somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবির প্রবেশাধিকার :: আল নোমান শামীম

০১ লা জুন, ২০০৮ বিকাল ৫:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কবির প্রবেশাধিকার
-আল নোমান শামীম

অনেক দিন লেখালেখি করিনা। করিনা বললে ভুল হবে, করতে পারি না। করার জন্য একটা মন লাগে, একটা ব্যাপার আছে, যেটা কবি আর লেখক ছাড়া এই পৃথিবীর কেউ বুঝবে না, জানবে না। সেটা এই কবি আর লেখকদের একান্ত গোপন প্রাণ ভোমড়া। একটা অতৃপ্তি, একটা কি জেনো নেই-কি জেনো থেকেও নেই, বিলাস, বিলাসী কষ্ট, সব কিছু নিজের মতো করে দেখতে চাওয়া-সুন্দরের কাছে পরিপুর্ণ আত্মসমর্পণের নিদারুন ব্যর্থতা, কোথায় যাই, কার কাছে যাই, কোথায় গেলে পাবো শ্যামল কান্িত, কোথায় সেই পুর্ন ভুবন। এই লেখা পড়ে নিশ্চয়ই অজয়দা আর মিন্টন ভাই চিৎকার করে বলবেন, ওরে বলিস না, বলিস না, সর্বনাশ হয়ে যাবে, আমাদের ভাবনাগুলো শুনে ফেলবে সবাই, পৃথিবীর সব লোক কবি আর লেখক হয়ে যাবে, মানুষ জেনে যাবে তার সৃষ্টির রহস্য।

টিভিতে একটা নাটক হচ্ছে, আজিজ সুপার মার্কেট, সেটা দেখে অজয়দা ভীষন উচ্ছাসী, বললেন ‘ফাটায়া ফেলতাছে‘। আমিও ক্যাম্পসির চক বাজার থেকে সেইদিনই ভাড়া নিয়ে আসলাম । দেখলাম সাথে সাথে (অজয়দার অনেক কিছু আমি যাচাই বাছাই না করেই গ্রহন করি) আর ভাবলাম কবি আসলাম সানী তো আসলেই ‘ফাটায়া ফেলতাছে’। কবিরা এখনো মানুষ হয়ে উঠেনি এই পৃথিবীর, ণতৈ ঠতি ঠরৈ তডসি ওরৈলদ, কোনো কবিই কস্মিন কালে এই পৃথিবীর হয়ে ওঠেনি, বাংলাদেশের কবিরা তো নই-ই। রুদ্র মোহাম্মদ নামে আমাদের কিশোর কালে একজন কবি ছিলেন, সারাদিন সিঙ্গারা আর চা খেতেন, সাথে চলতো ধুদ্ধুমার সিগারেট, তসলিমা নাসরিনের প্রেমিক, স্বামী আবার প্রেমিক, মনে হয় প্রেমিকই ছিলেন বেশী। একদিন ডাসে আড্ডা দিচ্ছিলাম কবিতা আবৃতির ওয়ার্কশপের পর, কে একজন খোঁচা দিয়ে বললো, ওই দেখ কবি রুদ্র। আমি দেখলাম আর সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম, সারা জীবন শুধু কবিতাই লিখবো আর রুদ্র মোহাম্মদের মতো করে চুল রেখে সে যেভাবে সিগারেটে টান মেরে মাথার চারিদিকে ধোঁয়ার মেঘেদের শাসন করছে, সেভাবে শাসন করবো। কিশোর বয়সের অনেক স্বপ্নই মনে হয় শুধুই স্বপ্ন দেখা, এখনো সেই ওয়াদা আমার রাখা হয়ে উঠেনি, আমি এখন লেখালিখিই করিনা।

সময়ের অপেক্ষা তো অনেক হলো, খুব মন খারাপ হলে, মন ভ’রে এক নিশ্বাসে কোনো গভীরতর অরন্যে চলে যেতে ইচ্ছে করে, ঘুঁম ঘুঁম চাঁদে, অথবা, ধলেশ্বরীর তীরে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে জলের দিকে তাকিয়ে অনুক্ষন দীর্ঘক্ষন। এক জেলে দেখেছিলাম, নৌকার কিনারে দাঁড়িয়ে সাধুর মৌন ধ্যানে মগ্ন, মাছ মারার জাল ফেলে জলের দিকে তাঁকিয়ে আছে অনন্তকাল, কবি। একদিন যাত্রাবাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলাম, মোড়ে, রাত ১টা হবে(আসলে সকাল) , আবাহনী-মোহামেডানের খেলা ছিলো, খেলা শেষে পলটনে বন্ধুর বাড়ি আড্ডা দিয়ে জুড়াইনে বাসায় ফিরছি, মোড়ে কোনো রিক্সা নেই, আমার মতো দেরী করে ঘরের ফেরারী কয়েকজন, হঠাৎ দেখলাম একটা নতুন রিক্সা তুমুল বেগে মোড় ঘুরে জুড়াইনের দিকে যাচ্ছে। সবাই হাত উঠালো আগে আর পরে, রিক্সাওয়ালার এই দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই মোটেই, সে চলেছে যেনো কোনো দ্বিগ্বিজয়ে, কে থামাবে তাকে, কার এতো স্পৃধা থামিয়ে দেয় তার বিজয় রথ! তারপরও সবার মতো হাত উঠালাম এই ভেবে যে সে থামবে না, কিন্তু সে একটু ধীর হয়ে গেলো আমার সামনে এসে (তখোন ভাবলাম আমি ছিলাম সবার শেষে, তাই বোধ হয়), ঘাড় নেড়ে সম্রাটের মতো হুকুম করলো আমাকে উঠে পড়তে। আমি কাল বিলম্ব না করে টারজানের মতো লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম বিজয়রথে, পিছনে ফিরে সবার দিকে তাকিয়ে অট্রহাসি দিয়ে দিতে ভুললাম না মোটেও। এদিকে আমার বিজয়রথ চলছে তো চলছেই, জুড়াইনের কাছে আসতেই আমি বললাম, কতো দিবো, সম্রাট সে কথায় কান না দিয়ে বেদ বাক্যের মতো উচ্চারন করলো, স্লো করতাছি, নাইমা যান। আমি নেমে গেলাম আর সেই বিজয়রথ আমাকে পরিত্যাগ করে না থেমে দ্বিগুন উল্লাসে রেলগেট পাড় হয়ে গেলো, কবি, আরেকজন, যে সবার কিন্তু কেউ তার নয়।

