বছর দুয়েক আগের ঘটনা। সহকর্মীর বিয়ের প্রীতিভোজ খেয়ে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছিল। হালকা শীতের রাত। রাস্তাঘাট এক্কেবারে শুনশান। ট্রেন থেকে নেমে আরও দুকিমি গেলে তবেই আমার বাড়ি। রাত-বিরাতে এই দুকিমি রাস্তা ফেরার জন্য খুবই চিন্তায় থাকি। সেদিন অবশ্য ট্রেন থেকে নেমে সাথেসাথে অটো পেয়ে যাই। অটোতে ওঠার সময় চালক জানিয়ে দিল,
-দাদা এখন কিন্তু রুটের গাড়ি নয়, ভাড়া বেশি লাগবে।
আমি কোনরকম অমত না করে মাথা নেড়ে সম্মতি দেই। ঘাড় নিচু করে গুটিসুটি মেরে অটোর মধ্যে বসে পড়ি। দেখতে দেখতে পাঁচ জন যাত্রী হয়ে গেল। সবাইকে ও একই কথা শোনাল। শেষ মূহুর্তে হাতে খৈনি ঘষে মুখে পুরে অটো চালাতে লাগলো। জানিনা চালক আগেই কিছু খেয়েছে কিনা।গাড়িটা যেন চলছেই না। পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখেছি তাড়া থাকলে আমার ক্ষেত্রে এমনটি হয়। সবকিছুই হবে ধীরে ধীরে। দুকিমি রাস্তা! অথচ কখন বাড়ি পৌঁছাব তা ভেবে রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠি। রাস্তা যেন শেষই হচ্ছে না। একজন নামে তো কিছু দূরে আরেকজন উঠে পড়ে।অটোটার বেগও তেমনই কেন্নোর মতো।ভেবে অবাক হই, এত রাতেও বা লোকজনের কি এমন কাজ থাকতে পারে। নাকি সবাই আমার মতো বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান খেয়ে ফিরছে। বারবার লোকজনের ওঠানামার মধ্যে কিছুটা ঝিমুনি ভাব চলে আসে। এমন সময় অটোচালকের,
-দাদা নামুন। মালঞ্চ চলে এসেছে...বলাতে,
ধরফর কর সোজা হয়ে কিছুটা লজ্জিত হয়ে তড়িঘড়ি অটো থেকে নেমে আসি। ওর দাবি মতো ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা চালালাম। মাথার উপরে উজ্জ্বল আলো। কিন্তু রাস্তার উপরে যখন তার প্রভা আসছে বেশ আবছা আবছা লাগছে। এহেন আবছা আলোয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কাটা দেখতে পেলাম না।কব্জিটিকে একেবারে চোখের সামনে এনে দেখি এগারোটার বেশি হয়ে গেছে। চারিদিক একটু ফালুক-ফুলুক করে কোথাও কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন পেলাম না। উপরে আবারো তাকালাম, মাথার উপরে সুদৃশ্য ল্যাম্পপোস্টের এলইডি আলো যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে।যেন আমার ফেরার জন্যেই সে এতক্ষণ প্রতীক্ষায় ছিল। কি অসম্ভব মায়াবী পরিবেশ।এক ভালোলাগার আবেশে মনটা ভরে গেল।শেষ কবে এমন নির্জন রাস্তায় হেঁটেছি মনে করতে পারলাম না। এমন নিস্তব্ধ নিশীথের অপরূপ শোভায় নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো। হাঁটতে হাঁটতে উপরে আবারো একবার তাকিয়ে দেখি এলইডির আলোকে ঘিরে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজারো ঝিঁঝিঁ পোকা হিন্দোল করছে। মনে মনে ভাবছি হাই ভোল্টেজের আলোর পাশে থেকেও কি ভয়ানক ফুর্তি ওদের মনে। পাশাপাশি ভাবনায় এলো, রাত তো বেশি নয়; অথচ দুটো আড়াইটার মত নিস্তব্ধ নিশুতি মনে হচ্ছে।
