দরজা খুলতেই দেখি রোগা টিনটিনে মিশকালো হ্যাংলার মতো করে ট্যুর কোম্পানির একটি ছেলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতেই ওদের উপর তখন রাগ সপ্তমে চড়ে ছিল। আমাকে দেখা মাত্র কলা কলা দাঁত বের করে ভড়ভড় করে বলে গেল,
-ডাডা আপনাকে নিচে সম্রাটডা ডাকসে।
আমি বেশ বিরক্তের সঙ্গে বলি,
- কোন সম্রাট? এখনতো বাপু আর রাজ-রানী সম্রাট সম্রাজ্ঞীদের রাজত্ব নেই যে এমন করে কেউ তলব করতে পারে।
- না ডাডা সে সম্রাট নন,এ আমাদের দলের সম্রাটডা।
এবার আমি কিছুটা সংযত হয়ে বলি,
- তোমার নাম কি?
- আজ্ঞে গগন।
- ঠিক আছে গগন তুমি নিচে যাও, গিয়ে বল আমি যাচ্ছি।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবারো জিজ্ঞেস করি,
- আচ্ছা কেন ডাকছে জানো?
- না ডাডা। টবে মনে হয় আপনার রুম নিয়ে কথা বলবে।
রুম নিয়ে কথা বলতে পারে শুনে একটু খুশি হই। মনে মনে দুঃখ প্রকাশ করি, এতক্ষণ তাহলে ট্যুর কোম্পানির ম্যানেজারকে আমি অন্য নামে ডাকছিলাম। যাইহোক সে কথা ওকে বুঝতে দিলে চলবে না। আমাকে তলব করেছে যখন কিছুটা আশার আলো দেখি।এখন নিচে গিয়ে দেখি বিকল্প কোনো রুম পাওয়া যায় কিনা। তবে লটারির সময় ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন এই হোটেলে কোনো রুম আর অবশিষ্ট নেই যে আপনাদের মধ্যে কারোর রুম পছন্দ না হলে বিকল্প কোনো রুমের ব্যবস্থা করতে পারবো। এদিকে রুমের ভিতরে তাকিয়ে দেখি শ্বেতা লাগেজপত্র থেকে কিছু কিছু জিনিস ইতিমধ্যে বের করে ফেলেছে। ম্যানেজার ডাকছেন জানিয়ে নতুন করে আর কোনো জিনিসপত্র বের না করতে পরামর্শ দিয়ে নিচে নেমে আসি।
নিচে এসে খোঁজ করে ম্যানেজারের রুমে এসে দেখি ঘর বন্ধ।পাশ থেকে হোটেলেরই একজন স্টাপ ইশারায় একটু দূরে দেখিয়ে দিলেন। কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলের চাতালে ওনারা তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত। এবার আর সম্রাট বাবুকে নামে চিনতে অসুবিধা হলো না। খুন্তি নিয়ে কি একটা নাড়ছিলেন ভদ্রলোক।
আমাকে দেখেই উনি ওই অবস্থায় এগিয়ে আসেন,
-দাদা ক্ষমা চাইছি আপনাদের কাছে। আপনারা সজ্জন মানুষ। বিয়ের পর প্রথম ঘুরতে বেরিয়েছেন অথচ সেখানেই কিনা আপনাদের কপালে বিপত্তি, এমন একটি বাজে রুম। খুবই দুঃখজনক ঘটনা দাদা। কিন্তু কি আর করবো বলুন। পরিবার পিছু একটি করে রুম অ্যালটমেন্ট করতে গিয়ে কারোর না কারোর কপালে এই রুমটি পড়বেই। খুব অসুবিধা হয় যাদের ভাগ্যে এই রুমটি পড়ে। তবে গ্রুপের বয়স্ক মানুষদের পড়লে তেমন সমস্যা হয় না।এই প্রথম আপনাদের মত নব দম্পতিদের কপালে এই রুমটি পড়েছে। সত্যিই খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়। এখন যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে তাহলে একটু দূরে অন্য একটি হোটেলে আমরা আপনাদের জন্য বিকল্প রুমের ব্যবস্থা করতে পারি।
আর তাতেও যদি সম্মতি না থাকে তাহলে আমাদের রুমটি একবার দেখতে পারেন।
আমি আগ্রহের সাথে বলি,
- ঠিক আছে আপনাদের রুমটাতেই একবার নিয়ে চলুন।
