থেকে নেমে সুড়সুড় করে স্কুলে চলে গেলাম। আর তারপর কোনদিন স্কুল শুরুর আগে পেট ব্যাথা হয় নি।
তবে আজকের ঘটনার সাথে তখনকার ঘটনার মিল আছে – এরকম কথা আমি বিশ্বাস করতে নারাজ। আমার আসলেই জ্বর-জ্বর লাগছে। গত কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। থামার কোন নাম-গন্ধ নেই। অনেকেরই জ্বর হচ্ছে, আমার হতে ক্ষতি কি?
বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখলাম, আটটা বার। শাহরিয়ার স্যারের ক্লাস ধরতে হলে এখনই উঠতে হবে। শাহরিয়ার স্যারের ক্লাসের কথা মনে পড়তেই জ্বরটা যেন একটু বেড়ে গেল। স্যার ক্লাস নেয় একেকটা ম্যারাথন ক্লাস। শুরু করলে আর শেষ করার নাম নেই। একটার পর একটা স্লাইড পাল্টেই যান। আমি মনে মনে বললাম, স্যারের এত বড় ক্লাসে যদি জ্বরটা আরও বেড়ে যায়? শাহরিয়ার স্যারের সামনে উঠে দাঁড়িয়ে বলব, স্যার আমার জ্বর, এরকম সাহস আমার নেই। আসলে ক্লাসের কারোই নেই। তারপর আবার পিযুষ স্যারের ক্লাস। স্যার তার অর্গানিক ক্লাস শুরু করেন কার্বন-ঘটিত কোন বিষয় নিয়ে। আর শেষ করেন ইউ.এস.এ-র কোন ফার্মাসিউটিক্যাল কি মেডিসিন লাঞ্চ করবে বলে ভাবছে তা নিয়ে। মাঝখানে সাত-সমুদ্র তের-নদী পার হয়ে যান। আর আমরা ছাত্ররা সেই সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকি।
পিযুষ স্যারের ক্লাসে যদি জ্বর বাড়ে? স্যারকে যদি দাঁড়িয়ে বলি, ‘স্যার, জ্বর লাগছে,’ তাহলেই সেরেছে। ঘন্টাখানেক লেকচার শুনতে হবে জ্বরের উপরে। স্যার নিশ্চয়ই বলবেন, ‘এন্টিপাইরেটিক ড্রাগ তো পড়েছিলা, মনে আছে?’
এসব কথা মাথায় আসতেই মাথাটা যেন আরও গরম হয়ে উঠল। কপালে হাত দিলাম। নাহ্, ভালই জ্বর মনে হচ্ছে। থাক, আজকে না হয় না-ই গেলাম। আর বাইরেও তো বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে ভার্সিটিতে গেলে যদি জ্বর আরও বাড়ে, তখন কি হবে?
রুমে আম্মুর পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে মড়ার মত পড়ে রইলাম। আম্মু লাইট জ্বালাল। ‘নাঈম, ভার্সিটি যাবি না?’
আমি কোন রকমে চোখ অর্ধেক মেলতে পারলাম। ‘আম্মু, খুব জ্বর-জ্বর লাগছে। যাব না আজকে।’
‘তাই নাকি? কই দেখি।’ কপালে হাত রাখল আম্মু।
‘কই, কপাল তো বেশি গরম না।’
মেজাজটা কেমন লাগে? কোথায় কপালে হাত রেখে বলবে, আহ্ জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে! তা না, বলে কপাল তো বেশি গরম না। আরে বাবা, বেশি গরম না মানে কি? অল্প তো গরম নাকি?
‘আম্মু, জ্বর মনে হয় আসতেছে। আর সেই সাথে পেটের মধ্যেও কেমন যেন লাগছে।’ পরের কথাটা মুখ ফসকে কেন যে বের হয়ে গেল কে জানে? হয়তো ঠান্ডা কপালকে সাহায্য করতে পেট এগিয়ে এসেছে। নাকি আবার সেই প্রাইমারির স্মৃতি ফিরে এসেছে? কে জানে?