ঠিক দুশো মিটার এগিয়ে যেতেই ঘটলো এক ভয়ানক ঘটনা। একসঙ্গে চার পাঁচটা কুকুর বাঘের মত ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে এলো। অথচ একটু আগেও পর্যন্ত আমি ওদের গতিবিধি একেবারেই বুঝতে পারিনি। হঠাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে একটা পাঁচিলের দিকে পিঠ করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সবগুলো একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো।একটা তো একদম আমার সামনে এসে ডাকতে লাগল। পারলে যেন এখনই কামড়ে দেয়। কি ভয়ানক পরিস্থিতি! ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। এখন কি করে রেহাই পাব তা মাথায় আসছে না। হঠাৎ মাথার মধ্যে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে নিচু হয়ে পায়ের একপাটি জুতা খুলে হাতে নিতেই ওরাও একলাফে অনেকটা পিছিয়ে গেল। তবে ওদের আচরণ দেখে মনে হল যেন আগুনে ঘৃতাহুতি পড়েছে। আরও জোড়ে গগনভেদী চিৎকারে ডাকতে লাগল। ওদের এত চিৎকারেও একজনকেও বাইরে বার হতে দেখলাম না। উল্লেখ্য নিজের বাড়ির রাস্তায় যে এতটা বিপদের মুখে পড়তে হবে তা কস্মিনকালেও ভাবিনি। যাইহোক হাতে একপাটি জুতো নিয়ে এবার ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম।ওরাও আমার দিকে ঘেউঘেউ করতে করতে পিছাতে লাগলো। এমন সময় একটু দূরে ঝপাং করে কিসের একটা শব্দ হতেই সবগুলো কুকুর ছুটে গেল সে দিকে। আমিও যেন এতক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।গলাটা কেমন যেন আটকে গেল। বুঝলাম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কিন্তু কপালে রীতিমতো ঘাম অনুভব করলাম। ওদিকে ওদের পশ্চাদগমন লক্ষ্য করে বুঝলাম সম্ভবত একটা বিড়ালকে ওরা ধাওয়া করেছে। আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই ভেবে এক ছুটেই ঘরে ঢুকে গেলাম। হালকা শীত হলেও জলে হাত দিয়ে দেখলাম বেশ ঠান্ডা। কোনোক্রমে হাতমুখ ধুয়ে শুতে শুতে সেদিন প্রায় রাত বারোটা বেজে যায়।
ঘুম নিয়ে আমার একেবারে দুশ্চিন্তা নেই। বরাবরই একবার চোখ বন্ধ করলে দু-চার মিনিটেই চলে যাই স্বপ্নের দেশে। সেদিনও যথারীতি শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে যাই। বেশিক্ষণ ঘুমায়নি এমন সময় বাইরে প্রচণ্ড চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায়। এমন কাঁচা ঘুম ভাঙাতে বিরক্তিতে উঠে বসে রইলাম। বসে বসে চেঁচামেচির উৎস স্থল অনুমানের চেষ্টা করতে লাগলাম। ক্রমশ চিৎকারের প্রাবল্য বাড়তে লাগলো। আর বসে থাকতে না পেরে পাশে রাখা চাদরটি গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার ঠিক তিনটি বাড়ি পরে রহমান সাহেবের বাড়ি। ওনার বাড়ির সামনেই দেখলাম গোটা পাড়ার লোক জড়ো হয়েছে।। ওনার স্ত্রীকে সবাই গোল করে ঘিরে আছে। এক ঝলক রহমান সাহেবকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। আশপাশে কোথাও ওনার টিকি পেলাম না। তবে ভদ্রমহিলাকে দেখলাম কোমরে কাপড় গুঁজে আঙ্গুল উঁচিয়ে কি সব বলছেন। ওনার শরীরি ভাষাতে যুদ্ধংদেহী মনোভাব লক্ষ্য করলাম। মাথা নিচু করে ঘটনা কি বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। তবে বিষয় বস্তু না বুঝলেও চিৎকার-চেঁচামেচিই কানে বেশি ঠেকলো। হঠাৎ করে উনি কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। সাথে সাথেই বসে হাত-পা ছেড়ে দিলেন। উপস্থিত লোকজন ছোটাছুটি শুরু করলো। কয়েকজন মহিলা হাত ধরাধরি করে ওনাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। খারাপ লাগছে ওনার হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে। তবে এমন