আগেও বলেছি খুবই বড় টানেল বোরগ টানেল। দৈর্ঘ্যে কত বড় ঠিক মনে নেই তবে ট্যানেলটি পার হতে প্রায় চার/পাঁচ মিনিট লেগেছিল। অন্ধকার হলেও টানেলের ভেতরটা ঠিক গাঢ় অন্ধকার নয়।একে একপ্রকার আলো আঁধারি বলা যেতে পারে। এমন অদ্ভুত একটা জগৎ থেকে বের হতেই বাইরে সূর্যের রশ্মি সরাসরি চোখেমুখে পড়ে। হঠাৎ আলোতে চোখ বুজে আসে। সাময়িক অসস্থি কাটিয়ে উঠতেই চলে আসে এক বিষন্নতা।একটু আগে স্টেশনের গায়ে লেখা বোরগ সাহেবের পরিচয় পত্র মনদিয়ে পড়েছিলাম। এক্ষণে সদ্য একশো বছর আগে ফিরে গিয়ে সাহেবকে চাক্ষুষ করার দুর্লভ সৌভাগ্যে একদিকে যেমন বিস্ময়াভিভূত হই ,যেন কোনো ছায়া মূর্তি নয় বাস্তবেই সাহেবকে চাক্ষুষ করার সুযোগ পেয়েছি। অপরদিকে আশপাশের অন্যান্যদের কারো চোখেমুখে কোনো পরিবর্তন না দেখতে পেয়ে বিরক্তও হই বটে। এমন বিয়োগান্ত বিষয়কে নেহাতই ভূত ভূত করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্য আমার সহযাত্রী সঙ্গী সাথীদের উপরে বেশি ক্ষুন্ন হই। এমনকি শ্বেতার মধ্যেও তার অন্যথা দেখলাম না।সেও অন্যান্যদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে খোশগল্পে মশগুল। স্বাভাবিক ভাবেই আমার চিন্তার সঙ্গে ওদের বিস্তর প্রভেদ লক্ষ্য করে কিছুটা নিঃসঙ্গ উপলব্ধি করে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকি।
খানিক বাদে আচমকা শ্বেতা জিজ্ঞেস করে,
-কি ব্যাপার! তুমি এমন চুপ হয়ে গেলে?
-কেন আমাকে কি সবসময় বকর বকর করতেই হবে? পাল্টা জিজ্ঞেস করি।
- না তেমন নয়। তবে.... বলেও কিছু না বলে থেমে যাওয়ায় আমি আবার জিজ্ঞেস করি,
- কি থামলে কেন? কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে বলতে পারো।
শ্বেতা কিছুটা জড়তা নিয়ে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,
- তুমি কি বোরগের ছায়ামূর্তি দেখে ভয় পেয়েছ?
- না ভয় পাই নি। তবে শুরুতে যে একটু পাইনি তা নয়। ট্রেনের ভিতরে যখন সবাই বলাবলি করছিল তখন একটু ঘাবড়ে গেছিলাম। কিন্তু বাস্তবে যখন মানুষটিকে দেখলাম, তোমরা যারা ভূত বলে উপহাস করছো তখন অদ্ভুত একটা শ্রদ্ধাশীল অনুভূতি আমার অন্তরে ভরে গেল। আমি এমন অনন্য দায়িত্বশীল জীবিত মানুষের সাক্ষাৎকার অদ্যবধি পাইনি, যেটা আজকে বোরগের মধ্যে পেলাম। নিয়ম-নিষ্ঠার সদা কর্তব্যপরায়ণ এক সৈনিক,যিনি বিরামহীন ভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
আমি জানতাম আমার কথাগুলো শ্বেতার ভালো লাগবে না।লাগেওনি ওর। পরের কথাতেই তার প্রমাণ পাই। খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-সাহেবের মধ্যে তুমি অনন্য দায়িত্বশীলতা খুঁজে পেয়েছো মানলাম। তাই বলে কি তোমাকে কথা বলতেও নিষেধ করে গেছেন যে মুখ এমন প্যাঁচা করে বসে আছো?
আমি সেসময়ে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে গেছিলাম। বুঝতে পারেনি ওর উপহাস।বলে ফেলি,
-গোটা টানেলের মধ্যে অন্ধকার আর তার মধ্যে পথপ্রদর্শক হিসেবে উনি পথচারীদের রাস্তা দেখিয়ে চলেছেন- বিষয়টি কেমন অদ্ভুত লাগে না?