‘আচ্ছা ঠিক আছে তুই শুয়ে থাক, আমি নাস্তা বিছানায় দিয়ে যাচ্ছি।’
জ্বর হলে শুয়ে থাকতে হবে মানলাম। কিন্তু কতক্ষণ আর শুয়ে থাকা যায়? শুয়ে শুয়ে গান শুনলাম মোবাইল ফোনে অনেকগুলো। কিন্তু অসুস্থ মানুষেরও তো একটু হাটাহাটি করতে হয়। দশটা বাজলে আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। উঠে পায়চারি করতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় গেলাম। বারান্দায় একটা বেতের চেয়ার উপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়া। ওটার উপর বসে বাইরে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম।
হঠাৎ বাড়ির গেটের দিকে চোখ পড়ল। শাদা একটা ছাতা মাথায় একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। তিন তলার বারান্দা থেকে মেয়েটার শুধুমাত্র পা দেখা যাচ্ছে। তবে পা দেখেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম ওটা মহুয়া। মহুয়া আমাদের পাশের ফ্লাটে থাকে, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আমি অতি ভদ্র এবং লাজুক ছেলে, তাই মহুয়ার সাথে কখনোই তেমন কথা-বার্তা হয় না। মাঝেমধ্যে ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস করতে গিয়ে আটকে গেলে বোঝার জন্য আসত আমার কাছে, এই আরকি। তবে যতক্ষণ ওকে আমি বুঝাতাম, ওর চোখের দিকে তাকাতাম না, মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, পায়ের দিকে। বা পায়ের মাঝের আঙুলে একটা রিং পরে মহুয়া, সম্ভবত রূপার। তবে এসব কথা বলতে গিয়ে আসল কথাটাই বলা হল না, মহুয়া অসম্ভব সুন্দরী। একজন কবির সারা জীবনের কবিতার খোরাক যোগাতে পারে এরকম সুন্দরী। আমি নিজে কবি হলে ওকে নিয়ে কবিতা লিখতাম। কিন্তু আমি কবিতা লিখতে পারি না। তবুও একটা লিখেছিলাম খুব কষ্ট-টষ্ট করে। কিন্তু ওই কবিতা নামক তিতকুটে কেমিক্যাল যদি মহুয়ার হাতে পড়ে, তাহলে নিশ্চয়ই হার্ট-ফেল করবে সে।
আমি আর বসে বসে দোল খেতে পারলাম না। চুপিচুপি নিচে নেমে এলাম। উদ্দেশ্যঃ গেটের আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করা। গেটের ভেতরে গ্যারেজের মত একটা যায়গা আছে, অনেকগুলো ফুলগাছের টবে বাগানের মত দেখায়। অসুস্থ মানুষের হাঁটাহাঁটির জন্য আদর্শ যায়গা। আমি গেটের দিকে না তাকিয়ে একেকটা ফুলগাছের কাছে যাচ্ছি আর পাতায় টোকা দিচ্ছি। অন্য কিছু করার মত পাচ্ছি না। হঠাৎ আমার চশমায় কিছু একটা প্রতিফলন দেখতে পেলাম। আমি গেটের দিকে পেছন ফিরে আছি, চশমার কোণা দিয়ে স্বচ্ছ আয়নার মত দেখা যাচ্ছে কেউ একজন হেঁটে আসছে আমার দিকে। ইশ্, চশমাটা যদি আরেকটু আয়নার মত হত তাহলে সামনে তাকিয়ে পেছনটা দেখা যেত। আমি আবার ফুলগাছের দিকে মন দেবার অভিনয় করলাম।
‘নাঈম ভাইয়া, কেমন আছেন?’
আমি এমনভাবে পেছনে ফিরে তাকালাম যেন খুব অবাক হয়েছি মহুয়াকে দেখে। ‘এইতো ভাল। তুমি কেমন আছ? ক্লাসে যাচ্ছো? এই বৃষ্টির মধ্যে যাবে কিভাবে? রিকশা পাবে?’