দ্বিমুখী অভিব্যক্তির কিছুই মাথায় ঢুকলো না। ঘটনা যাই ঘটুক এটা যে অনেক পুরানো সেটা অবশ্য বুঝতে পেরেছি। এমতাবস্থায় কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না ভেবে আমি আরো কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে আশপাশের লোকজনের কথা বোঝার চেষ্টা করলাম। এমন সময় পাশে দাঁড়ানো একজনের ফোন বেজে উঠলো। কথা শেষ হতেই সময় জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর দিল,
-দুটো বেজে দশ মিনিট হয়েছে।
পরেরদিন সকালে যেকরেই হোক ঘটনাটা জানার চেষ্টা করবো ভেবে স্থান ত্যাগ করলাম।
২
রহমান সাহেব অত্যন্ত সজ্জন মানুষ।এই ঘটনার বছর দুয়েক আগে মামা বাড়ীর সৌজন্যে পাড়াতে স্থায়ীভাবে বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করতে শুরু করেন। আগে বাড়ি ছিল প্রজার হাটের বেদান্ত পাড়ায়। পৈত্রিক বিষয়-আশয় যথেষ্ট ছিল।কিন্তু বাপ-ঠাকুরদার চৌদ্দপুরুষের কৃষিকাজ পেশা ছেড়ে বিকল্প কিছু খুঁজে না পেয়ে ও নগরায়নের থাবাতে জমি জায়গা দখলে রাখতে না পেরে কিছুটা বাধ্য হয়েই ওখানকার বিষয়-আশায় বিক্রি করে মাতুলালয়ে চলে এসেছেন। এখানে এসে শুরু থেকেই উনি ইমারতি দ্রব্যের ব্যবসা করতেন। অল্পদিনের মধ্যে একজন সম্পন্ন ব্যবসায়ী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে উনার যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। বেশ প্রাণবন্ত ও দিলখোলা মানুষ ছিলেন।দেখা হলে দুচারটে কথা না বলে খালি মুখে যেতেন না। পাড়ায় রক্তদান উৎসব থেকে শুরু করে যেকোনো সামাজিক কাজে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এহেনো রহমান সাহেবকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যাওয়াতে এলাকাবাসী হতবাক। হতবাক আমি নিজেও...
৩
মাতুলালয়ে আসা নিয়ে উনি নাকি কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ছিলেন। প্রজার হাটে পৈত্রিক বাড়িতে থাকাকালীন বিকল্প পেশা খোঁজার চেষ্টার কসুর করেননি। প্রথমদিকে জমি জায়গা বেচাকেনা বা মধ্যস্থতার মধ্য দিয়েই দিন কাটতো।কিন্তু ক্রমশ দালালের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এলাকা দখলের জন্য শুরু হয় এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কয়েকজন বন্ধু মিলে খুলে ফেলেন একটা সিন্ডিকেট। লোকাল পার্টি অবশ্য এসময় যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিল।
সিন্ডিকেট ব্যবসা প্রথম দিকে বেশ ভালো চলছিল। পার্টি ও থানায় মাসোহারা দিয়ে এলাকায় কয়েক জনকে হাত করে অল্প দিনেই ব্যবসাটা বেশ বেড়ে যায়।উনার এই হঠাৎ শ্রী বৃদ্ধিতে আশপাশের অন্যান্য সিন্ডিকেটের সঙ্গে শুরু হলো আবার এক প্রতিযোগিতা। ব্যবসায় পেরে উঠতে না পেরে তারা বাঁকা রাস্তা ধরল।বেশ কয়েকজন নিজেদের করুন অবস্থা তুলে ধরে রহমান সাহেবের কাছে বড় মালের অর্ডার দিল। এতদিন যারা শত্রুতা করে আসছিল তাদের মাধ্যমে অর্ডার পেয়ে রহমান সাহেবও ভুলে গেলেন পুরানো শত্রুতার কথা। কিন্তু অর্ডার মতো সাপ্লাই করলেও টাকা পেলেন না। বুঝতে পারলেন শত্রুরা রূপ বদল করেছে।অথচ তিনি ধরতে পারেননি। লোকাল পার্টি, বন্ধুদের ধরেও কিছু আদায় হলোনা। ওদিকে উপর থেকে মহাজনের চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। চাপ সামলাতে না পেরে এক সময় গোলার ঝাপ বন্ধ করে গা ঢাকা দিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। একদিন হাতেনাতে মহাজনের কাছে ধরা খেয়ে নির্দিষ্ট দিনে ওনাকে বকেয়া টাকা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন।