শ্বেতা মূহুর্তে রেগে গিয়ে মুখ দিয়ে বিকট একটা শব্দ করে জানায়,
-অদ্ভুত!তোমার এইসব গাঁজাখুরি গল্পটল্প বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকো।নইলে সকলে শুনলে বিপদ আছে। ভাববে আমি একটা মানসিক রোগীর সঙ্গে হানিমুনে যাচ্ছি।
এক কম্পার্টমেন্ট লোকের সামনে শ্বেতার এমন অপ্রত্যাশিত চন্ডাল আচরণে আমি প্রচন্ড ব্যথা পাই। খুব অপমান বোধ করি। যদিও আমার দিক থেকে প্রতিউত্তরে নিরুত্তর থাকি। যাইহোক ওর এমন অপ্রত্যাশিত রূঢ় আচরণে একটা সুবিধা হয়েছিল। টয় ট্রেনের বাকি রাস্তাটুকুতে আমি চোখের সামনে সারাক্ষণ সাহেব ও সাহেবের কুকুরের ছবি দেখে গেছি। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে মনে মনে কল্পনা করে গেছি। অস্বীকার করবো না সেদিন তাদের এমন পুনঃ পুনঃ দেখার সৌভাগ্যে আমি নিজ নিজ পুলকিত হই। অদৃশ্যে ধন্যবাদ দেই সাহেবকে।অথচ আমার নিতান্তই কাঁচুমাচু মুখ দেখে পাশে বসা শ্বেতা বেশ কয়েকবার মান ভাঙানোর চেষ্টা করে গেছে। আমি প্রত্যেকবার সযতনে শ্বেতার সে আবেদন ফিরিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থেকেছি।
শিমলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতেই সেদিন বিকাল হয়ে গেছিল। শিমলা স্টেশনে আমাদের জন্য হোটেল থেকে প্রেরিত চারটি স্করপিও অপেক্ষা করছিল। চারজন ড্রাইভার ও টুর কোম্পানির তিনজন মিলেমিশে আমাদের লাগেজপত্র গাড়ির মাথায় তুলে আমাদের আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করে। আমরা যার যে গাড়িতে লাগেজপত্র উঠেছে সেই গাড়িতে আসন গ্রহণ করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গানের তালে তালে স্করপিও ছুটতে থাকে। মিনিট কুড়ি চলার পর অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়।স্করপিও এসে পৌঁছায় নির্দিষ্ট হোটেলের সামনে। অনেকগুলি পরিবার সঙ্গে থাকায় ট্যুর কোম্পানির ম্যানেজার রুমের চাবিগুলি নিয়ে লটারির ব্যবস্থা করলেন। লটারির প্রসঙ্গে নিয়ম-নীতি জানাতে সংক্ষিপ্ত একটি ভাষণও দিলেন। বুঝতে পারি যে যে রুমের চাবি পাবেন তাকে সেই রুম নিতেই হবে। রুম নিয়ে কোনরকম অভিযোগ বা আপত্তি গ্রাহ্য হবে না। শুরু হলো লটারির পর্ব। একদিকে রুমের চাবি গুচ্ছ গচ্ছিত রেখে কাগজে লেখা চিরকুট ভাঁজ করে সকলকে একটি করে চিরকুট তুলে নিতে বলা হলো। বেশিরভাগ পরিবারের বাচ্চারা চিরকুট তুলবে বলে দাবি করে। আমাদের ক্ষেত্রে শ্বেতা আমাকেই যে কোনো একটি চিরকুট তুলে নিতে বলে।সেই মতো ভাগ্যকে ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেতেই এগিয়ে গিয়ে একটি তুলে নিই। ভাঁজ খুলে দেখি দোতলার চার নম্বর রুম। রুমের অবস্থান জেনে খুশি হই। কারণ গ্রাউন্ড ফ্লোর যেমন আমাদের অপছন্দ ছিল তেমনি তিন তলায় বারংবার উঠানামা করতেও আগ্রহী ছিলাম না। এমতাবস্থায় দোতলায় এই রুমটি পেয়ে শ্বেতাকে নিয়ে রুমের উদ্দেশ্য রওনা দিই।চাবি নিয়ে রুমের সামনে দাঁড়াতেই শ্বেতা আচমকা তার মিষ্টি ঠোঁট দুটো আলতো করে এগিয়ে দেয়। বুঝতে পারি লটারি জেতার সাফল্যের পুরষ্কার এটা। আমিও এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে তার ওষ্ঠকে সম্মান দেই। কিন্তু আমাদের এই সুখানুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। চাবি দিয়ে রুমটি খুলতেই অবাক হয়ে যাই। রুমের ঠিক মাঝখানে একটি কলাম রুমটিকে দুটি অংশে ভাগ করে রেখেছে।কলামের দুদিকে দুটি সিঙ্গেল খাট বসানো। খাটের অবস্থা দেখে দুজনেই মেঝেতে বসে পড়লাম। মাথায় আসছে না এখন করণীয় কী। পথচলতি প্রায়ই মানুষকে বলতে শুনেছি হাসবো না কাঁদবো? বাস্তবে সেদিন আমাদের তেমনি অবস্থা। আমি নিশ্চিত এটা কোনো নবদম্পতির হানিমুনের রুম নয় বরং রুমটি হতে পারতো বৃদ্ধাশ্রমের কোন কক্ষ বটে। যাইহোক শ্বেতাকে একসময় বলে ফেলি,
- নিচে গিয়ে ওদের একবার বললে কেমন হয়?
ও মুখে হতাশা রেখেও নিষেধ করে জানায়,
-কি বলবা? আমাদের রুমে একটা খাট নেই এটা?ভেবে দেখেছো কথাটা শুনে সবাই কেমন হাসাহাসি করবে।
ঠিকই তো কথাটা মন্দ নয়। তাহলে এখন উপায়?
এমন সময় দরজার বাইরে নক করার শব্দ পেলাম,
- দাদা একটু বাইরে আসুন.....
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৫৮