অসম্ভব চুলকানো তো আগে থেকেই ছিল। তার সঙ্গে এক একটা দিনে নতুন নতুন উপসর্গ শরীরে দেখা দেয়। মনে হয় যেন প্রত্যেকটা দিনের প্রতিটি মুহূর্তে আমার শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। মাত্র কদিন আগেই যে আমি মরতে চেয়েছিলাম, সারাক্ষণ কেবল মরার কথা ভেবে গেছি; বাস্তবে সেই মরা যে কত কঠিন, কত কষ্টের যন্ত্রণার তা হাড়ে হাড়ে টের পাই। কিছুদিন আগেও যেমন সারাদিন এক প্রকার না খেয়েই কাটাতাম। খিদে পেলেও না খেয়ে খেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। যা পরে এক প্রকার সয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এসময়ে সারাক্ষণ বমি বমি ভাব আমাকে দেহমনে শেষ করে দিয়েছিল। অথচ এমন কিছু যে পেটে থাকতো তা নয়।ক্ষুধা পেট একপ্রকার খালিই থাকতো বলা চলে। সামান্য কিছু মুখে দিলেও বমি আবার না দিলেও বমি; কিছুতেই বমি বমিভাব বন্ধ হচ্ছিলো না। কখনোবা এর তীব্রতায় পেটের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত সব বেরিয়ে আসতে চাইতো। মনে হতো চোখ দুটি যেন কোটর থেকে বেরিয়ে এলো বলে। সঙ্গে থাকতো অদ্ভুদ একটা ঘোরলাগা। বমির আচ্ছন্নতা মাঝে মাঝে এমন আকার ধারণ করেছিল যে চোখে কিছু দেখতে পেতাম না। সবকিছু ঘোলাটে ঘোলাটে লাগতো।
এদিকে আমার শরীরের অবস্থা যত খারাপ হতে থাকে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মুজাহিদদের আগমন। একদিনের জন্যও ঘর খালি থাকতো না। নিত্যনতুন মুজাহিদের আগমনে আমার গায়ে জ্বালা দিত। অথচ হাজারো অসুবিধার মধ্যেও যা মেনে নিতে আমি বাধ্য ছিলাম। পরের দিকে অবশ্য বুঝেছি ওরা আসতো ওদের দরকারে। বাড়তি পাওনা ছিল আমার এই পোড়া শরীরটি।আসা যাওয়ার পথে এই ছিবড়ানো শরীর থেকে তাই ওরা ফায়দা লুটতে কসুর করতো না। অবশ্য এর মধ্যে যে সময় আমি চূড়ান্ত অসুস্থ হই তার আগের দুজন মুজাহিদ আমাকে স্পর্শ করেনি। হয়তোবা আমার অবস্থা দেখে তাদের পাশে ঘেঁষেতে মন সায় দেয়নি।
ঘটনার দিন সকাল থেকেই মারাত্মক অস্বস্তি হতে থাকে।সেদিনের অবস্থা ছিল বর্ণনাতীত। সকালে কোনো এক সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাই। আঁধা আঁধা ঘোরের মধ্যে থাকায় বুঝতে পারি যে আমি পড়ে গেছি। তারই মধ্যে মনে হয়েছিল আমি চেষ্টা করেছি সোজা হয়ে বসতে কিন্তু কিছুতেই সোজা হতে পারছিলাম না। সঙ্গে একটা মারাত্মক ব্যথা অনুভব করি। উল্লেখ্য ওঠার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারি ব্যথাটা কোমরের নিচে কোনো একটা জায়গা থেকেই হচ্ছে। দুর্বল শরীরে টলতে টলতে আধা ঘোরে বিকল্প পথে মেঝেতে হাত দিয়ে উঠতে গিয়ে পড়ি আরেক ফ্যাসাদে। পরনের কাপড় চোপড় ভেজা ভেজা লাগে।হাত লাগতেই চিটচিটে ভাবের সঙ্গে একটা আঁশটে গন্ধ বিশ্রীভাবে নাকের দরজায় এসে আঘাত করতে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে যেন ঘোর কেটে যায়। অথবা দপ করে জ্বলে ওঠা প্রদীপের আলো নিভে যাওয়ার মতই হঠাৎ রক্ত ও রক্তের গন্ধ আমার সব শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়। আমার চিন্তাশক্তি যায় থমকে। পরের ঘটনা আমার আর মনে নেই।