৪
ঘটনার পর স্বামী-স্ত্রী সম্পূর্ণ দিশাহারা। প্রত্যেকটি রাতেই চোখের পাতা এক করতে পারেননা। পরিচিতি প্রতিবেশীদের সামনেও পারতপক্ষে বার হন না। নিজেদেরকে একপ্রকার স্বেচ্ছাবন্দি করে রেখেছেন। খাওয়া-দাওয়াও দিয়েছেন এক প্রকার তুলে। হঠাৎই একদিন রাতে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই কুলসুম বিবি বলে ওঠেন,
-আচ্ছা আমাদের তো এখানে আট কাঠা জমি আছে। আমরা যদি অল্প কিছু বিক্রি করি তাহলে তো পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সামাল দিতে পারি।
স্ত্রীর মুখে জমি বাড়ি বিক্রির কথা শুনে চোখেমুখে একপ্রকার হতাশা নিয়ে রহমান সাহেব ধমকের সঙ্গে বলে ওঠেন,
-না না। বাপ-দাদার সম্পত্তি যদি বিক্রি করি তাহলে আমাদের উপর অভিশাপ নেমে আসবে। ওসব কথা মুখেও এনো না।
-তাহলে অন্য কোন উপায় তো আর সামনে দেখতে পাচ্ছি না।
-একটা উপায় অবশ্য আছে যদি তুমি মত দাও....
-কি উপায়?
-তোমার আব্বাকে গিয়ে যদি আমাদের অবস্থা খুলে বল, তাহলে উনি যদি কিছু একটা করতে পারেন..
-না না ওসব পারব না।আব্বার দেওয়া গয়নাগাটি ইতিমধ্যে সব তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। এখন কিছু বলতে গেলেই আব্বা সেগুলোর খোঁজ করবে।আর তুমি একটা কি মানুষ বলোতো? কিছু হলেই শুধু বাপের বাড়ি বাপের বাড়ি বলো।শোন একটা কথা পরিষ্কার বলে দেই, আমার বাপের বাড়ি নিয়ে আর কোন দিন একটা কথাও মুখে আনবে না, বলে দিলাম।
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে মুখ ঝামটা দিয়ে কুলসুম বিবি সেই যে গেলেন পাশের ঘরে, আর সারারাত স্বামীর কোন খোঁজ করলেন না।
এদিকে মহাজনের নির্দিষ্ট করার দিন ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলো। রহমান সাহেব দিশাহারা, আপাতত উদ্ধারের রাস্তা কি।
৫
স্ত্রীর কথাতে প্রথমে সম্মত না হলেও পরে রহমান সাহেব বুঝলেন আপাতত জমি বিক্রয় করা ছাড়া আর কোন রাস্তা নাই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই রাজী হয়ে গেলেন। খুব দ্রুত পার্টিও পেয়ে গেলেন। অত্যন্ত গোপনে দুই কাঠা জমি বিক্রি করে আপাতত সমস্যার মোকাবিলা করলেন। অনেকদিন ধরে পড়ে থাকা বকেয়া টাকা পেয়ে মহাজন খুব খুশি। তিনি আবার আগের মত মাল সরবরাহ করতে রাজি হলেন। রহমান সাহেবের গোলার ঝাঁপ আবার খুলল।
বেশ কয়েকদিন গোলা খুললেও ব্যবসা কেমন যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। বুঝলেন, নাহা! এইভাবে ব্যবসা করার কোন মানে হয় না।গোলায় যদি পর্যাপ্ত মাল তোলা না যায় তাহলে এমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ব্যবসা করার কোন যুক্তি নেই। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। আবার গোপনে গোপনে খরিদ্দার খুঁজতে লাগলেন। এলাকায় উন্নয়নের জোয়ার এসেছে। নগরায়নের ফলে শহর ক্রমশ এগিয়ে আসছে।তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এলাকায় জমির দাম।জমির চাহিদাও তুঙ্গে।যার হাতে কিছু জমি আছে সে এখন রাজা। তবে লোকজনও বসে নেই।