সম্রাট বাবু আমাকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চললেন ওনাদের রুমের দিকে। যেহেতু ওনারা ট্যুর কোম্পানির তিনজন স্টাপ ওখানে থাকবেন কাজেই ধরেই নিয়েছিলাম যে আমাদের দুজনের থাকতে ওখানে অসুবিধা হবে না। কিন্তু রুমটি খুলতেই বুঝতে পারি ওটা হোটেলের স্টোর রুম। একটা ভ্যাবসা বোটকা গন্ধ নাকে এল। চারদিকে প্রচুর জিনিসপত্র ডাই করে সাজানো। নানা রকমের প্লাম্বিং, ইলেকট্রিকের জিনিসপত্রের সঙ্গে হোটেলের পুরানো ময়লা ম্যাট্রিস বেডপত্র থেকে শুরু করে কি না নেই সেখানে।রুমটিতে জানালা একটা থাকলেও কোনোদিন খোলা হয়েছে বলে মনে হলো না। চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর অন্ধকারময় রুমটির এক কর্নারে কোনক্রমে একটা চৌকি বসানো। এমন একটি রুম দেখে আর শ্বেতার মতামত নেওয়ার আবশ্যিকতা মনে করিনি।ফলে আর কথা না বাড়িয়ে,
- সম্রাট বাবু আপনি যে আমাদের জন্য ভেবেছেন এটাই অনেক। ধন্যবাদ আপনাকে, বলে দ্রুত আমি উপরে উঠে আসি।
আমার নিচে যাওয়াতে শ্বেতাও আমার মত স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু ফলাফল এসে জানাতে একেবারে হতোদ্যম হয়। আমি আর সময় নষ্ট না করে আগামী দু'দিনের জন্য রুমটিকে ব্যবহার উপযোগী করতে কাজে নেমে পড়ি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে রুমটির কোনো খামতি ছিল না। কিন্তু সমস্যা ওই একটিই, মাঝখানে কলাম। আমার দেখা দেখি শ্বেতাও হাত লাগায়। দুজনে মিলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে রুমটিকে ব্যবহারযোগ্য করে তুলি। কাজের চাপ একটু হালকা হতেই মধ্যপ্রদেশে চীন চীনে ব্যথা অনুভব করি। বুঝতেই পারি মাত্রা ছাড়া খিদে পেয়েছে। কাজেই অন্য সবকিছু ফেলে রেখে দুজনে একে একে ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে আসি।
নিচে নেমে দেখি রান্নাবান্না শুধু শেষ নয়, খাওয়ার আসনগুলোও সব ভর্তি। আসলে রুমের পিছনে ছুটতে গিয়ে আমরা অন্যদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে গেছিলাম।কি আর করার। জায়গা না পেয়ে একটু ফালুক ফুলুক করে আশপাশটা দেখে নিই। কিন্তু এভাবে খামোখা দাঁড়িয়ে না থেকে আপাতত নিজেদের রুমে ফিরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করে পা বাড়াতেই সম্রাট বাবু জানালেন,
-দাদা প্লিজ আরেকটু অপেক্ষা করুন কিছুক্ষণের মধ্যে এই ব্যাচের খাওয়া শেষ হবে।
আমি একটা শুকনো হাসি দিয়ে,
-খালি পেটে খালি খালি গন্ধ না শুকে আমরা বরং উপরে গিয়ে বসি। জায়গা খালি হলে আপনারা বরং খবর দিয়েন।
উনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন।
উপরে গিয়ে বেশিক্ষণের জন্যেও বসিনি, এমন সময় আবার দরোজায় নক করার শব্দ পাই। বুঝতে পারি আবার গগন মাঝি ডাক দিয়েছে। আমরা যেহেতু তৈরি ছিলাম, কাজেই আর সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে ওর সাথে বেড়িয়ে আসি। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে গগনকে জিজ্ঞেস করি,
-আচ্ছা গগন তুমি কতদিন এই কোম্পানির সঙ্গে আছে?
-আজ্ঞে তিন বছরের একটু বেশি।
-বাব্বারে এতো দিন ধরে তুমি কাজ করছো?
-আজ্ঞে।
-আমাদের মতো এত এমন দুর্ভাগ্যের কপাল ইতিপূর্বে কি কারো হয়েছিল?
- আজ্ঞে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বয়স্কদের সম্রাটডা বুঝিয়ে সুঝিয়ে রুম বদলে দেন।এবারো আপনার ভাগ্যে রুমটি পড়তেই কুন্তিঘাটের জ্যেঠুকে সম্রাটডা বলেছিলেন। কিন্তু ওনারা রুম বদল করতে রাজি হননি।
- ও তাই নাকি?
