একটি হাদিসকে ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে কবরে খেজুরের শাখা বা গাছের ডাল পুতে দেওয়া কিংবা গাছ লাগিয়ে দেওয়া কিংবা ফুল দেওয়া আমাদের সমাজে ধর্মীয় রীতিতে পরিণত হয়েছে।
এটা একটা গুরুত্ত্বপুর্ণ বিষয় যা জানা এবং বুঝা আমাদের জন্য জরুরী।
ইনশা আল্লাহ চেষ্টা করব সহজ সরল ভাষায় বিষয়টা উপস্থাপন করতে।
ইবনু আব্বাস (রাদ্বিঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে , একদা রাসূল (সাঃ) দুটি কবর অতিক্রম করছিলেন বা দু’টি কবরের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন । তিনি (কবর দু’টি দেখে) বললেন : দু’টি কবরেই শাস্তি হচ্ছে , তবে বড় কোন কারণে শাস্তি হচ্ছে না । অতঃপর বললেন : হ্যাঁ অবশ্যই বড় কারণ । কেননা দু’কবরবাসীর একজন নিজেকে পেশাব হতে বাঁচাত না , আর দ্বিতীয়জন পরনিন্দা করতো । অতঃপর রাসূল (সাঃ) খেজুর গাছের একটি কাঁচা ডাল আনতে বললেন এবং তা (লম্বালম্বিভাবে) দ্বিখন্ডিত করলেন এর খন্ড দু’টি দু’কবরের উপর পুঁতে দিলেন এবং বললেন : সম্ভবত ডাল দু’টো না শুকানো পর্যন্ত দু’কবরবাসীর শাস্তি লাঘব হবে ।
– হাদীসটি বুখারী , মুসলিম , আবু দাউদ, নাসাঈ , আহমাদ হাদিস গ্রন্থে সহিহ সনদে বর্নিত আছে।
এ হাদিসটি দেখলে আমাদের কাছে সাধারণভাবে মনে হয় যে কবরে খেজুরের ডাল পুতে দিলে কবরবাসির জন্য উপকার হয়। কিন্তু এটা আসলে আমাদের বুঝার মারাত্মক ভুল।
হাদিসটি ভালভাবে লক্ষ্য করলে এবং বুঝার চেষ্টা করলে আমরা যা পাই,
১/ রাসুল (সাঃ) পথ দিয়ে সাহাবীদের নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং পথে দুটো কবর অতিক্রম করছিলেন। তিনি কিন্তু কবরকে লক্ষ্য করে রওয়ানা হন নি।
২/ সাহাবিদের শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ রাসুল (সাঃ) কে মোজেজা দান করেন এবং কবরের আজাব সম্পর্কে অবহিত করান। কেননা কবরের আজাব একটি অদৃশ্য বিষয়।
৩/ তিনি একটি খেজুরের ডাল দুই টুকরা করা দুই কবরে পুতে দিয়ে আশা পোষণ করলেন যে সম্ভবত ডাল দুটি না শুকান পর্যন্ত আজাব লাঘব হবে।
৪/ কবরের আযাব সম্পর্কে ধারনা দান এবং পেশাব ও চোগলখুরী থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ হিসেবে হাদিসটি বর্নিত হয়েছে।
মূলত এ ঘটনাটি একটি মোজেজা। এটা রাসুল (সাঃ) এর জন্যই নির্দিষ্ট। কারন এই ঘটনার পরও কোন সাহাবী কখনও কোন কবরে ডাল পুতে দিয়েছেন এর স্বপক্ষে কোন প্রমান নাই। অথচ রাসুল (সাঃ) সাহাবাদের সামনেই এই কাজ করে দেখিয়েছেন। তার মানে হচ্ছে এটা রাসুল (সাঃ) এর জন্যই নির্দিষ্ট।
এটা বুঝতে হলে আর একটু জানতে হবে।
মূলত কোন মানুষই গায়েব জানতে পারে না যদিনা আল্লাহ জানিয়ে দেন। স্বয়ং রাসুল (সাঃ) কে সম্বোধন করে আল্লাহ নিজেই কুরয়ানুল কারীমে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন,
হে মুহাম্মাদ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনি ঘোষণা করে দিন যে, একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দ, লাভ-লোকসান, কল্যাণ-অকল্যাণ ইত্যাদি বিষয়ে আমার কোনই হাত নেই। আর আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম, তাহলে বহু কল্যাণ লাভ করতে পারতাম, আর কোন প্রকার অকল্যাণ আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আল-আ‘রাফ:১৮৮।
