ঢাকা শহরের বুকে মধ্যবিত্ত এক পরিবারে জন্ম। সাধারণ মানুষকে সাহায্য করার আগ্রহ ও প্রবল বাসনা ছিল ছোটবেলা থেকেই। ইজাজ আহমেদ শিক্ষা ও পেশাগত জীবন কাটিয়েছেন চারটি মহাদেশ ঘুরে। দীর্ঘ নয় বছর কেটেছে কমিউনিটি ক্যাম্পেইন অরগানাইজিং-এর মাধ্যমে। হাভার্ডে থাকা অবস্থায় তিনি ডেভিড জার্জেন-এর অধীনে পড়াশোনা করেন, যিনি একাধারে সাবেক হোয়াইট হাউজ অ্যাডভাইজার, টোস্টমাস্টার ক্লাবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রাইমারি সিজনের ক্যাম্পেইনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ইজাজ আহমেদের জীবনের একটি বড় সাফল্য আসে ২০০৭ সালে, হাভার্ড ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে তাকে মনোনায়ন দেওয়া হয় মেক্সিকান সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে। এ ছাড়াও ২০০৮ সালের শুরুর ধাপে ইজাজ আহমেদ ব্রাজিলে সেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি তার শেষ বর্ষের পলিসি এক্সারসাইজের কাজটি করেছিলেন তরুণ নেতৃত্বের উপরে। পরিবার,সমাজ ও সকলের ভ্রু কুঁচকানো সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে মাত্র ১০ হাজার ডলার পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিলেন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে এসে দাঁড়িয়েছেন বর্তমান অবস্থানে এবং গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার। তার সাথে কথোপকথনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই প্রজন্মের জন্য তুলে ধরা হলো। সাক্ষাত্কারটি গ্রহণ
করেছেন মোর্শেদ নাসের আর অনুলিখন করেছেন রিয়াদ খন্দকার
‘নেতৃত্ব’ এর মতো এমন একটি বিষয়ে আপনি কাজ করছেন যে ক্ষেত্রে আমাদের দেশে মানুষের ধারণা স্বচ্ছ ও ব্যাকরণিক নয়। এই বিষয়ে কাজ করার ইচ্ছা ও আগ্রহ কিভাবে তৈরি হলো?
ছোটবেলা থেকেই এই বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্টের শিক্ষক ছিলেন। ১৬-১৭ বছর বয়স থেকেই আমি একটি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। তারপর এ-লেভেল শেষ করার পর চলে যাই স্কটল্যান্ডে। সেখানে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করি। এই পর্যায়ে আমি অনেক কমিউনিটি সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম। সেখান থেকেই মূলত এই লিডারশিপের উপর দক্ষ হয়ে উঠি। তারপর আমি ঢাকা চলে আসি। ফিরে এসে তখন ড. আতিউর রহমানের সাথে কাজ করা শুরু করি। ঢাকায় যখন আমি কাজ করি তখন আমার একটা উপলব্ধি হয়—বাংলাদেশে আসলে যে সমস্যা সেটা অর্থের সমস্যা নয়, আসলে তা হচ্ছে নেতৃত্বের সমস্যা। তখন থেকেই চিন্তা—একটা নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার। সাধারণত এইরকম একটি প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য অর্থের ও সাহসের প্রয়োজন, তখন আমার দুটোই ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে নিজেকে আরও একটু জানা বা আরও একটু গড়ে তোলার জন্য আমি হাভার্ড ইউনিভার্সিটিতে দুই বছরের জন্য পড়াশোনার উদ্দেশে পাড়ি জমালাম। আমি ভাবলাম, নতুন প্রজন্মকে নিয়ে এই কাজটা শুরু করা যাক, কেননা আমার বয়স তখন অল্প আর প্রবীণদের কাছে আমার চিন্তাটা যতটা গ্রহণযোগ্য হবে তারচেয়ে বেশি হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। সেখানে একটি ছোট প্রজেক্টে কাজ করি এবং এর অ্যাওয়ার্ড নিয়ে বাংলাদেশে আসি। সাধারণত আমাদের কাজের লক্ষ্য হচ্ছে দুটো, একটা হচ্ছে, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম যদি ভালো এবং খারাপের মাঝে পার্থক্য বুঝতে পারে তাহলে তা দেশের জন্য একটা ভালো দিক হবে। নেতৃত্ব মানেই কিন্তু কোনো ক্ষমতা না। নেতৃত্ব হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া; ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যেকোনো মানুষ এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে। নেতৃত্বকে যদি কোনো ব্যক্তি পর্যায়ে না দেখে একটি প্রক্রিয়ায় দেখি তাহলে যে সুবিধাটা হচ্ছে, তা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ মনে করবে, আমরাও এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারি। আমরা যদি মনে করি, চেয়ারম্যান হলে নেতৃত্ব দিতে পারব বা অন্য কোনো বড় প্রফেশনে থাকলে নেতৃত্ব দিতে পারব তাহলে নেতৃত্ব একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে চলে আসবে। যেমন চিন্তা করেন ঢাকা শহরের জ্যামের কথাটা। কেউ যদি মনে করে জ্যাম শুধুমাত্র ঢাকা শহরের মেয়রই বন্ধ করতে পারবে তাহলে তা পুরোপুরি ভুল। কেননা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে সবসময় সব সমস্যার সমাধান থাকে না , সমস্যাটা যেহেতু আমাদের সকলের তাই এটা নির্মূলে আমাদের সকলেরই সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তারপর হচ্ছে, আমাদের সমস্যাগুলোর ধরন কী তা জানা। সমস্যা যেহেতু আমাদের, সেহেতু সমস্যা সমাধানে আমাদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এই দুটি জিনিসই আমরা এই নতুন প্রজন্মকে শেখানোর চেষ্টা করছি যে, লিডার হওয়া মানেই কিন্তু মন্ত্রী হওয়া না, যে যার অবস্থা থেকে আমরা নেতৃত্ব করতে পারি।
আমাদের এই নতুন প্রজন্মের মাঝে কী এই নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারটি পরিষ্কার বা এই ব্যাপারটি কি
তারা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে?
এটা কঠিন, কারণ আমাদের প্রোগ্রামে তারা যখন আসেন তখন তাদের বয়স সাধারণ ১৭-১৮ বছর। কিন্তু তার আগে কিন্তু সে দীর্ঘ সময় ধরে শিখে আসছে লিডার মানেই মহাত্মা গান্ধী, লিডার মানেই বারাক ওবামা, লিডার মানেই উপরের কোনো কিছু। সেখান থেকে তাদের এই সরিয়ে এনে তাদের বুঝানো নেতৃত্ব মানে একটি প্রক্রিয়া। কিছু কিছু ছেলে, মেয়ে খুব তাড়াতাড়ি এটা ধরতে পারে, আবার কেউ কেউ এটা বুঝতে সময় নেয়। আমাদের এই প্রোগ্রামটা চার মাসব্যাপী করি, যাতে এই ব্যাপারটি তাদের মাঝে তুলে আনতে পারি। তারা যেন বুঝতে পারে সঠিক অবস্থাটি কী। তারা যেন অগ্রসর হয়ে দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারে। একটা জিনিসের মুখে মুখে সমাধান দেওয়াটা খুব সহজ একটি কাজ, কিন্তু একটি ব্যবহারের পরিবর্তন করা কিন্তু ব্যাপক কঠিন একটি কাজ, তবে এই প্রক্রিয়াটা এক দিনে সম্ভব না।
মূলত আমাদের গড়ে ওঠার বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে পরিবারের উপর। আপনার কি মনে হয় নেতৃত্বের এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পরিবারেরও একটা ভূমিকা আছে?
