পর্ব-১
আমি বরাবর’ই যথেষ্ট মেধাবী(!) ছিলাম। তাই ছাত্রলীগের ভাইভা বোর্ডে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠতে খুব বেশি কাঠ-খরি পোড়াতে হয়নি। কিন্তু ভয় ছিল হলে কেমন ছিট পাব তা নিয়ে। তাই গণরুমে থাকার প্রবল আত্মপ্রত্যয় নিয়ে হলে উঠলাম। সর্বদা আমার সাহসে বুক কাপত। প্রথম যে রাতে হলে উঠলাম সেই রাতের কথ আগে বলি।
কাপড়ের পুটলি’টা সাথে নিয়ে আনুমানিক রাত ৯।৩০টায় হল গেটে এসে রিকশা থেকে নামলাম। মনের মধ্যে এক অজানা আতংকের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। মনে মনে নিজের অসহায়ত্বের কথা একবার চিন্তা করলাম। ভাবলাম এখন কেউ যদি হঠাৎ আমাকে চা-পাতি দিয়ে কোপাতে থাকে তবে আমাকে কে রক্ষা করবে। কেউ না। মেধার পরীক্ষার কঠিন লড়াইয়ে জয়ী হয়ে যেন মৃত্যু কে পুরস্কার পেলাম।
হলে ঢুকে ছাত্রলীগের এক বড় ভাইকে(!) ফোন দিলাম। আমাদের এলাকার। শুনেছি ক্যাম্পাসে সবাই তাকে একনামে চেনে। খুব ক্রেজি হিসেবে ক্যাম্পাসে তার বেশ নাম-ডাকও আছে। মেশিন ছাড়া নাকি ক্যাম্পাসে হাটাচলা করেন না। লোকমুখে এও শুনেছি ক্যাম্পাসের কোন দোকান থেকে তার ছোট ভাই পরিচয়ে কিছু খেলে দোকানদার নাকি জামাই আদর করেন, এমন কি বিল চাওয়ারও সাহস পান না।
ফোন রিসিভ করে আমাকে কর্কশ কন্ঠে তার রুমে যেতে বললেন। রুমের সামনে এসে দেখলাম দরজায় বেশ বড় সাইজের একটা বঙ্গবন্ধুর ছবি লাগানো। বুঝলাম পথিক পথ চিন্তে ভুল করে নাই। গেট খুলতেই দেখি প্রায় অর্ধনগ্ন এক মানব শরীর নির্ভাবনায় সিগারেটে ফু দিচ্ছে। সালাম দিলাম। জবাব না দিয়ে বসতে বলল। খুব সাবধানে বসলাম। তাকে বুঝাতে চাইলাম আমি তার ভীষণ অনুগত ছোট ভাই। যাই হোক, সে আমাকে বড় ভাই সুলভ অনেক প্রশ্ন করতে থাকল, ভাবখানা এমন যে, আমি গুরুর কাছে দীক্ষা নিতে এসেছি। নানা রকম নোংরা প্রশ্নে আমাকে বিব্রত করতে লাগল। যেমন, পলিটিক্স করবি কিনা, শিবিরের সাথে সম্পর্ক আছে কিনা, প্রেম করি কি না ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিছুক্ষণ পর আমরা বের হলাম গেস্ট রুমের(হলের প্রোগ্রামকে গেস্ট রুম বলে) উদ্দেশ্যে। দোতালার সিড়ি ভেঙ্গে গেস্ট রুমের সামনে আসতেই দেখি অনেক মুজিব সেনা গেস্টরুমে ভীড় করেছে। কেউ কেউ বসে আর যারা বসার জায়গা পাইনি তারা বাধ্য হয়ে দাড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকা বেশিভাগের মুখে এক মলিন আভা ফুটে উঠেছে। অসহায়ত্বের এক হিংস্র থাবা যেন এদেরকে দুমরে মুছরে শেষ করে ফেলছে। চেহারার দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, এরা কেউ নিজ ইচ্ছায় এখানে আসেনি। অধিকাংশই পরিস্থিতির স্বীকার। সামান্য মাথা গোজার ঠাই পেতে এরা নিজেদের জীবনবাজি রাখতেও প্রস্তুত। ভাবতে অবাক লাগে, যাদের এখন টেবিলে থাকার কথা তারা কিনা মানুষরুপি কিছু কুত্তার কাছে হাজিরা দিতে এসেছে। না এসেই বা কি করবে বলুন? এই জানোয়ারদের বিরুদ্ধে কথা বলবে এমন সাধ্য কার? আছে এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা? আছে একটু শান্তিতে টেবিলে বসে পড়ার সুযোগ? তাদের চোখের দিকে তাকাতেই বুকের মধ্যে হু হু করে উঠে। আজ থেকে হয়ত আমাকেও এই পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ছোফার দিকে তাকাতেই হাসি ঠেকাতে পারলাম না। চার সিটের ছোফায় ৯ জন ভদ্রলোক বসে আছেন। আর এক মদন বসার জন্য পাছা দিয়ে গুতাগুতি করছে। হায়রে বোকা গুতাগুতি করলেই কি পাছা ঢুকানো যায়! আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ সিট ছাড়তে রাজি নয়। সবার মতো আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগলাম। দেখে মনে হল বাপের জনমে ছোফা দেখে নাই। নরম ছোফায় পাছা লাগানোর জন্য এর জান যেন বেরিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে মানুষের সামনে প্রদর্শন করার এক নোংরা মোহ এদেরকে অন্ধ করে রেখেছে। যাই হোক অবশেষে এক মহানুভব ছেলে সিট ছেড়ে উঠে দাড়ালো। পরে এক বন্ধু বলেছিল, ঐ ছেলে নাকি ওদের মধ্যে সবচেয়ে জুনিয়র ছিল। হয়ত হলের সিটটা বাচাতেই ছোফার সিটটা ছাড়তে হয়েছিল।
গেস্ট রুমে কি হয় তা তো ১ম পর্বেই বলেছি। তবুও বলি সেদিন রাতে অনেক বড় ভাইকে চোখের সামনে হেনস্থা হতে দেখলাম। তাদের অপরাধ, গতকাল নাকি ক্লাসের কারণে মধুর ক্যান্টিনে যেতে পারেনি। অদ্ভূত! নিজের চোখে বড় ভাইদের এভাবে অপমান হতে দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল, পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ইশ আমার হাতে যদি একটা পিস্তল থাকত! মাত্র একটা! তাহলে এই কুত্তার বাচ্চাগুলারে…
আমাকেও অবশ্য সবার সামনে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল। তবে তেমন কড়া কথা বলে নাই। হইত প্রথম দিন বলে। তবে এক ছেলে ছিল, সেও আমার মত হলে উঠার জন্য এসেছিল। তাকে যখন প্রশ্ন করা হল, তোর বাড়ি কই। ছেলেটা নির্দ্বিধায় জবাব দিল, “পাবনা সাথিয়া”। মুহুর্তে গেস্টরুমে হাসির রোল পরে গেল। আমি মনে মনে ভাবলাম এবার বুঝি আর রক্ষা নেই। ছাত্রলীগ বোধহয় এবার “দুই একটা শিবির ধর, সকাল-বিকাল নাস্তা কর”- এই আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে চা-পাতি নিয়ে নিরীহ ছেলেটির উপর ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু আশ্চর্য! কেউ ছেলেটিকে কিছুই বলল না। কয়েকজন শুধু ছেলেটিকে হলে না তুলতে অনুরোধ করল। কিন্তু সবচেয়ে সিনিয়র(নাম গোপন রাখছি) যে, সে বলল “অতীতে যা করছিস সব ভুইলা যা, এখন থেকে তুই ছাত্রলীগ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি”। আমি অবশ্য পরে এই ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দাড় করালাম, যে যেই দলকেই সাপোর্ট করুক, কাউকেই হলে তুলতে এদের আপত্তি নেই। কারন ছাত্রলীগের নেতাদের পেছেনে হাটার জন্য অন্তত কিছু জুনিয়র ছাত্রতো দরকার। কারন এদের দিয়ে সব কাজ করানো যায়। আর যার পেছেনে লোক যত বেশি, তার কমিটিতে পোস্ট পাওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি।
