গেলবছর ফাল্গুনের প্রথমদিনে বৃষ্টি হয়েছিল, এবছর হল ছয়দিন পরে। রাতে মেঘের গর্জন শুনতে শুনতে ঘুমিয়েছিলাম, ঘুম থেকে উঠলাম মেঘের ডাক শুনে। আহ্, পারফের্ক্ট একটা দিন শুরু হতে যাচ্ছে। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ক্লাসে যাব না, বসন্তের বৃষ্টি আমার সিদ্ধান্তকে আরও পাকাপোক্ত করে তুললো।
ঘুম ভাঙলেও বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না। বৃষ্টিভেজা সকালটা উপভোগ করতে হবে হিসেব করে। আপাতত রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কারো কথা মাথায় আসছে না। আর এরকম সময়ের উপযুক্ত গান হচ্ছে রোদন ভরা এ বসন্ত। গানটা ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। আনন্দই আনন্দ। কয়েকবার গানটা শোনার পরে উপন্যাস পড়তে ইচ্ছা হল। উপন্যাস সমগ্র বিছানায় টেনে নিলাম। প্রথমেই বউ-ঠাকুরানীর হাট। গল্প জুড়ে দিলাম প্রতাপশালী প্রতাপাদিত্য, উদারচিত্ত উদয়াদিত্য আর চিরবসন্ত হৃদয়ের অধিকারী বসন্ত রায়ের সাথে।
বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি বিভা, সুরমার দুঃখকাতর অশ্রুর সাথে মিলেমিশে একাকার। সুরমার প্রতি সেই লেভেলের মায়া জন্মে গিয়েছে, উদয় উদয় একটা ভাব চলে এসেছে নিজের মধ্যে, এমন সময় আমার আম্মু মহাশয় এসে হাজির।
হাতের বড় চামচটা নাড়তে নাড়তে আম্মু বললো, “কিরে, কয়টা বাজে? উঠিসনা কেন?”
“এইতো আম্মু উঠছি।”
“তারাতারি ওঠ। নাস্তা করে বাজারে যা।”
আমি জানি না কেন, বাজারের কথা শুনলে মনে হয় ইলেক্ট্রিক শক খেয়েছি। জিজ্ঞেস করলাম, “বাজারে কিভাবে যাবো, বৃষ্টি তো বাইরে।”
“বৃষ্টি তো কি হয়েছে, ছাতা নিয়ে যা।” আম্মুর কণ্ঠে বিরক্তি।
“আজকেই কেন যেতে হবে? প্রয়োজনে আলুভর্তা আর ডাল রান্না করো, কাল যাব নে।”
“তুই এতো অলস কেন, হ্যা?” কণ্ঠে বিরক্তির যায়গায় রাগ। “বাসায় গেস্ট এসেছে, গেস্ট না থাকলে তোর যাওয়া লাগতো না।”
“কে এসেছে?”
“তোর মেজো খালার মেয়েদুটো এসেছে। ফ্রিজে খালি মাছ আছে, ওরা আবার মাছ খায় না। তুই গিয়ে মুরগি আর গরুর মাংশ নিয়ে আয়।”
“ওরে বাবা, রাজকন্যারা মাছ খায় না? তাহলে কচুশাক খেতে দাও।” মাছ আমি নিজেও খাই না, সেকথা আর মনে রইল না।
“চুপ থাক, তারাতারি ওঠ।” ঝাড়ি মেরে আম্মু চলে গেল।
বাধ্য হয়ে বিভা, সুরমাদের রেখে উঠে যেতে হল। ফ্রেশ হয়ে টেবিলে গিয়ে নাস্তা শুরু করলাম। পাশের রুম থেকে খিলখিল খিলখিল হাঁসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। “তোদের কারণে আমার এত সুন্দর সকালটা মাটি হল ডাইনিগুলা!” রুটি ছিড়তে ছিড়তে মনে মনে বললাম।
বাসা থেকে বের হয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। এতদিনের শুষ্ক আবহাওয়ায় শুকিয়ে গিয়ে নিষ্প্রাণ, ধূলোময় প্রকৃতি বৃষ্টি পেয়ে ধূলোময়লা সাফ করে মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠছে। আরও সবুজ হয়ে উঠেছে পরিবেশ। চারপাশ পরিচ্ছন্ন দেখলে নিজের মধ্যেও একটা পরিচ্ছন্নতার ভাব জেগে উঠে। কিন্তু বাগড়া দিয়েছে কাদা। রাস্তার সব ধূলোবালি আজ কাদা।
আমার একহাতে ছাতা, আরেক হাতে বাজারের ব্যাগ। প্যান্টটা নিচ দিয়ে কয়েকবার ভাঁজ দিয়ে পা টিপে হাটতে লাগলাম।
বৃষ্টিবাদলার মধ্যেও বাজারে মানুষের ভীড়। মাছের বাজার পেয়েছে নাকি… ও সত্যিই তো মাছের বাজার। মাছের বাজার পাশে রেখে মুরগির দিকে গেলাম। মুরগি জবেহ করে ড্রেসিং করে নেয়া যাবে না, জ্যান্ত নিতে হবে। দোকানদারের জবেহ করা মুরগি আম্মু খেতে চায় না। আম্মুর ভাষায়, “ব্যাটারা জবেহ করার আদব-কায়দা কিছু জানে?” তার উপর আবার নিতে হবে দেশী মুরগি। ব্রয়লার মুরগিও আম্মু খেতে চায় না। ব্রয়লার খেতে নাকি “বিলাই বিলাই” লাগে।