কাড়িকাড়ি টাকা নিয়ে বসে আছে। কাজেই পছন্দ মতো খরিদ্দার পেতে রহমান সাহেবের অসুবিধা হল না। এবার বিক্রি করলেন একসঙ্গে চার কাঠা জমি। জমি বেচার টাকায় সংসারের জৌলুস ফিরল। রহমান সাহেব-কুলসুম বিবির সংসারের অভাব কেটে গেল। নতুন করে তিনি ব্যবসায়ে মন দিলেন। মনের-মতো করে গোলাটাকে ঢেলে সাজালেন। কিছু টাকা দিয়ে বাড়িটাকেও ঠিক করালেন। ব্যবসা আবার চলতে থাকলো রমরমিয়ে। রহমান সাহেব দিলদার প্রকৃতির মানুষ।যারা প্রথমে ওনার টাকা আটকে রেখেছিল অল্পকিছু উদ্ধার করে তিক্ততা ভুলে তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই পাড়াতে হৃত সম্মান ফিরে পেলেন। তার এই ভাগ্য পরিবর্তনে বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। স্ত্রীর পরামর্শেই যে তার পরিবর্তনের সহায়ক হয়েছে সে কথা তিনি ঘনিষ্ঠমহলে স্বীকার করলেন।
৬
রহমান সাহেবের গ্রেপ্তারের পর গোটাপাড়া থেকে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভাবে থানায় ধর্ণা বা অবস্থান কর্মসূচি নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।এমন একজন মুসল্লির অহেতুক পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে শুক্রবার নামাজ শেষে আলাদাভাবে দোয়া করা হয়েছে।প্রায় প্রত্যেকেরই মুখে মুখে যখন ওনার নিপীড়নের খবর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ঠিক তখনই ঘটনার তৃতীয় দিনে পুলিশ ওনার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গেলে সামগ্রিকভাবে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জনতার পক্ষে আর ধৈর্য ধরা সম্ভব হলো না। পরের দিন সকলে মিলে থানায় গিয়ে অহেতুক পুলিশি হেনস্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন বলে ঠিক হলো।আর সেদিনই অর্থাৎ ঘটনার চতুর্থ দিন সকাল দশটা নাগাদ দু গাড়ি পুলিশ রহমান সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে সোজা কবরস্থানের দিকে অগ্রসর হতেই উৎসুক্য জনতা জোয়ারের স্রোতের ন্যায় ছুটে আসতে লাগলো। এক সময় পুলিশকে লাঠি উঁচিয়ে গ্রামবাসীর দিকে তেড়ে যেতে হলো।
৭
পুলিশের ভাষ্যমতে রহমান সাহেবের মায়ের স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই ওনারা ওনাকে গ্রেপ্তার করেছেন।ঘটনার চতুর্থ দিনে স্বামীকে সহযোগিতা করার অভিযোগে স্ত্রীকেও গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। কাজেই অভিযোগ গুরুতর। দু বছরের পুরানো কবর। পুলিশ অত্যন্ত সন্তর্পনে খোঁড়াখুঁড়ি করছেন। উৎসুক্য জনতার সঙ্গে আমি নিজেও আরও কিছুটা কাছে এগিয়ে গেলাম। পুলিসকর্মীরা আবার লাঠি উঁচু করতেই দিলাম এক ছুট। তবে কানাঘুষো যেটা জানতে পারলাম।
প্রজার হাটে থাকাকালীন শেষের দিকে মায়ের সঙ্গে নাকি রহমান সাহেবের প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি হত। ওনার একের পর এক এই জমি বিক্রিকে মা মেনে নিতে পারছিলেন না। তানিয়ে মা-ছেলে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত। একদিন রাগের বশে মাকে গলা টিপে ধরলে শ্বাসকষ্টে উনি মারা যান। স্বামী-স্ত্রী ও কাজের মাসি ছাড়া ঘটনার কথা কেউ জানতো না।মাকে হত্যা করার পর আসন্ন পুলিশি ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে কাজের মাসিকে একটা বড় অংকের টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করেন। পাশাপাশি বাবার জীবদ্দশায় যে মামাদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে গিয়েছিল, এক্ষণে মা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে প্রচার করে মামাদের সাহায্য প্রার্থী হলে তারা অবশ্য ভাগনার পাশে এসে দাঁড়ান। মামাদের সাহায্যার্থে ভালই ভালই মায়ের সৎকারের ব্যবস্থা করেন।
