somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিনা চিকিৎসায় বোধহীন পড়ে থাকে অভিমানী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দেহ... মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাণিজ্য আর রাজনীতির হোলিখেলায় মাতি আমরা... গুমরে কাঁদে দেশমাতৃকা..

০৫ ই এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৪:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭১-এর সম্মুখসমরে নিহত সহযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের লাশ কাঁধে নিয়ে ফেরার সময় কিংবা আরো কয়েকদিন পরে হানাদারের গুলিতে নিজের ডান পা-টি ফেলে আসার সময়ও টাঙ্গাইলের দেওহাটার কোম্পানি কমান্ডার আনোয়ার হোসেন হয়ত ভাবেননি একদিন তিনি বোঝা হয়ে দাঁড়াবেন তারই সর্বস্ব বিলিয়ে এনে দেয়া এক জাতির। ভাবেননি, এখানে জাতির ভবিষ্যৎ নয়, সবাই গড়ে নেয় নিজেদের ভবিষ্যৎ। জাতির ভবিষ্যত গড়তে যারা নিজেদের বিলিয়ে দেয় তার বা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার মত দায় নেই এই জাতির।


আজ থেকে চার দশক আগে ৩০ বছর বয়সে তারুণ্য আর জীবনশক্তির উচ্ছ্বাস নিয়ে শৃঙ্খলিত মাতৃভূমির ডাকে ঘর ছেড়েছিলেন। ভারতে গিয়ে ট্রেনিং শেষ করে দেওহাটা অঞ্চলের কোম্পানি কমান্ডার হেসেবে যুদ্ধ শুরু করেন মো. আনোয়ার হোসেন। মির্জাপুর থানা আক্রমণ করে ছিনিয়ে নেন সেখানকার সব অস্ত্র। পা হারান সম্মুখযুদ্ধে, তারপরও থামাননি যুদ্ধ। স্বাধীন দেশে পঙ্গুত্ব নিয়ে রাষ্ট্রশক্তির কাছে পাননি ভবিষ্যতের কোন নিশ্চয়তা। নিজের হারানো পা নিয়ে যখন জীবন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মত দিন কাটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ জেতা আনোয়ার হোসন। পঙ্গু হয়ে সারাজীবন প্রায় বেকার থেকেছেন তিনি, পৈত্রিক জমিজমা খুইয়ে জীবনগাড়ি ঠেলে এসেছেন এতদিন ধরে। অভাবের তাড়নায় একমাত্র ছেলেকে পড়াশোনা করাতে পারেননি। তারপরও বাস ড্রাইভার ছেলে মিল্টনের কাঁধেই তার সব দায়। ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া দশ বছরের মেয়ে শারমিনের চিন্তায় কখোনোই হয়ত প্রাণ ভরে হাসেননি তার স্ত্রী খালেদা বেগম। হ্যাঁ পেয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন, ছয়মাস পরপর নামমাত্র সম্মানি যা তার কাছে মনে হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ভিক্ষা হিসাবে। করুণার পাত্র হয়ে থাকতে চাননি তিনি। যে দেশকে নিজের সবটুকু দিয়েছেন, তার কাছ থেকে করুণা নিতে একজন বীরের অহমে লেগেছিল হয়তো। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেই ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে কেটে দিয়ে আসেন নিজের নাম।

গত ৩০ মার্চ, আমাদের দেশপ্রেম আর স্বাধীনতাপ্রীতি দেখানোর কয়েকটি উপলক্ষসম্বলিত মাসের শেষ দিকেই হঠাৎ স্ট্রোক করেন তিনি। বিশ হাজার টাকার পারিবারিক সম্বল নিয়ে তার স্বজনেরা রওনা হন ঢাকায়, ভর্তি করান জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে। দু'দিন পরেই ফুরিয়ে যায় টাকা, লাইফ সাপোর্ট দেয়ার বিরাট খরচ বইতে পারবার আশঙ্কায় হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে, রাস্তাতেই মৃত্যু হবে জেনেও রওনা দেন বাড়ির পথে। আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী নিজেই যেমনটি বললেন, '' জানি মারা যাবেন আমার স্বামী, কিন্তু কি করব? প্রতিদিন দশ হাজার টাকা খরচ করার সামর্থ নেই আমাদের। তাই রওনা দিয়েছিলাম, বাড়ি গিয়ে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা তো করতে হবে।''