হড়বড় করে এতগুলো কথা মুখ থেকে বের হবার পরে বুঝতে পারলাম, নার্ভাসনেস প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। মনে মনে একটা কিক করলাম নিজেকে।
‘হ্যা ভাইয়া, ক্লাসের তো বেশি সময় বাকি নেই। একটা রিকশাও পাচ্ছি না। আজকে যাওয়াটা খুবই দরকার, খুবই ইম্পরট্যান্ট। ভাইয়া একটু হেল্প করবেন? মোড়ে তো রিকশা পাওয়া যাবে, যদি একটু কষ্ট করে…’ লাজুক ভঙ্গিতে বলল মহুয়া।
আমি মনে মনে তিনটা লাফ দিলাম। ওয়াও, মেয়েটা আমার কাছে হেল্প চাইছে! তা-ও আবার কি মিষ্টি করে বলছে। সবাই তো আর সবার কাছে হেল্প চায় না। আমাকে ভাল মানুষ, উপকারী মানুষ বলে মনে হয়েছে বলেই হেল্প চাইছে।
‘ও তাই? কোন সমস্যা নেই। তুমি দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি রিকশা নিয়ে আসছি।’ সুযোগটা নিতে দেরী করতে চাইলাম না।
‘ভাইয়া, আমার ছাতাটা নিয়ে যান।’
কিন্তু ততক্ষণে আমি গেটের বাইরে। হিরোইজম দেখাতে গিয়ে ছাতাটা-ও নেয়া হল না। রাস্তায় অনেক পানি জমে গিয়েছে, গোড়ালির উপর পর্যন্ত। কিন্তু আমার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আরে, আমার না জ্বর? জ্বরের প্র্কোপে ভার্সিটি যেতে পারলাম না, কিন্তু সেই জ্বরের কথা বেমালুম ভুলে বসে আছি। যাক, এতেদিনে আমার একটা গতি হতে যাচ্ছে। বৃষ্টির বড়বড় ফোঁটাগুলোকে মনে হচ্ছে একেকটা গোলাপের পাপড়ি। আমার আমার একাকী জীবনের সমাপ্তি উৎসবে আকাশ থেকে ফেলা হচ্ছে আমার উপরে। ডিপার্টমেন্টে শুধুমাত্র আমিই বাদ ছিলাম। রিলেশনটা হয়ে গেলে একটা ট্রিট দিতে হবে ডিপার্টমেন্টে, মনে মনে ঠিক করে রাখলাম।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মোড় পর্যন্ত গেলাম। এখানে পানি আরও বেশি, প্রায় হাঁটু ছুই-ছুই। একটা রিকশাও দেখা যাচ্ছে না দৃষ্টিসীমার মধ্যে। হাইওয়ের দিকে হাঁটতে লাগলাম। রিকশা পেতেই হবে আজকে, প্রয়োজনে হংকং চলে যাব রিকশা আনতে। অবশেষে রিকশা একটা পেলাম। ততক্ষণে আমি কাকভেজা। রিকশাওয়ালা দোকানে বসে চা-য়ে ভিজিয়ে রুটি খাচ্ছে। দোকানের পাশে রিকশা দাঁড়িয়ে আছে।
‘মামা যাবেন?’
‘না মামা, বাদলার মধ্যে যামু না।’
‘যাওয়া লাগবে মামা, খুব দরকার, ইমার্জেন্সি।’ আমার নতুন জীবন শুরু করার জন্য আসলেই ইমার্জেন্সি।
‘কইলাম তো মামা, যামু না।’
আমি পকেট থেকে ভেজা চুবচুবে একশ টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে বললাম, ‘এটা বকশিশ। আসল ভাড়াও পাবেন।’
রিকশাওয়ালা গুরুত্ব বুঝতে পারল। তার চোখে সমবেদনা দেখতে পেলাম। বেচারা হয়তো ভেবেছে কেউ একজন মারাত্মক অসুস্থ। টাকাটা লুঙ্গির ভাঁজে রেখে বলল, ‘চলেন।’
রিকশা নিয়ে গেটের কাছে আসতেই মহুয়া বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ভাইয়া, থ্যাঙ্কস আ লট। কিন্তু আপনার এ কি অবস্থা? ভিজে তো শেষ হয়ে গেলেন।’
তোমার জন্য এইটুকু ভেজা তো কোন ব্যাপারই না, আরও কতকিছু করতে পারি! বলতে চাইলেও বলার সাহস হল না। শেষমেষ অনেক সাহস যুগিয়ে বললাম, ‘চল, তোমাকে কলেজে পৌছে দিয়ে আসি।’ বলার সাথেসাথেই অনুশোচনা হল। বেশি বলে ফেললাম নাকি?
আমার কথা শুনে মহুয়া যেন চমকে উঠল। তারাতারি বলল, ‘না ভাইয়া, তার দরকার নেই। এম্নিতেই অনেক করেছেন আমার জন্য। আপনি বাসায় গিয়ে চেঞ্জ করুন, পুরো ভিজে গিয়েছেন।’
রিকশা মহুয়াকে নিয়ে চলে গেল।
নাহ, ঠিকিই বলেছে। এ ভেজা অবস্থায় রিকশায় ওর পাশে বসে যাওয়া ঠিক হত না। ধুর, বোকার মত কথাটা বলে ফেলেছি। তবে আমি আর মহুয়া রিকশা করে বৃষ্টির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি-এ দৃশ্য আমার কল্পনায় বারবার আসতে লাগল। আহা! মেয়েটা কি সুন্দর করেই না বলল, থ্যঙ্ক ইউ। লাইফ ইজ রিয়েলি বিউটিফুল। কোথাও N+M লিখে রাখতে ইচ্ছা করে। ধুর! কি পিচ্চিপাচ্চিদের মত চিন্তা!