এই আয়াত প্রমান করে যে কবরের আজাব সম্পর্কে মানুষের জানা সম্ভব নয় যে কোন কবরে আজাব হচ্ছে কোন কবরে হচ্ছে না।
“বলুন, মহাকাশ মন্ডলী আর পৃথিবীর কেউই গায়েব জানেনা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া। - সুরা নামাল ৬৫।
বলুন, আমি তোমাদের এ কথা বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন ভান্ডার আছে। গায়েব সম্বন্ধেও আমি জানি না। তোমাদের এ কথাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি শুধু অবতীর্ণ ওহীর অনুসরণ করি। - সুরা আল আন আম ৫০।
অর্থাৎ বুঝা যাচ্ছে, সাহাবাদের পেশাব থেকে ভালভাবে পবিত্র হওয়া, চগলখুরির থেকে সতর্ক থাকার ও কবরের আযাব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আল্লাহর ওহী ভিত্তিক এই ঘটনা।
এটা রাসুল (সাঃ) মোজেজা। তিনি দুয়া করেছেন কবরবাসির জন্য। এবং ডাল দুটো শুকান না হয় এপর্যন্ত কবরের আজাব লাঘব হবে বলে আশা পোষণ করেন।
এখানে আসলে ডাল সজীব থাকার সময়টা পর্যন্ত আজাব লাঘবের বিষয় বলা হয়েছে। আমরা অনেকে ধারনা করি যে সজীব ডাল আল্লাহর জিকির করে তাই জিকিরের কারনে কবরের আজাব লাঘব হবে এ জন্য অনেকে আস্ত গাছ লাগিয়ে দেন। ফুল দেন।
আসলে সজীব বা জড় বস্তু সব কিছুই আল্লাহর জিকির করে। এ জন্য সতেজ ডাল হওয়ার প্রয়োজন নেই। মরা শুষ্ক ডালও আল্লাহর জিকির করে। এর দলিল হচ্ছেঃ
'সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছুই তাঁরই তাসবিহ পাঠ করে। এমন কিছু নেই যা তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। - বনী ইসরাঈল ৪৪।
অর্থাৎ জড় বস্তুও আল্লাহর জিকির করে থাকে।
অতএব সজীব ডাল জিকির করে বলে আজাব লাঘব বিষয়টা তা নয়। আসলে সেটা ছিল সময় নির্ধারন। অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) কবর দুটির বাসিন্দার জন্য দুয়া করেছেন যেন পুতে দেওয়া ডাল দুটি শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আযাব লাঘব হয়।
তাছাড়া ডালের জিকিরের কারনে আজাব বন্ধ হওয়ার কোন দলিল নাই। কাফের এর কবরে ডাল পুতে দিলে কি জিকির কারনে আযাব লাঘব হবে? হবে না।
আমরা কেন কবরে ডাল পুঁতব না বা কেন ফুল দিবো না? উপরের হাদিসের প্রেক্ষিতেও আমরা কবরে ডাল পুতে দেব না কারন,
১/ আমরা জানিনা কবরবাসী কি অবস্থায় রয়েছে ।
২/ আমরা জানিনা কবরবাসির আজাব হচ্ছে কিনা।
৩/ যদি ধারনা করি যে হয়ত আজাব হচ্ছে তাহলে এটা মৃত ব্যাক্তির উপর খারাপ ধারনা পোষণ করা হল। তাছাড়া গায়েবের বিষয় নিয়ে যেটা আমরা জানিনা সেটা নিয়ে স্বিদ্ধান্ত নেয়া হল।
৪/ রাসুল (সাঃ) জানতে পেরেছিলেন কারন তাঁর নিকট ওহী নাজিল হত, আমাদের উপর কিছুই নাজিল হয়না তাই আমাদের জানার অবকাশ নাই কবরবাসির কি আজাব হচ্ছে নাকি হচ্ছে না।
৫/ পুর্ববর্তী সৎ লোকেরা অর্থাৎ সাহাবিগণ কেউ এই কাজ করেন নাই। অতএব বুঝা যাচ্ছে এই ঘটনা শুধু রাসুল (সাঃ) এর একটি মোজেজা ছিল মাত্র এবং ঘটনাটি রাসুল (সাঃ) এর জন্য নির্দিষ্ট ছিল।
