দিল্লি স্টেশনে পানি আনতে যাওয়ার নাম করে রফিক ভাই সেই যে গেল আর এলো না। অথচ আমি ওর ফেরার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে গেছি। একসময় হতাশ হয়ে আশা ছেড়ে দেই। খুব কষ্ট হচ্ছিল ওর এমন উধাও হয়ে যাওয়াতে। শুরুতে অবশ্য মনে হচ্ছিল ওর কোন বিপদ হয়নি তো? জলজ্যান্ত একটা মানুষ, এমন নিরুদ্দেশ হওয়ায় মনে কু-ডাক ডাকতে থাকে। একেতো মনের মধ্যে খচখচ করছিলো দেশে ফিরলেও বাড়ি ফিরতে না পারার যাতনা। এমন অচেনা-অজানা পরিবেশে একটা মেয়ে হয়ে কোথায় থাকবো কীভাবে থাকবো তার নানান দুশ্চিন্তা তো ছিলই সঙ্গে নতুন করে যোগ হলো রফিক ভাইয়ের এমন অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা যেতেই মনে হয়, না তেমন কিছু ওর হয়নি। আসলেই ও চলে গেছে আমাকে না জানিয়ে। আসতে আসতে বেশ কয়েকবার বলেছিল যে ওকে চট করে ফিরে যেতে হবে।আর এই কারণেই অনেক সময় পার হলেও ও না ফেরায় ধরে নেই ও সত্যিই আফগানিস্তানে ফিরে গেছে।কত ট্রেনের খবর হচ্ছে;কত লোক আসা-যাওয়া করছে।এরই মধ্যে কোনো একটা ট্রেনে করে হয়তো চলে গেছে। যখন ধরেই নিই ও আর ফিরবে না, মনে হচ্ছিল দুনিয়ার শেষ আপনজন যেন আমায় ছেড়ে চলে গেল। অথচ এই মানুষটাই পাকিস্তানের বর্ডারে আমাকে ওর স্ত্রীর পরিচয় দিয়েছিল।ওর মুখে স্ত্রীর কথা শুনে, পাশে দাঁড়িয়ে হাসি চেপে রাখাতে পারিনি, বোরখার মধ্য থেকে খিক করে হেসে উঠতেই এমন কটমট করে তাকিয়ে ছিল যে আমি আচমকা বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।পরে সেই অফিসারের সামনে আবার আমার হাত ধরে এগিয়ে চলার ইশারা করে।যেন কত অধিকার আমার উপরে ওর। আমিও বাধ্য স্ত্রীর মতো ওর পিছুপিছু এগোতে থাকি। নাইবা হোক স্বামী কিন্তু এখন সেই মানুষটি এমন করে চলে যাবে ভেবেই কষ্ট হচ্ছিল।
সেদিন রমিসা বুবুর কথার মধ্যে ধরা গলায় বারে বারে এক হতাশা বেরিয়ে আসছিল। ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল।বেশ কয়েকবার দলা পাকানো সাদা থুতু মুখ বাড়িয়ে দুরে ছুড়ে ছুড়ে ফেলছিল। বুঝতে পারছিলাম, সেদিনের সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা এখনও বুবুর হৃদয়ে জ্বলজ্বল করছিল। এতো বছর পরও মনে হচ্ছিল রফিক ভাইয়ের চলে যাওয়া যেন শেষ প্রিয়জন বা শেষ সম্বলটুকু এইমাত্র হারিয়ে ফেলার ক্ষত মনে বয়ে বেড়াচ্ছে।তাই মুখে যতই বলুক তাকে আটকে রাখেনি কিন্তু কথাবার্তায় বারেবারেই আপনজনের ছেড়ে চলে যাওয়ার বেদনাই ঝড়ে পড়ছিল। ওর কথায়,
-জানতাম সে এক সময় ফিরে যাবে।আর ফিরবে নাই বা কেন, ওকে যে আটকে রাখার অধিকার আমার ছিল না। শুধুমাত্র খালাতো ভাইয়ের সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরে আটকে রাখা তো আর সম্ভব নয়। কিন্তু পানি আনতে যাওয়ার নাম করে যেভাবে মিথ্যা ছলনার আশ্রয় করে গা ঢাকা দেয় তা একপ্রকার পালিয়ে যাওয়ারই মতো। মনে নানান প্রশ্ন উঁকি দেয়। আফগানিস্তান থেকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য তৈরি হওয়া কৃতজ্ঞতাবোধ এক্ষণে ফিকে হয়ে যায়। কেন জানি মনে হয়, এমন একজন পলাতক লোকের সব কথা সত্য হতে নাও পারে। ফলে ওর কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে একবার বাড়িতে যাওয়া যেতেই পারে। তাছাড়া মরণ যদি কপালে থাকে আর তা যদি নিজের বাপের হাত দিয়ে হয় তবে তা মন্দের কি।উল্টে এমনও তো হতে পারে নিজের অপকর্ম ঢাকতে রফিক ভাই মুজাহিদের নামে গল্প ফেঁদে আমাকে বাপের বাড়ি যাওয়ার রাস্তা চিরতরে বন্ধ করতে চাইছে। তবে সে যাইহোক ভয়ঙ্কর এক আতঙ্ক, একাকীত্বের শূন্যতা যে একই সঙ্গে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তা অস্বীকার করতে পারি না। চোখের সামনে কত ট্রেন আসছে যাচ্ছে; হাজার হাজার লোক ছুটে চলেছে; কতই না ব্যস্ততা হুড়োহুড়ি গোটা স্টেশনময় লোকজনের মধ্যে। অথচ এসবের মধ্যে আমি যেন এক ভিন গ্রহের জীব। আমার কোনো ব্যস্ততা নেই; নেই কোথাও যাওয়ার তাড়া বা জায়গা। আমি যেন আত্মীয়-পরিজন বিচ্ছিন্না এক চির-অভাগিনী। স্টেশনের অপেক্ষাকৃত এক নির্জন স্থানে বসে ভাবতে থাকি এখন আমার করণীয় কি কিংবা কোথায় বা যাবো আমি এখন?