কোনো এক সময় আবার কিছু ফিসফিসানি আমার কানে আসে। চোখ মেলে দেখি তিন চারজন লোক আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে জিজ্ঞাসা; যেন আমাকে কিছু জানতে চায়। একেতো শরীরের শক্তি হীনতা সঙ্গে দুর্বোধ্য ভাষার কারণে আমি আবার চোখ বন্ধ করি। যেন আমি কোনো মৃত্যু পথের যাত্রী। কারা যেন আমাকে পথ দেখাতে এগিয়ে এসেছে। তাদেরই ফিসফিসানি শুনছি আর কার্যকলাপ দেখছি। তবে সে চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, দৃশ্যপট শূন্য। তারা আমার পা নাড়িয়ে দিচ্ছে অথচ সে পায়ের ভর মাপার সামর্থ্য আমার নেই। আমি যেন সত্যিই মরে গিয়ে শূন্যে ভাসতে থাকি।
এক সময় আমার ঘোরলাগা বলা ভালো মরে যাওয়া দশা কেটে যায়। তবে একটু জ্ঞান ফিরে পেতে সারা গায়ে অসম্ভব ব্যথা অনুভব করি। চোখ মেলি ঠিকই কিন্তু ব্যথায় কঁকিয়ে কঁকিয়ে উঠছিলাম। হাজারো যন্ত্রণা সত্ত্বেও ঘরের মধ্যে একটা তীব্র আলোর উপস্থিতি টের পাই। দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে বাইরের সূর্যের সেই আলো ঘরে ঢুকছে। সোনালী সে আলো কিছুটা হলেও মনের নিঃসঙ্গতা দুর করে।পাশে চোখ যেতেই দেখি লম্বা দাঁড়িওয়ালা একজন লোক হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। খানিক বাদে মনে পড়লো;আরে! এই লোকটাকে আগেও দেখেছি। পরনের কাপড়ের দিকে তাকাতেই লজ্জা পেলাম।এটাতো নুতন সালোয়ার!
তাহলে কে আমাকে ওই সব পাল্টে দিয়েছে? ওর দিকে তাকাতেই যেন বুঝে নিল আমার মনের কথা।আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল সেই এসব করেছে। আমার ভিতরটা কেমন একটা ছ্যাৎ করে উঠলো। মনের অজান্তেই মুহূর্তে চোখ ভিজে গেল। এক মুজাহিদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে এখানে আসা পর্যন্ত প্রায় সব মুজাহিদের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছিলাম।আজ তার ব্যতিক্রম ঘটলো। যদিও শুরুতে আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মুজাহিদ! এমন মানবিক হয় নাকি? শুয়ে শুয়ে আপন মনে এসব ভাবতে থাকি।
ওদিকে আমাকে চোখ খুলতে দেখে হাসি হাসি মুখে লোকটি কি একটা বলে একটি গ্লাস এগিয়ে ধরলো। কিন্তু তা ধরার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। সামান্য কাত হতেই আবার কঁকিয়ে উঠি।অ্যা..অ্যা..বলে কঁকাতেই আবার এগিয়ে এলো লোকটা। অথচ মুখে কিছু বলতে হয়নি।যেন মানুষটা আমার কতকাল আগে থেকেই চেনা। অথচ কত অল্প সময়েই আমার ভিতরটা চিনে গেছে। আমার দিক থেকে ওর ভাষা বোঝার দরকার ছিল না। কিন্তু ওর আন্তরিকতা আমাকে পরম নির্ভরতায় নিশ্চিন্ত করে তুলেছিল। আমি ওর একটার পর একটা সাহায্য নিয়ে গেছি। অবশ্য এসময় এরকম কারো সাহায্য ছাড়া আমার বেঁচে থাকাও সম্ভব ছিল না। যাইহোক যে কথা বলছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম গ্লাসে পানি আছে কিন্তু নাহা ওতে পানি ছিল না।