অবশ্যই আছে। আমার মনে হয়, পরিবার থেকে যদি ছেলেমেয়েকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা যায় তাহলে একটি পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ১২ বছরের ছেলে বলছে আজকে বাসায় আমরা পার্টি করব তাহলে সেটা মেনে নেওয়ার কোনো মানেই হয় না। সেক্ষেত্রে তাকে অবশ্য ডিসিশন মেকিংয়ের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে হবে। তাকে বুঝাতে হবে গ্রহণযোগ্য এবং অগ্রহণযোগ্যের মধ্যে পার্থক্য কী। আমরা যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাই, যেমন—ইউনিভার্সিটি, স্কুল, কলেজ ইত্যাদিতে, তখন দেখি বাবা-মা তাদের সন্তানের জিপিএ নিয়ে এত চিন্তিত যে, অন্য কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করার সময় তাদের নেই। হ্যাঁ, আমি মানছি ভবিষতের জন্য ভালো পড়াশোনা করাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ভালো জিপিএ কোনো দিনই ভালো মানুষ গড়ে তুলতে পারবে না। ভালো পড়াশোনার সাথে নিজের দায়িত্বের প্রতিও সচেতন হতে হবে। যে মানুষ নিজের দায়িত্বের প্রতি সচেতন না, সে কোনোদিনই ভালো মানুষ হতে পারে না। তাই আমার মতে, প্রথমেই একজন ভালো মানুষ হওয়াটা প্রয়োজন এবং এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাটা অনেক বেশি।
আপনাদের এই যে নেতৃত্ব নিয়ে কাজ করা, এ ক্ষেত্রে আপনারা কী কী পদ্ধতি অবলম্বন করেন?
আমাদের যে প্রোগ্রামটা আছে সেটা হচ্ছে চার মাসব্যাপী একটি প্রোগ্রাম। আমাদের প্রোগ্রামের তিনটা অংশ আছে। আপনারা জানেন, আমাদের দেশে শিক্ষার মাধ্যম হচ্ছে তিন ধরনের—ইংলিশ, বাংলা এবং মাদ্রাসা মাধ্যম। আমরাই বাংলাদেশে প্রথম সংগঠন, যে সংগঠন ২০০৮ সালে এই তিনটা মাধ্যমকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে। তিনটা মাধ্যমকে একত্রিত করেই বাংলাদেশের উন্নয়ন এগিয়ে যাবে। অনেক ধরনের মানুষ আছে, যারা ধর্মের পক্ষে আবার অনেকেই আছে ধর্মের বিপক্ষে, এছাড়াও আরও অনেক মতধারা আছে, কিন্তু একটি জায়গায় আমরা কিন্তু একমত। আর সেটা হচ্ছে, আমরা সবাই বাংলাদেশি, তাই এই তিনটা মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের আমরা একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসি, যেন তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। এই ছেলেমেয়েদের প্রথমে আমরা নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দিই। ওদেরকে আমরা শেখাই নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব এক জিনিস নয়। কর্তৃত্বসহ নেতৃত্ব দেওয়া যায় কর্তৃত্ব ছাড়াও নেতৃত দেওয়া যায়। আমরা সাধারণত তাদের সেই প্রশিক্ষণটা দিই তারা কীভাবে বলতে পারবে, কীভাবে শুনতে পারবে, কীভাবে দেখতে পারবে। মূলত নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দুইটি জিনিস প্রয়োজন—একটা হচ্ছে নিজেকে জানা, আমি কে, আমার জীবনের উদ্দেশ্য কী। মোট কথা আমার সম্পর্কে আমি কতটুকু সচেতন। আর দু’ নাম্বারটা হচ্ছে, আমাদের চারপাশের পরিবেশটা কী সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া। আমরা নতুন প্রজন্মকে এটাই শেখাই আগে, সমস্যটাকে বুঝতে হবে, তারপর তার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। সমস্যা না বুঝেই সমাধানে এগিয়ে যাওয়া নেহাত বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রশিক্ষণে আসা ছাত্রছাত্রীদেরকে কি কোনো ফি-এর ব্যবস্থা করতে হয় নাকি আপনারাই কোনো ফান্ড থেকে তা দেন?