শত দোলাচলের মধ্যেও বারবার মনে হতে থাকে একবার গ্রামে ফিরে যাই। আব্বা-মাকে আসল ঘটনা খুলে বলার চেষ্টা করি। হাজার হোক উনারাও তো মানুষ; তখন আমার উপর রাগ হলে এখন তো রাগ নাও থাকতে পারে।আর তাতে যদি বিপদ আসে তা নয় হয় আসবে। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করি ঠিকই তো মুজাহিদ স্বামী আব্বাকে যাই বোঝাক না কেন, আমি তো আব্বার মেয়ে, আমি যদি সব ঘটনা খুলে বলি তাহলে তো তাদের ধারণা পাল্টাতেই পারে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঝিমুনি চলে আসে তার খেয়াল ছিল না। হঠাৎ মনে হলো কে যেন ডাকছে আমাকে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, ফোকলা দাঁতের এক বয়স্ক লোক মাথা নিচু করে হাসিমুখে কি একটা জিজ্ঞেস করছে। আমি অ্যা অ্যা করে... কি বলছেন বলতেই,
-মাইজি! তুম কাহা যায়ে গি?
ভাষাটার সঙ্গে ইতিমধ্যে পরিচিত হয়ে গেছি। সেই প্রথম দিন হাওড়া স্টেশন থেকে শুনে আসছি হিন্দি ভাষায় কথা বলা। বলার ধরনে হিন্দির সঙ্গে পাখতুন কিংবা উর্দু ভাষার অনেকটাই মিল আছে। মুজাহিদ আমাকে জানিয়েছিল লেখাটা আলাদা হলেও এই তিন ভাষার লোকেরা একে অপরের কথা বুঝতে পারে। আমিও এতো দিনে মুখে বলতে না পারলেও বুঝতে পারি অনেকটাই। যাইহোক পরিষ্কার বাংলাতেই জবাব দেই,
-জানিনা কোথায় যাব।
লোকটা উদাসীন ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
-হায়রে মাইজি! হাম তোমহারা বাপকা ওমার কা হু; মেরে সাথ মজাক কররাহহে?
বুঝতে পারি আমার উত্তরে উনি খুশি হতে পারেননি। অথচ ওনাকে কেমন করে বলি যে আমি মিথ্যা কথা বলছি না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলি,
-সত্যিই বলছি আমি জানিনা আমি কোথায় যাব।
এবার উনি বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন,
-সামঝা তুম মুঝে সাচ নেহি বাতাও গে। ঘরসে ঝগড় কর আইহো। আগর তুমে কোহি ধীক্কাত না হত তুম এই বুড্ডে বাপ কে সাথ আসকতি হো।
উনার কথা শেষ হতেই কি জানি হঠাৎ করে কিভাবে মুখে চলে আসে,
-আপনি অকারণে আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আমি বরং ওনার কথাতেই উত্তর ধরে ওনাকেই উত্তর দেই,
- আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন। বাড়িতে একটু ঝগড়া হয়েছে।রাগের মাথায় বেরিয়ে এসেছি। আমার স্বামী ভালো লোক। আশাকরি শীঘ্রই আমাকে খুঁজতে বের হবে এবং কোনো না কোনো সময় এখানে এসে পড়বে।
আমার কথা শুনে ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না।
-বহুৎ জরুর হ্যায় বহুত জরুর হ্যায়, বলতে বলতে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
উনি চলে যেতেই মনে হল এ যেন কুড়িয়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতোই হঠাৎ করে সামনে আসা একটি সুযোগকে নষ্ট করে ফেলেছি। একবার মনে হলো ভিড়ের মধ্যে ছুটে গিয়ে ওনাকে খোঁজার চেষ্টা করি। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। জায়গা ছেড়ে উঠেও দাঁড়ালাম। কিন্তু কিছুটা এগিয়ে গেলেও যতদূর চোখ যায় ওনার কোনো হদিস না পেয়ে প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়ি। লোকটা উপযাচক হয়ে ওনার বাড়িতে যাওয়ার কথা বললেন অথচ আমি সুযোগটাকে কাজে লাগাতে পারলাম না! আমার মতো অপদার্থ কি আর দুটো আছে? এই না পারার ব্যর্থতা বারেবারে মনের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটতে থাকে। যাক কি আর করার, যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। ফলে এখন আর ওসব না ভেবে বরং হাওড়া ট্রেনের খোঁজ নেওয়া দরকার বলে মনে মনে ভাবতে থাকি। দিল্লিতে নামা থেকে একটার পর একটা ঘটনা এতটাই ব্যস্ততার মধ্যে রেখেছিল যে খাওয়া-দাওয়ার কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। অবশ্য দীর্ঘক্ষন না খেয়ে থাকার কারণে কিনা জানিনা খাবারের প্রতি এসময় বিন্দুমাত্র চাহিদা ছিল না। কিন্তু এক্ষুনি পেটে একটা মোচড় দিয়ে উঠতেই বুঝতে পারি বড্ড খিদে পেয়ে গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২২ দুপুর ২:২৩