রোগীর ফাইলে মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র দেখে রাস্তা থেকে তাদের ফিরিয়ে এনে আবারও লাইফ সাপোর্ট দেবার নেন ওই হাসপাতালের পরিচালক বাবু ভাই। লাইফ সাপোর্ট হয়তো দেয়া যাবে কিন্তু সাত আট লাখ টাকার চিকিৎসা করাবে কে? বাবু ভাই প্রথমেই ফোন দিয়েছিলেন আমাকে। অফ এয়ারে থাকায় কিছুই করার ছিল না আমার। ফোন করি আমার সাবেক কয়েকজন কলিগকে। তার উৎসাহ ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার অফিস রাজী হয়নি এই এসাইনমেন্টটি কভার করতে। হয়তো বাণিজ্যের গন্ধ পায়নি তারা। তবে বাবু ভাইর চেষ্টায় কয়েকজন সংবাদকর্মী অবশ্য শেষ পর্যন্ত কবার করেছেন ঘটনাটি কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন বড় ধরণের সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া যায়নি।

সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খাই আমি রাষ্ট্রের আচরণে। গত ০৩ এপ্রিল সাহায্যের আশায় মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারের স্ত্রী আবেদন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। সেটি অফিসিয়ালি রিসিভও করা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কারও খোঁজ মেলেনি সেখান থেকে। মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর দপ্তর হয়তো এখানে সাহায্য করার মত পলিটিক্যাল কোন ক্রাইটেরিয়া খুঁজে পাননি। হায়রে রাষ্ট্র..!! তোমার তরে সর্বস্ব দেয়া একজন মানুষের প্রতি তোমার আচরণ দেখে ভেতরে থাকা দেশপ্রেম বেড়িয়ে আসছে ক্ষোভ হয়ে... তুমি সে খবরটিও হয়তো রাখার দরকার মনে কর না!!

কয়েকটি প্রশ্ন রেখে শেষ করতে চাই।
১. আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক বড় একটা লিস্ট আছে, আরো কয়েকলাখ মুক্তিযোদ্ধকে (জানি না আসলেই কাদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা হবে) তালিকাবদ্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। কোন উদ্দেশ্যে?
২. দলীয় পরিচয় না থাকলে কি কোন মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবারের কোন সহায়তা পাবার অধিকার নেই? এটি কি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা? সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধদের পাশে কতখানি সহায়তার (প্রতিদান বলতে চাই আমি, সহায়তা বা ভিক্ষা নয়) হাত বাড়িয়েছে রাষ্ট্র বা সরকার?
৩. প্রতিদিনই খবরের কাগজে বা অন্য কোন উপায়ে আমরা বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবারের দুর্দশার কথা জানছি। সরকার কি আদৌ এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে? জানার উপায় কি?
৪. জনগণ হিসেবে আমাদের ভূমিকা কেমন হওয়া দরকার? আমরা কি রাষ্ট্রকে বাধ্য করব এ বিষয়ে নাকি নিজেরাই যতটুকু সম্ভব করে যাব?
৫. মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর জন্য যে বরাদ্দ তা কি আদৌ তাদের বেঁচে থাকার কোন অবলম্বন হিসেবে ধরা যায়? মাসে দুই হাজার টাকা একটি চার সদস্যের পরিবারের জন্য কতখানি উপযোগী?
সর্বশেষ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করতে আমরা কি সরকারের কাছে জবাবদিহিতা দাবি করব না? কিভাবে করব? এখনও কি সময় আসেনি আমাদের সর্বোচ্চ গর্বের বিষয়টি নিয়ে, আমাদের গর্বের নায়কদের নিয়ে রাজনৈতিক খেলা বন্ধ করতে সচেতন হবার?

আরো অনেক অনেক প্রশ্ন না করেই শেষ করছি।

দ্রষ্টব্য: আমাদের কলমদাদি নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপ আছে। আমিও সেই গ্রুপের সদস্য। কিন্তু তাদের কাজে আমি আপাতত থাকতে পারছি না পেশাগত ব্যস্ততার কারণে। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই একজন সুবিধাবঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধার পাশে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে যাবে। আমরা কেউই পিছিয়ে যাব না...
কোন সাহায্য পাবার আশ্বাস না থাকায় এখনও কোন ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়নি। কিন্তু যারা এগিয়ে আসতে চান তারা যোগাযোগ করতে পারেন.. বাবু ভাই, পরিচালক এডমিন, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ হাসপাতাল, ০১৭১৩৪৪৩৩৩০। অথবা মোঃ আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী খালেদা বেগম, ০১৭৪৩১৫০৬০১।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৪:১২
৯টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×