আমরা নিজেরাই তাদের স্কলারশিপ দিই। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা কম্পিউটার শিখতে টাকা দিতে চাই, ইংলিশ শিখতে টাকা দিতে চাই, কিন্তু নেতৃত্ব শিখতে টাকা দিতে চাই না। আমি যখন দেশে আসি তখন চিন্তা করি, দেশের উন্নয়ন দেশের টাকা দিয়েই করব, কিন্তু বাস্তবতায় তা আমি পাইনি। এজন্য আমাদের ডোনারদের সাপোর্ট নিতে হয়। ইউএস এম্বাসি থেকে আমরা সাপোর্ট নিয়ে থাকি। সেখান থেকেই আমরা ৪২ জন ছাত্রছাত্রীর স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে থাকি এ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো খরচ নেই। এই কোর্সটি শেষ করার পর আমরা তাদের একটি গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেট দিই।
ছাত্রছাত্রীদের বাছাইকরণ প্রক্রিয়াটা আপনারা কীভাবে করেন?
সিলেকশন প্রক্রিয়াটা হচ্ছে তারা সবাই অ্যাপ্লিকেশন করে, অনলাইন বা অন্যান্য মাধ্যমে। আমাদের বর্তমানে একটি কোর্সের অ্যাপ্লিকেশন চলছে। অ্যাপ্লিকেশনের ডেডলাইন আগামী মাসের ৫ তারিখ। এই অ্যাপ্লিকেশনটি করার পর তাদের একটি লিখিত পরীক্ষা হয়, তারপর ভাইবা হয়, সেখান থেকে আমরা ৪২ জনের মতো সিলেক্ট করি। এবং এই ৪২ জনের মধ্যে ১৪ জন মাদ্রাসা মাধ্যম থেকে, ১৪ জন ইংলিশ মাধ্যম থেকে, ১৪ জন বাংলা মাধ্যম থেকে। পরবর্তীতে আমরা তাদের বছরে এক বার নিয়ে আসি। যেমন আমাদের গত বছর একটা অ্যানুয়াল স্যামিট হলো এবং আগামী বছরের এপ্রিলে আরও একটা হবে। সেখানে আমরা তিন দিনের জন্য সকল শিক্ষক এবং ডেলিগেটসদের নিয়ে আসি রি-ইউনিয়নের জন্য। যখন তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়, তখন আমরা তাদেরকে ফলোআপ করি। আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা কেউ কেউ নিজেদের সংগঠন করেছে। তারা তাদেরকে নানা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করছে।
মূলত লিডারশিপ ব্যাপারটা অনেক সচেতনতার বিষয়, প্রতিদিনের প্রয়োগের বিষয়, প্রতিদিনের আপডেটের বিষয়।
এই ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকাটা কেমন?
আমার মনে হয়, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা মিডিয়ার কাছে করা উচিত। নেতৃত্বের গুরুত্বটা কী, নেতৃত্বের কাজটা কী, নেতৃত্ব সামনে নিয়ে যাওয়া নাকি সামনে থাকাটা শুধু গ্ল্যামার, নাকি শুধু সামনে থেকে মানুষের মনোযোগ আদায় করা? নেতৃত্বের আসল কাজটা হচ্ছে যে, কাজটা দশজনের মঙ্গলকে সামনে নিয়ে যাবে। সমাজব্যবস্থায় একটা পজেটিভ উন্নয়ন দাঁড় করানো। এখন মিডিয়া যদি নেতৃত্বকে এভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরে তাহলে আমার মনে হয় এর সঠিক সংজ্ঞাটা বেরিয়ে আসবে। আমরা নতুন প্রজন্মকে নিয়ে কাজ করি এটা খুবই কঠিন। কেননা নতুন প্রজন্মের মনোযোগ পরিবর্তন হচ্ছে খুব সহজভাবে, এত চাক্যচিক্যের মাঝে কিন্তু নতুন প্রজন্মের মনোযোগটা হারিয়ে যাচ্ছে বা আমি বলব ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। আসলে একজন পরিপূর্ণ নাগরিক হওয়ার জন্য তার দায়িত্ববোধ, তার নৈতিকতা, তার চিন্তাচেতনার যে বিকাশের প্রয়োজন আমরা তা কতটুকু দিতে পারছি, সেটা হচ্ছে এখন মূল প্রশ্ন। তাই আমার মনে হয় এই জায়গায় মিডিয়ার একটি গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কেননা মিডিয়া যদি সাপোর্ট না করে তাহলে মানুষ জানবে কী করে। কাজেই মিডিয়ারও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে নেতৃত্ব দেওয়ার।
এই রকম একটি নতুন কাজ করতে গিয়ে আপনার চারপাশের মানুষের কাছ থেকে কেমন সাড়া পেয়েছেন?
