আজ থেকে চার দশক আগে ৩০ বছর বয়সে তারুণ্য আর জীবনশক্তির উচ্ছ্বাস নিয়ে শৃঙ্খলিত মাতৃভূমির ডাকে ঘর ছেড়েছিলেন। ভারতে গিয়ে ট্রেনিং শেষ করে দেওহাটা অঞ্চলের কোম্পানি কমান্ডার হেসেবে যুদ্ধ শুরু করেন মো. আনোয়ার হোসেন। মির্জাপুর থানা আক্রমণ করে ছিনিয়ে নেন সেখানকার সব অস্ত্র। পা হারান সম্মুখযুদ্ধে, তারপরও থামাননি যুদ্ধ। স্বাধীন দেশে পঙ্গুত্ব নিয়ে রাষ্ট্রশক্তির কাছে পাননি ভবিষ্যতের কোন নিশ্চয়তা। নিজের হারানো পা নিয়ে যখন জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মত দিন কাটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ জেতা আনোয়ার হোসন। পঙ্গু হয়ে সারাজীবন প্রায় বেকার থেকেছেন তিনি, পৈত্রিক জমিজমা খুইয়ে জীবনগাড়ি ঠেলে এসেছেন এতদিন ধরে। অভাবের তাড়নায় একমাত্র ছেলেকে পড়াশোনা করাতে পারেননি। তারপরও বাস ড্রাইভার ছেলে মিল্টনের কাঁধেই তার সব দায়। ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া দশ বছরের মেয়ে শারমিনের চিন্তায় কখোনোই হয়ত প্রাণ ভরে হাসেননি তার স্ত্রী খালেদা বেগম। হ্যাঁ পেয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন, ছয়মাস পরপর নামমাত্র সম্মানি যা তার কাছে মনে হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ভিক্ষা হিসাবে। করুণার পাত্র হয়ে থাকতে চাননি তিনি। যে দেশকে নিজের সবটুকু দিয়েছেন, তার কাছ থেকে করুণা নিতে একজন বীরের অহমে লেগেছিল হয়তো। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেই ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে কেটে দিয়ে আসেন নিজের নাম।
গত ৩০ মার্চ, আমাদের দেশপ্রেম আর স্বাধীনতাপ্রীতি দেখানোর কয়েকটি উপলক্ষসম্বলিত মাসের শেষ দিকেই হঠাৎ স্ট্রোক করেন তিনি। বিশ হাজার টাকার পারিবারিক সম্বল নিয়ে তার স্বজনেরা রওনা হন ঢাকায়, ভর্তি করান জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে। দু'দিন পরেই ফুরিয়ে যায় টাকা, লাইফ সাপোর্ট দেয়ার বিরাট খরচ বইতে পারবার আশঙ্কায় হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে, রাস্তাতেই মৃত্যু হবে জেনেও রওনা দেন বাড়ির পথে। আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী নিজেই যেমনটি বললেন, '' জানি মারা যাবেন আমার স্বামী, কিন্তু কি করব? প্রতিদিন দশ হাজার টাকা খরচ করার সামর্থ নেই আমাদের। তাই রওনা দিয়েছিলাম, বাড়ি গিয়ে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা তো করতে হবে।''
রোগীর ফাইলে মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র দেখে রাস্তা থেকে তাদের ফিরিয়ে এনে আবারও লাইফ সাপোর্ট দেবার নেন ওই হাসপাতালের পরিচালক বাবু ভাই। লাইফ সাপোর্ট হয়তো দেয়া যাবে কিন্তু সাত আট লাখ টাকার চিকিৎসা করাবে কে? বাবু ভাই প্রথমেই ফোন দিয়েছিলেন আমাকে। অফ এয়ারে থাকায় কিছুই করার ছিল না আমার। ফোন করি আমার সাবেক কয়েকজন কলিগকে। তার উৎসাহ ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার অফিস রাজী হয়নি এই এসাইনমেন্টটি কভার করতে। হয়তো বাণিজ্যের গন্ধ পায়নি তারা। তবে বাবু ভাইর চেষ্টায় কয়েকজন সংবাদকর্মী অবশ্য শেষ পর্যন্ত কবার করেছেন ঘটনাটি কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন বড় ধরণের সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া যায়নি।
সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খাই আমি রাষ্ট্রের আচরণে। গত ০৩ এপ্রিল সাহায্যের আশায় মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের স্ত্রী আবেদন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। সেটি অফিসিয়ালি রিসিভও করা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কারও খোঁজ মেলেনি সেখান থেকে। মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর দপ্তর হয়তো এখানে সাহায্য করার মত পলিটিক্যাল কোন ক্রাইটেরিয়া খুঁজে পাননি। হায়রে রাষ্ট্র..!! তোমার তরে সর্বস্ব দেয়া একজন মানুষের প্রতি তোমার আচরণ দেখে ভেতরে থাকা দেশপ্রেম বেড়িয়ে আসছে ক্ষোভ হয়ে... তুমি সে খবরটিও হয়তো রাখার দরকার মনে কর না!!