অথচ আমরা এতদিন ওনার অসম্ভব মাতৃভক্তির কথা জেনে এসেছি। জেনে এসেছি উনি মামাদেরকে প্রচন্ড মিস করতেন। কিন্তু সেদিন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
এই কেসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কাজের মাসি ফজিলা বিবি। তার স্বামী খোদা বক্সের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল ছিলনা। কিন্তু হঠাৎ হাতে অনেকটা টাকা এসে যাওয়াতে গ্রামে গিয়ে স্বামীকে দোকান করে দেওয়াতে আবার সম্পর্ক জোড়া লাগে। তবে হঠাৎ করে এতগুলো টাকার উৎস কি?- স্বামীর প্রশ্নে একসময় ফজিলা বিবি সত্য কথা বলে ফেলে। খোদা বক্স আগে নেশা ভাং করত। এসব নিয়ে প্রতিবাদ করাতে প্রায়ই স্ত্রীকে ধরে মারধোর করত। কিন্তু বর্তমানে স্ত্রীর সৌজন্যে আয়ের পথ বার হওয়াতে এখন একটু সমীহ করে চলে। পাশাপাশি আর আগের মত প্রকাশ্যে মদ্যপান করে না। যদিও ফজিলা বিবির আড়ালে আবডালে একটু-আধটু করে বৈকি। হাজার হোক পুরানো অভ্যাস তাকে কি ছাড়া যায় কখনও।
রহমান সাহেবের গ্রেপ্তারের কয়েকদিন আগে খোদা বক্সের আবার টাকার দরকার পড়ে।সে নাকি ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার স্ত্রীকে বলেছে রহমান সাহেবের কাছে গিয়ে কিছু টাকা সাহায্য চাইতে।কিন্তু ফজিলা বিবি বারেবারে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এমতাবস্থায় খোদা বক্স নিজেই চলে আসে রহমান সাহেবের বর্তমান ঠিকানায়। অপরিচিত খোদাবক্সকে রহমান সাহেব পাত্তা দেননি। দু বছর আগেকার ঘটনা নিজেকে নিরাপদ ভেবে খোদা বক্সকে একপ্রকার তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। টাকা না পেয়ে ক্ষিপ্ত খোদা বক্সের মধ্যে নীতিবোধ মাথাচাড়া দেয়।যার পরিপ্রেক্ষিতে সস্ত্রীক রহমান সাহেবদের সেসময় পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল।
৮
আমি একজন বেসরকারি ব্যাংকের লোন সেকশনের সেলস এক্সিকিউটিভ। ডোর ব্যাংকিং এর সুবিধা পাইয়ে দিতে আমাকে প্রতিনিয়ত কলকাতা শহরতলীর বিভিন্ন গ্রাহকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হয়। আমার অফিস ক্যামাক স্ট্রীটে। অফিসের কাজ মিটিয়ে ফিল্ড ওয়ার্কের উদ্দেশ্যে আজই পড়ন্ত বেলায় শিয়ালদা স্টেশনে এলাম। এবার গন্তব্যস্থল মধ্যমগ্রাম। কিন্তু শিয়ালদা স্টেশনে এসে দেখলাম ট্রেনের গন্ডগোল। কাতারে কাতারে লোক স্টেশন চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে। তিল ধারণের জায়গা নেই। অফিসে ফোন দিলাম, আজকের মত কাজটি মুলতুবি রাখতে। এমন সময় এক সান্ধ্য দৈনিকের পেপার বিক্রেতা চিৎকার করতে করতে এগিয়ে এলো,
-দারুন খবর! দারুন খবর! কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে, বলে জোরে জোরে চিৎকার করছে।
হাত বাড়িয়ে একটাকা দিয়ে পেপারটি নিতেই চমকে উঠলাম।
একি! ফ্রন্ট পেজে রহমান সাহেবের ছবি!