আরেকদিন, অফিস ছুটির সময় হলো, আমি নটরডেম কলেজের রয়্যাল একাডমিতে ইংলিশ শিখছি, অস্ট্রেলিয়াতে আসবো। ক্লাশ শেষে কোনো রিক্সা না পেয়ে হেঁটেই চলে এলাম মতিঝিলের শাপলা চত্বরে, এসে দেখি এলাহি অবস্থা। ঘর ফিরতে মানুষের লম্বা অপেক্ষা। বাসগুলোর পাদানিতেও যায়গা নেই। পুরো চত্বরে একটা মাত্র রিক্সা দাড়িয়ে আছে সাধকের মতো, এমন কেউ নেই যে তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে না, ভাই যাবে? রিক্সাওয়ালার সেদিকে খবর নেই, সে তখন যাত্রী সিটে বসে তার বসার যায়গায় পা দিয়ে উন্নাসিকের দৃস্টিতে দেখছে মানুষের ব্যস্ততা, কিন্তু চারপাশের কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না, লোকের অনুরোধ আর অনুনয় তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে চর ভাঙ্গার আগের বিশাল গৃহস্থের দিনগুলোয়, আজ এই সময়ের জন্য সে রাজা, সে আজ মতিঝিলের এইসব অতি সাধারন মানুষদের অনায়াসে দান করে করে দিতে পারে সোনালী, পুবালী এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও, আরেকজন কবি, পৃথিবীকে যে অবজ্ঞা করার ক্ষমতা রাখে অনায়াসে, অতি তুচ্ছতায়।

আমি প্রতিষ্ঠার জন্য, সামান্য পয়সার জন্য, তুচ্ছাতিতুচ্ছ ডলারের নেশায় আমার সারাজীবনকে পরিত্যাগ করেছি, আমার আর কবি হয়ে উঠা উঠেনি, রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুললাহর মতো আমার ভ্যাগাবন্ড হয়ে উঠা উঠেনি, চাঁদ প্রতিদিন উঠে সব সুন্দরের জন্য, প্রতিদিন, তবে মাঝে মাঝে অমাবস্যাও চলে আসে। আমার জীবনে অমাবস্যা ১১ বছরের, বন্ধাত্বের। ‘আজিজ সুপার মার্কেট‘ নাটকে কবি আসলাম সানি যখন চটপটির ঘুমটি ঘরে বসে উপজাতি কবির কবিতাটি শুনে উচ্ছসিত হয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে তাকে দেন, তখন মনে হয় কবি আসলাম সানির কাছে একটা মহাসমুদ্র আর একটা নৌকা আছে, তিনি অতি দয়ালু মহাপুরুষ, এই উপজাতি কবিকে নিয়ে তিনি তার সাম্রাজ্য দেখাতে নিয়ে যাবেন পরের অভিযানে।

লেখাটি শেষ করছি কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুললার জীবনের শেষের দিকের একটা ঘটনা দিয়ে। কবি খুব অসুস্থ, ডাক্তার বলে দিয়েছেন, তোমার দুটি পছন্দ, জীবন অথবা সিগারেট, বেছে নাও। কবি সিগারেট বেছে নিলেন অন্য কিছু চিন্তা না করেই, অবলিলায়। জীবনকে কি তুচ্ছই না তিনি করলেন, দ’ুপয়সার দামে মাপলেন না জীবনকে। যে কটি দিন বাচবেন, নিজের সাম্রাজ্যে নিজের সময়ে নিজের মতো করে। কবি হওয়া, কবি হয়ে উঠা কি আজন্ম বিশ্বাস নাকি সমর্পন বিশ্বাসের কাছে, এটা জেনে যে, কবিরা মানুষ হিসেবে বিলাসী ব্যর্থ। পৃথিবীতে আমরা কতোজন আছি তা করতে পারি, হাজারো মানুষের ভিড়ে কি করে হঠাৎ অনায়াসে হয়ে যেতে পারি সবচেয়ে একা, সবচেয়ে আলাদা, চোখ বুজে হারিয়ে যেতে পারি সুখ, হতাশা, বিশ্বাস আর অতৃপ্তির জগতে, যেখানে প্রবেশধিকার শুধু কবিদের, শুধু মাত্র কবিদের।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×