একপ্রকার নাচতে নাচতে ঘরে ঢুকলাম। আমার শরীর থেকে টুপটুপ করে পানি পরে সবকিছু ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু তাতো কার কি? আমি আছি মহা আনন্দে।
‘কিরে, তোর এ কি অবস্থা! তোর না জ্বর? বৃষ্টিতে ভিজেছিস কেন?’ আম্মুর রাগি প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়ালাম। কি বলব এখন? এম্নিতেই বলেছি জ্বর। আবার… কিন্তু জুৎসই জবাব একটা পেয়ে গেলাম। বাহ! প্রেমে পড়লে মানুষের মাথা খুলে যায় দেখছি!
‘আম্মু, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন দেখলাম বৃদ্ধ একটা লোক গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে, রিকশা পাচ্ছে না। আমি তাকে একটা রিকশা ডেকে দিলাম। ভাল করেছি না?’ মনে মনে নিজের বুদ্ধির প্রশংসা না করে থাকতে পারলাম না।
আম্মু বিশ্বাস করল কি করল না বুঝলাম না। ‘যা, গোসল করে কাপড় পাল্টা।’ বলে অন্য রুমে চলে গেল সে।
অনেক সময় নিয়ে গোসল করলাম। ঝরনার পানিতে ভিজতে ভিজতে কল্পনা করলাম পাহাড় থেকে নেমে আসা পানিতে ভিজছি। আমি একা না, আরও একজন আছে। একটার পর একটা কল্পনা উঁকি মেরে যাচ্ছে। আনমনা হয়ে হঠাৎ ফেসওয়াস হাতে নিয়ে মাথায় মাখা শুরু করলাম। একটু পরে হুশ হতেই লাজুক হাঁসি। আয়নায় সেই হাঁসি দেখতে পেয়ে আবার হাঁসি। বাহ, আমি তো খুব সুন্দর করে হাঁসতে পারি! চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে, আর থাকা যায় না। বেরিয়ে পড়লাম।
দুপুরে খেতে বসে টের পেলাম মাথাটা প্রচন্ড ভারি হয়ে যাচ্ছে, শরীরের প্রতিটা জয়েন্টে ব্যাথা। পেটের মধ্যে কেমন যেন অনুভূতি। সত্যি সত্যি জ্বর আসতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে একদিকে যেমন খারাপ লাগল, আরেকদিকে মহাখুশি হয়ে উঠলাম। কার জন্য জ্বর আসছে দেখতে হবে না? সে যখন জানতে পারবে তখন নিশ্চয়ই আমার প্রতি তার মায়া একলাফে অনেকটা বেড়ে যাবে। ইশ, জ্বরে কাতরাচ্ছি এমন অবস্থায় যদি সে আমার হাতটা ধরে একটু বসে থাকত, তাহলে সাথেসাথেই জ্বর ভাল হয়ে যেত।
কিছু না খেয়েই বিছানায় চলে এলাম। হঠাৎ করে রুম টেম্পারেচার এত কমে গেল কেন কে জানে? প্রচন্ড শীত লাগছে। কাঁথামুড়ি দিয়ে কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকলাম।
ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার কিছু আগে। শুধুমাত্র চোখের পাতাদুটো নাড়াতে পারছি। আর কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়াতে পারছি না। মাথার মধ্যে যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। আম্মু আমার মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। পাশে নাউমি বসে আছে। আম্মুর ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অসম্ভব ভাল লাগছে। ইশ, মহুয়া মেয়েটা কখন যে আসবে! এসে বলবে, ভাইয়া আমার জন্য আপনার এ অবস্থা হল! এ কথা বলে সে আমার কপালে হাত রাখবে! মহুয়াকে নিয়ে ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখেছি। যদিও খুব ভাঙা-ভাঙা, আর ঘোর-লাগা, কিন্তু দেখেছি তো!
আমাকে চোখ খুলতে দেখে আম্মু জিজ্ঞেস করল, ‘খুব খারাপ লাগছে?’