আমি মধ্যবিত্ত ঘরের একজন সন্তান। আমি যখন ২০০৮-এ ঢাকায় আসি তখন আমেরিকায় একটি বড় চাকরি ছিল। আমরা এখন যেখানে থাকি সেটা আমার দাদার বাড়ি ছিল, পরে তা অ্যাপার্টমেন্ট করা হয়েছে। আমার বাবা-মায়ের একটি বড় স্বপ্ন ছিল, ছেলে একটি বড় চাকরি করবে। যখন বাবা-মা’কে বলেছি চাকরি ছেড়ে দেবো, দেশে চলে আসব, লিডারশিপ নিয়ে কাজ করব তখন সবাই ভ্রু-কুঁচকে বলেছে, এটা তোমার কেমন ধরনের চিন্তা। দেশে যখন আসি তখন আমার কোনো চাকরি ছিল না, মাত্র ১০ হাজার ডলার নিয়ে চট্টগ্রামে একটা প্রোজেক্টের কাজ শুরু করি । তিন মাস পর সেই টাকাও শেষ, তখন আমার কিছুই ছিল না বন্ধুবান্ধব থেকে কোনো সাপোর্ট পাইনি, পরিবার থেকে কোনো সাপোর্ট পাইনি। প্রথম এক বছর আমার রুম থেকে কাজ করি। তারপর দেখলাম, কিছু লোক নেওয়া দরকার, তখন তো আর আমার বেডরুমে কাজ হয় না, তারপর আমাদের বাসার গেস্টরুমে অফিসের ব্যবস্থা করি। তখন বাবা-মা খুবই হতাশ ছিল, ছেলেকে এত পড়াশোনা করালাম আর ছেলে বাসায় বসে অফিস করছে, তারাও আত্মীয়স্বজনদের বলতে পারছেন না ছেলে কী করে, এটা কি একটা এনজিও নাকি স্কুল নাকি অন্যকিছু। ঘরে থেকে অফিস—এটা আবার কী ধরনের প্রতিষ্ঠান। এই রকম অনেক ক্রিটিসিজম পেয়েই আমাদের আজকের এই অবস্থাটাতে আসতে হয়েছে। এটা আমার জীবনে খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল যে নেতৃত্বকে সাধারণ মানুষের মাঝে বুঝানো, এর সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। সব মিলিয়ে অনেক কষ্ট করেই আজকের এই অবস্থানে এসে আমরা পৌঁছেছি। এবং বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। অনেকের ধারণা ছিল এই কাজটি দিয়ে আমি রাজনৈতিক কোনো চিন্তাভাবনা করছি কি না। আমি একটা জিনিস ভেবে বড় আনন্দ পাই যে, আমার বয়স যখন ৭০ হবে তখন আমার অনুশোচনা হবে না আমার জীবন নিয়ে। আমার মাদ্রাসার একটা ছেলে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসছে আলিম পড়ার জন্য। ঢাকায় এসে সে বিওয়াইএলসি নাম শুনছে, তো এখানে এসে সে ভর্তি হয়েছে। এখানে এসে সে এতটাই প্রাণবন্ত হয়েছে যে, সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেয় এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটির টপ চারশর মধ্যে থাকে। কিছুদিন আগে সে আমার কাছে আসে, এসে বলে ভাইয়া লন্ডনের একটা সামিট হচ্ছে ইয়ুথদের নিয়ে, আমি অ্যাপ্লাই করতে চাই। অ্যাপ্লাই করার জন্য আমার একটা ভিডিও ইন্টারভিউ লাগবে। তো তার জন্য আমি আমাদের একটা ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে ওর একটা ইন্টারভিউ করি । যেহেতু সে মাদ্রাসার ছেলে তাই সে খুব ভালো করে ইংলিশ বলতে পারে না। তারপর অনেক কষ্ট করে ওকে বারবার জিজ্ঞেস করে করে ইন্টারভিউটা নিলাম। তারপর সেটা আমরা লন্ডনে পাঠাই এবং সে-ই বাংলাদেশ থেকে একমাত্র