হেডলাইনে লেখা,"মাতৃ হত্যার অভিযোগে স্বামী-স্ত্রীর কারাবাস।"
পেপারের ভাষ্য অনুযায়ী,
প্রজার হাটের বাসিন্দা রহমান সাহেব একের পর এক জমি বিক্রি করাতে মায়ের সঙ্গে বিরোধের সূত্রপাত হয়। একটা জমিকে নিয়েই মূলত মা-ছেলের দ্বন্দ্ব।বাবার কবরস্থানের পাশে মা নিজেকে সমাধিস্থ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ছেলে প্রবল আপত্তি করে। বাবার কবর সহ ঐ দু কাঠা জমিটি রাস্তার ধারে অবস্থিত হওয়ায় তার বাজার মূল্য ছিল আকাশছোঁয়া। রহমান সাহেবের পাখির চোখ ছিল এই জমিটির প্রতি। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল বাবার কবরটি। লক্ষ্য ছিল বাবার কবরটিকে সময়মতো অন্যত্র সরিয়ে নেবেন। কাজেই নুতন করে মায়ের ইচ্ছাকে সম্মান দিয়ে ওখানে কবরস্থ করা ছিল ওনার কাছে অকল্পনীয়।মাকে সমস্ত রকম ভাবে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে গুণধর পুত্র পৃথিবী থেকে মাকে সরিয়ে দিয়ে নিজ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেন। আদর্শ সন্তানের নজির গড়তে মৌলভীর পরামর্শে বাবার কবরের হাড়গোড় নিয়ে মামাদের জমিতে মায়ের কবরের পাশে কবরস্ত করালেন। মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল কিনা বাবার পাশে থাকবেন...,
ফরেনসিক রিপোর্টে মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রমাণিত হলো। রহমান সাহেব দোষী সাব্যস্ত হলেন।
কোর্টের রায় অনুযায়ী মাতৃ হত্যার অভিযোগে উনাকে যাবজ্জীবন ও স্ত্রীকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ হল।
খবরটি পড়ে মাথা ঘুরে গেল। প্লাটফর্মে বসে পড়লাম। কেবলি মনে হতে লাগলো,আজ থেকে চার বছর আগে গ্রামে এসে উনি বাবা-মায়ের নামে ঘটা করে কলেমাখানি করে গোটা গ্রামকে খাইয়েছিলেন। সেদিন আমিও ছিলাম নিমন্ত্রিত। অথচ পাড়ায় থাকাকালীন এত বছরে লোকটাকে চিনতেও পারি নি এতটুকু...
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-চলমান সিরিজ 'ফ্রম সাতক্ষীরা টু বেলগাছিয়া'র পূর্বের বা আগামীর পর্বগুলো পড়ার জন্য প্রিয় পাঠকবৃন্দকে অনুরোধ রইল।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:০৯