কয়েকটি প্রশ্ন রেখে শেষ করতে চাই।
১. আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক বড় একটা লিস্ট আছে, আরো কয়েকলাখ মুক্তিযোদ্ধকে (জানি না আসলেই কাদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা হবে) তালিকাবদ্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। কোন উদ্দেশ্যে?
২. দলীয় পরিচয় না থাকলে কি কোন মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবারের কোন সহায়তা পাবার অধিকার নেই? এটি কি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা? সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধদের পাশে কতখানি সহায়তার (প্রতিদান বলতে চাই আমি, সহায়তা বা ভিক্ষা নয়) হাত বাড়িয়েছে রাষ্ট্র বা সরকার?
৩. প্রতিদিনই খবরের কাগজে বা অন্য কোন উপায়ে আমরা বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবারের দুর্দশার কথা জানছি। সরকার কি আদৌ এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে? জানার উপায় কি?
৪. জনগণ হিসেবে আমাদের ভূমিকা কেমন হওয়া দরকার? আমরা কি রাষ্ট্রকে বাধ্য করব এ বিষয়ে নাকি নিজেরাই যতটুকু সম্ভব করে যাব?
৫. মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর জন্য যে বরাদ্দ তা কি আদৌ তাদের বেঁচে থাকার কোন অবলম্বন হিসেবে ধরা যায়? মাসে দুই হাজার টাকা একটি চার সদস্যের পরিবারের জন্য কতখানি উপযোগী?
সর্বশেষ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করতে আমরা কি সরকারের কাছে জবাবদিহিতা দাবি করব না? কিভাবে করব? এখনও কি সময় আসেনি আমাদের সর্বোচ্চ গর্বের বিষয়টি নিয়ে, আমাদের গর্বের নায়কদের নিয়ে রাজনৈতিক খেলা বন্ধ করতে সচেতন হবার?
আরো অনেক অনেক প্রশ্ন না করেই শেষ করছি।
দ্রষ্টব্য: আমাদের কলমদাদি নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপ আছে। আমিও সেই গ্রুপের সদস্য। কিন্তু তাদের কাজে আমি আপাতত থাকতে পারছি না পেশাগত ব্যস্ততার কারণে। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই একজন সুবিধাবঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধার পাশে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে যাবে। আমরা কেউই পিছিয়ে যাব না...
কোন সাহায্য পাবার আশ্বাস না থাকায় এখনও কোন ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়নি। কিন্তু যারা এগিয়ে আসতে চান তারা যোগাযোগ করতে পারেন.. বাবু ভাই, পরিচালক এডমিন, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ হাসপাতাল, ০১৭১৩৪৪৩৩৩০। অথবা মোঃ আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী খালেদা বেগম, ০১৭৪৩১৫০৬০১।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৪:১২