আমি আবারও বলি,
-দেখো গগন রুমের যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন তাড়াতাড়ি আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করো।দেখো যেন খাওয়ার জন্য আবার অন্য হোটেলে পাঠিয়ে দিওনা।
এবার গগন বেশ মজা পেয়ে যায়। সাথে সাথে বড় বড় দাঁত বের করে জানায়,
- কি যে বলেন ডাডা?
পাশে খাবার পরিবেশন করছিলেন সম্রাট বাবু। আমার কথা শুনে জিহ্বায় কামড় খেয়ে আরেকবার লজ্জা প্রকাশ করলেন। কথা বলতে বলতে আবার গগন ডাক দিল,
- ডাডা বসার জায়গা তৈরি।
আমরা আর কালবিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসে পড়লাম।
খিদে পেলে বোধহয় আমাদের ইনটেক স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেড়ে যায়। কিন্তু যখন সেই খিদে পেটে মোচড় দিয়ে ওঠে তখন শরীরের উষ্ণতা যায় কিছুটা বেড়ে,চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে হয় ফ্যাকাশে,কান ঝালাপালা করে ওঠে।আর তখন সামনে শুধু দু মুঠো খাবার হলেই চলবে বলে মনে হয়, অতশত ভুরিভোজের তখন দরকার পড়ে না। বাস্তবে সেদিন আমার তেমনি অবস্থা হয়েছিল। আমি আর অপেক্ষা করতে পারিনি।গগন একটা থালায় সাদা ভাত রেখে যেতেই শুকনো ভাত গপাগপ কয়েক লোকমা মুখে পুড়লাম।শ্বেতা কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ইচ্ছা করেই ওর দিকে না তাকাতেই এবার পা দিয়ে আমাকে ইশারা করে। এবার আর ভ্রুক্ষেপ না করে পারলাম না। কিন্তু ততক্ষণে আমার থালার ভাত অনেকটাই কাবার (শেষ হয়ে যাওয়া)। যাইহোক বাকি খাবারটা যে কি অপার তৃপ্তি করে সেদিন খেয়েছিলাম তা ঠিক ভাষায় বোঝাতে পারবো না।
সেদিন পড়ন্ত বেলায় আমাদের পায়ে হেঁটে একটু দূরে পাইন বন ও তার মধ্যে দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পেটে ভাত পড়তেই অবসন্নতা এতটাই গ্রাস করে যে আর কোথাও যেতে মন সায় দিল না। রুটিন মাফিক পরে গগন ডাকতে এলে পদব্রজে যাব না বলে ওকে জানিয়ে দেই। ইত্যবকাশে একটু বিছানায় গড়িয়ে নিতেই চোখে ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। একটু ঘুমিয়েও গেছিলাম মনে হয়। খানিক বাদে শ্বেতার ডাকে সেই সুখনিদ্রা যায় ভেঙ্গে।
- আরে! আমরা কি এখানে খালি খালি ঘুমাতে এসেছি?
ধরফর করে উঠে বসি। ঠিকই তো এভাবে ঘুমালে বা বসে থাকলে চলবে না। হাল্কা করে চোখে মুখে জল দিয়ে একটু ফ্রেস হয়ে কি মনে হলো একটু জানালাটা খুলতেই বাইরের দৃশ্যে অভিভূত হয়ে পড়ি। একদিকে দূরে পশ্চিম আকাশে রক্তিমদেব দিগন্ত রেখার নিচে নেমে গেছে। তার বর্ণিল রক্তিম আভা যেন তখনও তার সদ্য পশ্চাদমনের সাক্ষ্য বহন করছিল। তার পাশাপাশি দূরে ও কাছে শহরের ভাঁজে ভাঁজে অগণিতম মিটিমিটি আলো গোধূলি লগ্নটাকে অত্যন্ত আবেগী ও মায়াবী করে তুলেছিল।শ্বেতাকে ডেকে দেখাতেই ওর চোখে মুখে যেন মুগ্ধতার ঝিলিক বয়ে গেল। চওড়া হাসিতে মুগ্ধ নয়নে জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকলো।নাহা!এমন দৃশ্য তো শুধু শুধু রুমের ভিতর থেকে উপভোগ করলে হবেনা, বাইরে বের হতেই হবে। কাজেই যেমন ভাবনা তেমন কাজ।
মুহূর্তের মধ্যে তৈরি হয়ে শ্বেতাকে নিয়ে নিচে মল রোডে চলে আসি।
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ২:০৪