কিন্তু দেশী মুরগি তো খালি লাফালাফি করে। হাতে ধরে রাখা কঠিন। তাই অনেক খুজে একটা ভালো, ভদ্র, শান্ত মুরগি বের করলাম। খাচার একেবারে কোণায় বসে বসে ঝিমুচ্ছে। ঠিক ওই মুরগিটা চাইতে দোকানদার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে ওই মুরগিটাই কিনলাম। ভদ্র মুরগি।
এবার গরুর মাংশ কেনার পালা। কসাই সাহেবকে গিয়ে বললাম, “ভাই, দুই কেজি মাংশ দেন।”
“রানের মাংশ নাকি সিনার?” কসাই সাহেব আমার দিকে না তাকিয়েই বললো।
“যেখানে হাড্ডি বেশি সেটা দেন।”
এবার কসাই সাহেব কাটাকুটি বন্ধ করে তাকালো আমার দিকে। বেশি হাড়ওয়ালা মাংশ সম্ভবত মানুষ তেমন চায় না। গরুর একটা রান নিয়ে কোপাতে লাগলো।
গরুর মাংশ আমার তেমন পছন্দ না। খাবে তো ওই রাজকন্যারা। খাবি না মাংশ? খা, এবার হাড় খা।
গরুর মাংশ কেনা শেষে তরকারির বাজারে গেলাম। আলু কিনলাম, টমেটো কিনলাম।
“ভাই, লাউ দেন তো একটা ভাল দেখে।”
“আপনে বাইছা নেন।” পান খাওয়া লাউওয়ালা বললো।
লাউ চিমটি দিয়ে দেখতে হয়। আমি যেই লাউয়ে চিমটি দিলাম, লাউয়ের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠলো, “উহ।” আবার চিমটি দিলাম, আবার “উহ।” তৃতীয়বার খেয়াল করলাম, দোকানদার ব্যাটাই উহ উহ করছে। আমি তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই লোকটা পান খাওয়া দাঁত বের করে হাঁসলো।
“মজা করেন আমার সাথে?”
“না গো ভাই, লাউ ভালো, চিমটি দেওন লাগবো না, নিয়া যান।”
লাউ কিনলাম। এতসব নিয়ে হেটে যাওয়া যাবে না। রিকশা নিতে হবে। রিকশা নেয়ার জন্য বাজার থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়ালাম। বৃষ্টির মধ্যে একটা রিকশাও নেই। রিকশার জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, ঠিক তখনি ওকে দেখতে পেলাম।
মেয়েটা আমাদের পাশের বাসায় নতুন এসেছে। নামটাও জানি না ঠিক। শুধুমাত্র জানি মেয়েটার ডিমের খোসায় লেখালেখির একটা বাতিক আছে। কিন্তু ও এখানে সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে আছে কেন? বাজারে এসেছিলো? ডিম কিনতে? কিন্তু হাতে তো কিছু দেখছি না। হয়তো ট্রেন থেকে নেমেছে। বাজারের পাশেই তো স্টেশন। যাহোক, এসব আমার দেখার বিষয় না। রিকশার অপেক্ষা করি।
একটা রিকশা আসছে এদিকে। রিকশা আসছে ডানদিক থেকে, আর মেয়েটাও আমার ডানে। যে করেই হোক, ওর আগে রিকশাটা নিতে হবে। পরে অবশ্য ভাব নিয়ে ওকে অফার করা যায়। কিন্তু মেয়েটা রিকশা নিলে আমাকে অফার করার কোন চান্স নেই।
আমার ডান হাতে ভারি ব্যাগ। বা হাতে ছাতার হ্যান্ডেলের সাথে কোনরকমে ভদ্র মুরগিটাকে অ্যাডজাস্ট করে ধরেছি। ব্যাগ সহ হাতটা যতটুকু সম্ভব উপরে তুলে ডাক দিলাম, “খালি মামা।”
মেয়েটাও প্রায় আমার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক দিল। আমাকে তারাতারি যেতে হবে। খুব তারাতারি গিয়ে রিকশাটা ধরতে হবে। আমি হাত উচু রেখেই জোরে হাঁটতে শুরু করলাম। দুই পা মাত্র গিয়েছি, এমন সময় অঘটনটা ঘটলো। কংক্রিটের রাস্তার উপরে কাদা, পিচ্ছিল হবে ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে এতটা পিচ্ছিল? পায়ের স্লিপারের ব্রেক কোনভাবেই আটকাতে পারলাম না।
সিনেমায় দেখা যায়, কিছু কিছু বিশেষ মুহূর্তে সবকিছু যেন আটকে যায়, খুব স্লো মোশনে চলে। এই মুহূর্তটাও যেন খুব ধীর হয়ে গেল। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার চারপাশে কি ঘটছে। মুরগিটা হাত থেকে ছুটে পাখির মত ওড়ার চেষ্টা করলো, ছাতাটাও উড়ে গেল, ব্যাগটা নিচে পড়ার আগেই ভেতর থেকে আলু টমেটো বেরিয়ে এলো। পলকের জন্য চোখ গেল মেয়েটার দিকে। ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁসছে। মেয়েটার হাঁসি দেখে নিজেকে আর যুবরাজ উদয়াদিত্য মনে হচ্ছে না, চন্দ্রদ্বীপের রাজ ভাড় রমাই রমাই মনে হচ্ছে। কথা নেই বার্তা নেই মাথার মধ্যে গান বেজে উঠলো,
রোদন ভরা এ বসন্ত
সখি কখনো আসে নি বুঝি আগে।