অবশেষে গেস্ট রুম শেষ হল। সেই বড় ভাই আমাকে তার পেছনে আসতে বলে গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি লম্বা বারান্দা ধরে তার পিছু পিছু হাটতে লাগলাম। অবশেষে অপেক্ষার পালা সাঙ্গ হল। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল চির আকাঙ্খার সেই গেস্ট রুমে। দূরগন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তাকিয়ে দেখি চারিদিকে হার্ডবোর্ড দিয়ে ঘেরা চার-পাচটা রুম। তারই একটাই এই অধমের থাকার জায়গা হল। তাও আবার সিংগেল বেডে শেয়ারিং করতে হবে। আমার সেই বড় ভাই বেশ ধমকের সুরে আমার বেডমেট কে বললেন, আজ থেকে আমি তার সাথে থাকব। আর এও বললেন যে, আমি তার এলাকার ছোট ভাই। সুতরাং কেউ যেন আমাকে পেইন না দেই। যদিও আমার বেডমেট বয়সে তার থেকে বড় ছিল। আমি বুঝলাম, আমাকে আমার বেডমেট খুব একটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। ভাবখানা অনেকটা এরকম, ডাস্টবিন থেকে যেন দুই-তিন দিনের একটা পচা মুরগি তার সামনে এনে রাখা হয়েছে। কি আর করার মুজিবের সৈনিকের নির্দেশ শিরোধার্য!
আনুষ্ঠানিক পরিচয়পর্বে যা জানলাম তা হল, তিনি ইংরেজীতে থার্ড ইয়ারে পড়ছেন। বাড়ি চাটগা। খুব মেধাবী না। GRE’এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, USA তে PhD করার ইচ্ছা আছে। গার্লগ্রেন্ড ছিল কিন্তু ছুইটা গেছে। আর বাপের টাকা-পয়সা তেমন নেই। থাকলে এই জাহান্নামে তিনি থাকতেন না। আমিও এক ঝলক হেসে বুঝিয়ে দিলাম, আমার অবস্থাও আপনার থেকে কোন অংশে ভাল না। পরিচয় পর্ব শেষ করে এবার নিজের রুমের দিকে এক নজর তাকালাম। রুমে ৯ টা বেডে ১৮ জন হতভাগা থাকে। হাটা-চলা করার কোন জায়গা নাই। দুই বেডের মাঝখান দিয়ে চলাচলের জন্য একটু জায়গা। একজন হাটলে আরেক জনকে আবুলের মত দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। চারিদিকে থরে থরে কাপর ঝুলছে। কার কাপড় কোনটা এটা খুজে বের করাও রীতিমত একটা গবেষণার বিষয়। আমার বেডমেট আমাকে রুমের কিছু বেসিক নিয়ম শিখিয়ে দিলেন। যেমন রাত বারটার পর রুমের লাইট বন্ধ হবে, রাতে মোবাইলে ফিফফিসানি করা যাবে না, নিজের জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখতে হবে অন্যথায় হারিয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা শুনতে শুনতে শরীর ক্লান্তিতে ভারি হয়ে আসছিল। খাওয়ার রুচি হল না। চুপ করে বিছানার এক পাশে শুয়ে পরলাম।
অনেক চিন্তা মাথায় জড়ো হতে লাগল। অনেক স্বপ্ন। অনেক কল্পনা। ফেলে আসা দিনের কথা। কত কাজ বাকি পড়ে আছে। কিন্তু সময় কত অল্প!
যাই হোক, গল্পতো অনেক হল। বাকিটা না হয় পরের পর্বে করা যাবে। এখন ঘুমিয়ে পড়তে হবে। অনেক ক্লান্ত। কাল সকাল থেকে আবার মধুর ক্যান্টিনে যেতে হবে না? ভুলে গেলেন?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