ও পরম মমতায় আমাকে মিষ্টি জাতীয় একটা পানীয় খেতে সাহায্য করে।ঢোক গিলতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে একটু একটু করে এক হাতে গ্লাস ধরে অন্য হাতে আমার ঘাড় উঁচু করে খাইয়ে দেয়।
কিন্তু সুখ আমার কপালে স্থায়ী হয়নি।আর হবেই বা কেন? যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলাম সে যে মাঝ দরিয়ায় ভাসিয়ে দেবে তা কি আর জানতাম। আর জানলে কি আর ঘর ছাড়তাম।তার কাছ থেকে যে সুখ পেয়েছিলাম সেটা ছিল ফাঁদ।যে ফাঁদে পা ফেলে ওকে বিশ্বাস করি; চলে আসি এই মরুপাহাড়ের দেশে।ও চলে যেতেই শুরু হয় অতল সাগরে ভেসে যাওয়ার পর্ব। ভাসতে ভাসতে যখন জীবনে স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছি তখনই দেখা পেলাম আরেক মানুষের।মানুষ তো নয় যেন সাক্ষাৎ ফেরেস্তা। একপ্রকার অযাচিত ভাবে যার কাছে নির্ভরতা পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম আশার আলো; বেঁচে থাকার ঠিকানা,অনেকক্ষণ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে বুবু সাময়িক থেমে গেল।
মানুষের জীবন কতইনা বৈচিত্রে ভরা। এক জীবনে কত কিছু নতুন ঘটনার সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যেতে যেতেও আমরা বাঁচতে চাই।পেতে চাই কারো হাতছানি।এক মন আশাহত হলেও অন্য মন তাই বারে বারে পিছু ফিরে তাকায়। সামান্য আলোকচ্ছটাতেও স্বপ্ন দেখি নুতন করে বাঁচার। প্রত্যাশী হই নুতন কোনো ভোরের। কিন্তু ভাগ্যদেবী যে কপালে লিখন আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। কাজেই সাময়িক স্বস্তিতে বিশেষ কিছু হেরফের হবার নয়। যদিও এই সহজবোধ্যটি তখন আর মাথায় প্রবেশাধিকার পায় না। ফলতো নিঃস্ব হয়ে, রিক্ত হস্তে শেষ পর্যন্ত ললাটের লিখনের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় থাকে না। অন্তঃসত্ত্বা কালীন সময়ে রমিসা বুবুর করুন পরিনতি থেকে উদ্ধারের মধ্যে দিয়ে আর পাঁচজনের মতো সেও নুতন করে নতুন মুজাহিদকে ঘিরে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল। ভালোবাসার কাঙাল মানুষটি আবার সন্ধান করে কোনো এক নির্মল হৃদয়ের । কিন্তু তার কপাল যে আগে থেকেই লিখিত। তাকে খন্ডন করা কার দুঃসাধ্য? স্বভাবতই আর পাঁচ জনের বেলায় যা হয় রমিসা বুবুর ক্ষেত্রেও তাই হল। শোল মাছ পোড়া জীবনকেই মেনে নিতে হলো। ভালোবাসা, প্রেম শব্দগুলো সেই কবেই যে তার জীবন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। তাই তার পিছনে ছোটা ছিল নেহাতই মরীচিকার হাতছানি স্বরূপ।
মাঝে বেশ কিছুক্ষণ নিরাবতার পর বুবু আবার বলতে লাগলো।