৬/ রাসূল (সাঃ) তাঁর জীবদ্দশায় অনেক সাহাবীকে কবর দিয়েছেন । অথচ এ দু’টি কবর ছাড়া অন্য কোন কবরে খেজুর ডাল পুঁতেছেন বলে কোন বর্ণনা নেই । তার মানে সেটা শুধু ওই বিশেষ অবস্থার জন্যই।
এর প্রমানে একটি হাদিস,
মৃত ব্যক্তির দাফন শেষ করে রাসুল (সাঃ) সাহবাদের দুয়া শিক্ষা দিয়েছেনঃ
'তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার দৃঢ় থাকার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ কর। কেননা সত্বর সে জিজ্ঞাসিত হবে’।
আল্লা-হুম্মাগফির লাহূ ওয়া ছাবিবতহু’ (অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন ও তাকে দৃঢ় রাখুন। - - আবু দাউদ জানাজা অধ্যায়।
এই হাদিস থেকে দেখা যাচ্ছে মৃত ব্যক্তির জন্য দুয়া করতে বলা হয়েছে। এখানে কিন্তু মৃতকে কবর দেয়ার পর ডাল বা ফুল দেওয়ার কথা বলা নাই। এখানে দুয়া করার কথা বলা আছে।
অতএব আমরা এই কাজ করতে পারব না। কেননা মৃত ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে আমাদের জানার সুযোগ নেই। আর আমাদের দুয়া কবুলের কোন নিশ্চয়তা নাই।
রাসুল (সাঃ) এর নিকট ওহী আস্ত এবং তাঁর দুয়া কবুলের নিশ্চয়তা ছিল কেননা তিনি রাসুল। তাই তিনি খেজুর ডাল শুকানো পর্যন্ত আজাব লাঘবের দুয়া করেছিলেন।
আমরা নিজেরাই গুনাহগার আমাদের দুয়া কবুলের নিশ্চয়তা কোথায় যে ডাল শুকানো পর্যন্ত আমাদের দুয়া অনুযায়ী আজাব লাঘব হবে? আর আমরা জানিই তো না যে কবরে কি আজাব হচ্ছে নাকি হচ্ছে না !
রাসুল (সাঃ) এর কোন সাহাবী থেকে এরকম আমল প্রমাণিত নয়। অর্থাৎ এই ঘটনার হাদিস বর্নিত হওয়ার পরেও কোন সাহাবী এই কাজ অর্থাৎ ডাল পুতে দেওয়ার কাজ করেছেন এমন প্রমান নাই।
অতএব কবরে ডাল পুতে দেওয়ার যে ধারনা আমাদের সমাজে তা শরিয়ত সম্মত নয়।
কবরে ফুল দেওয়া একই রকম অবস্থা তবে ক্ষেত্র বিশেষে শিরক!
ফুল সজীব থাকলে আযাব লাঘব হবে এই ধারনা উপরে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। এই কাজ বিদআত।
অনেকে কবরে ফুল দিয়ে থাকে মৃত ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করার জন্য সম্মান করার জন্য। এটা কখনও সরাসরি শিরক হয়ে যায় নতুবা কখনও শিরকের সাদৃশ্য হয়ে যায়। কেননা এভাবে মুর্তি পূজকরা মুর্তির পূজা করে থাকে।
অতএব ইনশা আল্লাহ আমরা কবরের আজাব লাঘবের উদ্দেশ্যে কোন ডাল পালা বা ফুল বা বৃক্ষ রোপণ করব না। এবং কেউ যদি করে তাহলে সুন্দর করে বিষয়টা বুঝিয়ে বলব।
তবে এখানে একটা বিষয় যে কবরকে ভেঙ্গে যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য বা জন্তু জানোয়ার যেন কবর খুড়ে লাশ খতিগ্রস্থ করতে না পারে সে জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাহিসেবে কাটা ডাল পালা রেখে দেওয়া ভিন্ন বিষয়।
অন্তরের নিয়ত হচ্ছে মূল বিষয়।
আল্লাহু আ'লেম।
হয়ত বেশি গুছিয়ে লিখতে পারি নি। দুঃখিত।
পোস্টে কোন ভুলভ্রান্তি পেলে দয়া করে কমেন্টে সুন্দর ভাষায় উল্লেখ করুন । এ বিষয়ে কমেন্ট করতে চাইলে দয়া করে সুন্দর ভাষায় কমেন্ট করুন।
চাইলে শেয়ার করতে পারেন, কপি পেস্ট করতে পারেন নির্দ্বিধায়।
জাজাকাল্লাহু খায়ের।