ছেলে যে ওই ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালে সিলেক্ট হয়। এটা আমার জীবনে অনেক বড় একটা পাওয়া। আমার বয়স যখন ১৮ ছিল তখন আমার বাবা আমাকে একটা প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য পাঠাতে পেরেছিলেন। এটা আমার জীবনের একটি অন্যতম একটি সৌভাগ্য। এতে আমার বাবার একটা সাপোর্ট ছিল বলে আমি পেরেছি। কিন্তু ওই ছেলেটা কোনো সাপোর্ট ছাড়া নিজের চেষ্টায় সে লন্ডন যাচ্ছে একটা ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করার জন্য, এটা তার নিজস্ব অর্জন। এটা তার নিজের সফলতা। এইরকম অনেক গল্প আছে। আমাদের ছাত্রদের মাঝে অনেকে আছে যারা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছে। অনেকেই আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবস্থানে সমাজের জন্য কিছু একটা করছে। হয়তো তা খুব বেশি উল্লেখযোগ্য না কিন্তু এই ছোট ছোট কাজগুলোই তাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে বড় কাজের দিকে। তাদের ছোট ছোট কাজগুলোই আমাকে আমার এই কাজের ক্ষেত্রে অনেক অনুপ্রেরণা জোগায়।
শেষ প্রশ্ন, আপনার এবং বিওয়াইএলসির নিকটতম পরিকল্পনা কী এবং এই নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে আমরা বারিধারায় একটি জায়গা পেয়েছি, সেখানে আমরা আমাদের সেন্টার করছি। এ ক্ষেত্রে স্যার ফজলে আবেদেরও সহযোগিতা রয়েছে। ওখানে আমরা সেন্টার করে আমরা আমাদের প্রোগ্রামগুলো বাড়াতে চাই। এই প্রজন্মের আরও বেশি ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসতে চাই, চার মাসব্যাপী কোর্সও থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের জন্য তিন মাসের ছোট ছোট কোর্সও আমরা অফার করব। আমার মনে হয়, ছেলেমেয়েরা যখন কর্মক্ষেত্রে চলে যায়, তখন তাদের মাঝে লিডারশিপ জিনিসটার গুরুত্ব অনেক বেশি থাকে। আমরা চেষ্টা করব বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কোর্স চালু করার জন্য। আল্লাহ যদি সাহায্য করে, স্বপ্ন আছে একটা বড় ক্যাম্পাস করার। বিশ্ব যখন আজকের অর্থনীতি নিয়ে বলে তখন পুরো বিশ্ব তাকায় লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের দিকে, বিশ্ব যখন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কথা বলে পুরো বিশ্ব তাকায় এমআইটি ক্যালটেকের দিকে এবং আজ থেকে পনের বছর পর এশিয়া যখন নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলবে তখন পুরো এশিয়া তাকাবে বিওয়াইএলসির দিকে। বাংলাদেশকে সবাই চিনবে বাংলাদেশে একটা ওয়ার্ল্ড ক্লাস লিডারশিপ ইনস্টিটিউট আছে, নতুন প্রজন্মকে একটি আদর্শ লিডারশিপের উপর ট্রেনিং দিচ্ছে। এটাই আমার স্বপ্ন। আজ থেকে দশ পনের বছর পর সেখানেই আমরা যেতে চাই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