-আসলে ওকেই বা দোষ দেই কেমনে?ওরা তো অন্য কাজে বের হয়েছে। পথিমধ্যে আমার মতো কাউকে বিপদগ্রস্ত দেখে সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।তাই সেই হাত স্থায়ী হবার ছিল না। যা হওয়ার তাই হল। চারদিন পর আমি একটু সুস্থ হতেই ও চলে গেলো।
মানুষটি আমার সঙ্গে মাত্র কটা দিন ছিল। কিন্তু মনে হয়েছিল বহুদিন ধরে ওর সঙ্গে আমার পরিচয়; কতইনা আপন হয়ে উঠেছিল মানুষটা। ওর সেবা করার ধরন থেকে বুঝেছি মনে হয় পেশায় ও ছিলেন একজন ডাক্তার। আমাকে সুস্থ করা পর্যন্ত ওর এখানে কাজ ছিল।একটু সুস্থ হতেই ও ফিরে যায় নিজের ঠিকানায়। যেদিন সন্ধ্যায় ও চলে যাওয়ার কথা বলে সেদিন আরেকবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। উল্লেখ্য একদম শুরুতে মুজাহিদ চলে যাওয়ার পর এই দ্বিতীয়বার আবার অসহায় বোধ করি। বারে বারে মনে হতে থাকে কাছের মানুষটিকে আবার হারিয়ে ফেললাম।
পরবর্তী বেশ কিছু দিন আর কোনো মুজাহিদ আমার ঘরে আসেনি। হয়তো বা আমার শারীরিক অসুস্থতার কারণে এইটুকু ছাড় দিতেই ওরা না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।ফলে ঘরের মধ্যে আমি নিজের মত থাকতে পারি। মনে মনে বেশ স্বস্তি পাই। ঘরটাকে নিজের বলে মনে হয়। যাইহোক নিজের মত থাকতে পেরে মাত্র কদিনেই আমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠি। নিজেকে নিয়ে ভাবতে শিখি। অসুস্থতার আগে ও পরে আমার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে এখন আমি আর পিছন ফিরে তাকাতে রাজি নই। স্বপ্ন দেখি নতুন করে বাঁচার। আগের মতই খাবার বাইরে থেকে আসত। কে বা কারা পাঠায় এখন আর তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। খাবার যেটাই হোক সামনে পেলে খেয়ে নিতাম।
জানতাম আমার এই আয়েশি জীবন বেশি দিনের জন্য নয়। হলোও তাই। আরো কিছুদিন যেতেই মুজাহিদের আবার আগমন শুরু হয়। তবে এতদিনে আমিও মানসিক ভাবে তৈরি তাদেরকে খেদমত করার। ক্ষণিকের অতিথি মুসাফিরদের খেদমত করতে এখন আমি আর পিছুপা নই। একজন মহিলা মুজাহিদের কাজে এসময় আমি বেশ দক্ষ হয়ে উঠি। এরই মধ্যে একজন মুজাহিদ একদিন আমাকে তার ঝোলা থেকে একটি রাইফেল বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ইয়ার্কি করছে। অথবা চালানো শেখাতে বের করেছে। আমি কোন কিছু করতে বা হাতে ধরতে অস্বীকার করলে ঘরের এক কোনায় অস্ত্রটি রেখে চলে যায়। ও চলে গেলে রাইফেলটিতে হাত দেই। এতদিন ওদের পাশে থাকে সরাসরি লাইফেলে হাত না দিলেও কোথায় চাপলে কাজ হবে তা অবশ্য জানতাম। অস্বীকার করবো না যে রাইফেলটি পেয়ে খুশি হয়েছিলাম তবে অবাকও হয়েছিলাম। খুশি হই এমন একটা দুর্লভ জিনিস পেয়েছি ভেবে। অবাক হই এটা নিয়ে আমার কাজই বা কি? কাকে মারতেই বা আমি অস্ত্রটিকে ব্যবহার করব? দিনরাত এই সব ভেবে ভেবেই আমি সারা হই।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২২ রাত ৮:৩২