আমি খুব কষ্টে বললাম, ‘একটু।’
‘কিছু খাবি?’
আমি মাথা দোলালাম।
নাউমি বলল, ‘ভাইয়া, মহুয়া কি করেছে জানিস?’
আমার হৃৎপিন্ডে রক্ত ছলাৎ করে উঠল। ‘কি করেছে?’
‘মহুয়া আজকে কলেজে যাবার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিল। কার সাথে যেন ওর রিলেশন ছিল, ওরা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। এখন ওর হাজবেন্ডকে নিয়ে ওদের ড্রইংরুমে বসে আছে। ওর বাবা-মা মেনে নেয় নি।’
নাউমির মুখে একেকটা শব্দ শোনার সাথেসাথে আমার স্বপ্নের আকাশ থেকে একেকটা তারা খসে পড়তে লাগল। হৃদয় খান খান হয়ে গেল। পৃথিবী স্থির হয়ে গেল। আমার মনে পড়তে লাগল সকালে মহুয়া আমাকে কি কি বলেছে, তার তাড়াহুড়ার কথা। মানুষ কিছুদিন রিলেশান করে ছ্যাকা খায়। আর আমি? নাহ্, মানুষকে মুখ দেখানোর উপায় থাকল না। প্রেম করার আগেই ছ্যাকা খেয়ে বসে আছি?!
চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। সারা দিনের কল্পনাগুলো ভেঙে-চুরে আছড়ে পড়তে থাকল বুকের উপর। শারিরিক এবং মানসিক-দুধরনের যন্ত্রণা মিলে আমাকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে গেল। জতসব উল্টাপাল্টা জিনিস দেখতে লাগলাম জ্বরের ঘোরে। একবার দেখলাম, মহুয়া আর একটা হনুমান আমাকে দেখতে এসেছে। হনুমানটা আমার মাথায় খামচি দিচ্ছে। আবার দেখলাম, আমাকে খেতে দেয়া পাউরুটি মহুয়া হনুমানটাকে খাওয়াচ্ছে।
রাত নয়টা কি দশটার দিকে মহুয়া আর ওর হাজবেন্ড সত্যি সত্যিই আমার রুমে এল। লোকটা দেখতে মোটেও হনুমানের মত না, যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। একটু আগে ডাক্তার আমাকে দেখে-টেখে ওষুধ দিয়ে গেছে। মহুয়াদের মুখের হাঁসি দেখে আমার মনে হল ওর বাবা-মা ওদের মেনে নিয়েছে। না নিয়েই বা কি করবে? এত ভাল একটা মেয়েকে নিশ্চয়ই হারাতে চাইবে না কোন বাবা-মা।
‘কেমন লাগছে এখন ভাইয়া?’ খাটের পাশে এসে দাঁড়াল ওরা।
আমি কিছুই বললাম না। এমন ভাব নিয়ে শুয়ে থাকলাম, যেন কথা বলতে পারছি না। মলিনভাবে একটু হাঁসার চেষ্টা করলাম।
‘সরি ভাইয়া। আমার জন্য আপনার এ অবস্থা হল। আমি খুবই সরি।’
মহুয়ার কথা শুনে আম্মু অবাক হয়ে একবার আমার দিকে, একবার মহুয়ার দিকে তাকাল। বৃদ্ধ লোকের সাথে মহুয়ার কি সম্পর্ক তা কি ধরতে পেরেছে?
‘আর ভাইয়া, আন্টি, নাউমি, ও আমার হাজবেন্ড, শোয়াইব ইসলাম।’ মহুয়া লোকটার দিকে দেখাল।
আমি আবার শোয়াইব ইসলামের দিকে তাকালাম। আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবে। আব্বুর রেঞ্চটা কোথায় কে জানে? ওটা দিয়ে লোকটার মাথায় ঠাস করে একটা বাড়ি দিতে পারলে ভাল লাগত। জ্বরটা হয়তো একটু কমত।
চোখ বন্ধ করে আবার ঘোরের মধ্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। বাস্তব জগতের চেয়ে ঘোরের জগতটা বেশি খারাপ না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। হঠাৎ মাথার মধ্যে গান বাজতে শুরু করল, আজ বরষা রাতে সবাই গেছে বনে…। মস্তিষ্কের এক অংশ বলছে, গানটা ভুল বাজছে, ঠিক ভাবে বাজাও। আরেক অংশ বলছে, দুনিয়াদারিতে শান্তি নাই, বনে চলে যাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৪ ভোর ৫:৩৭