মল রোডকে শিমলার প্রাণকেন্দ্র বলা যায়। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে নানান ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।রেস্তোরাঁ, পার্লার, শপিংমল, ছোট বড় নানা রকমের দোকান , কার পাকিং- সব মিলিয়ে ভীষণই ব্যস্ততম এলাকা বলতেই হবে। এখানে এসে অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ্য করি। একটা বহুতলের সবকটিই ফ্লোর মেন রাস্তার সঙ্গে এমনভাবে ঢালু সিঁড়ি দিয়ে সংযোগ করা হয়েছে যে সব ফ্লোরেই কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। কার পার্কিং সমতলে বহু আবাসনে গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকে জানি কিন্তু একটা গোটা ভবনই কার পার্কিং- চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতে পারতাম না। যাইহোক এসব দেখতে দেখতে একটু এগিয়ে যেতেই বামদিকে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটা কাঁচের ঘর লক্ষ্য করি।যার গায়ে একটা ছোট্ট নোটিশ বোর্ড ঝোলানো আছে- টিকিটের মূল্য 5( ইংরেজিতে) টাকা। হঠাৎ করে রাস্তার সামনে এমন নোটিশ বোর্ড দেখে কৌতুহল বেড়ে যায়। এমন ছোট্ট একটা কাঁচের ঘর; আপাতদৃষ্টিতে কোনো বিনোদনের ইভেন্ট বলে মনে না হলেও স্রেফ কৌতুহলবশত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইউনিফর্ম পরিহিত কর্তব্যরত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করতেই, লিফটের দিকে ইশারা করে পাহাড়ের মাথার দিকে দেখান। লিফট মানে বহুতল ভবন কিংবা অট্টালিকায় থাকে জানি। তা বলে শহরের মধ্যে রাস্তার উপরে অবস্থিত পাহাড়ের উঠবার জন্য এমন লিফটের ব্যবস্থা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন লাগলো।যদিও একটু দূরে পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে তৈরি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠাবারও ব্যবস্থা আছে। একটু আগে ট্যুর কোম্পানির ম্যানেজার আমাদের ঐ সিঁড়ির কথা জানিয়েছিলেন । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পাহাড়ের মাথাকে সুসজ্জিত করে কোনো কোনো স্থানে আধুনিক পরিভাষায় ম্যাল রূপে গড়ে উঠলেও এই পাহাড়ে অতিরিক্ত পাওনা শহরের সর্ববৃহৎ শিমলা কালীবাড়ি। অস্বীকার করবো না সেদিন গোধূলি লগ্নে আপন মনে কিছুটা ঘুরতে বের হলেও আমাদের গন্তব্যস্থলও ছিল শিমলা ম্যাল এবং শিমলা কালীবাড়ি। কাজেই হাতের কাছে এমন সু্যোগ পেতেই কিছুটা আত্মহারা হয়ে পড়ি।পাশে দাঁড়ানো শ্বেতার দিকে তাকাতেই ওর চোখে-মুখেও লক্ষ্য করি চওড়া হাসি জ্বল জ্বল করছে।
টিকিট কেটে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি আমাদের ।প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরও কয়েকজন পথচারী হাজির হতেই লিফ্টম্যান বোতাম টিপে দিলেন। মূহুর্তেই আমরা উঠে গেলাম পাহাড়ের মাথায়। উঁচু বাড়ির ছাদে উঠে নিচের দিকে তাকালে যেমন সবকিছু ছোট ছোট বলে মনে হয়, ম্যালে উঠে শুরুতে আমাদের তেমনি অবস্থা হয়েছিল। সবকিছু ছোট ছোট লাগছিল। একটু আগে যে মল রোডে ছিলাম এখন সেই রাস্তার উপরে চলমান গাড়িগুলোকে এখন কেন্নোর মতো ছোট ছোট মনে হচ্ছিল। এমন অনুভূতি আমার জীবনে প্রথম বৈকি। আশপাশের অন্যান্য দিকেও এক এক পলকে একটু একটু করে দেখে নেই। কি অসাধারণ সিনিক বিউটি।আসবো সে প্রসঙ্গে পরে। যাইহোক এমন একটি স্থানে এসে একটু না বসলে হয় নাকি! কিন্তু এবার আসেপাশের বসবার স্থান গুলোতে তাকিয়ে দেখি একটিও ফাঁকা নেই। সবগুলোই কপোত-কপতিরা দখল করে বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে ফালুক ফুলুক করে গোটা এলাকাটা আমরা এক নজরে দেখে নেই। ওদিকে মন্দিরে সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। ভক্তদের আনাগোনা লক্ষ্য করি। এভাবে বেশকিছুটা সময় কেটে যায়। কিন্তু কোথাও বসার সুযোগ না পাওয়াই অগত্যা সে আশা ত্যাগ করে ম্যালের ধার দিয়ে প্যারাফিটের গা ঘেঁষে হাঁটতে থাকি। এমনিতেই ওখানে বেশ ঠান্ডা। গায়ে ফুল সোয়েটার থাকলেও একটু শীত শীত লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে এক টুকরো উষ্ণতার আশায় অমন গোধূলি লগ্নে হিমেল হাওয়ার মধ্যে শ্বেতাকে এক হেঁচকা টানে বাহুর মধ্যে নিয়ে আসি।ও হাত ঝাকানি দিয়ে ধ্যাৎ বললেও পুরোপুরি ছাড়িয়ে নিলো না। ফলে আমি কিছুটা প্রশ্রয় পেয়ে যাই। এবার আরো শক্ত করে ওর হাত ধরে হাঁটতে থাকি। হঠাৎ শ্বেতা কানে কানে বলে উঠলো,
- জানো এই প্রেমকে কি বলে?
- এইরে! প্রেম করতে এসেও আবার তার কুষ্টি ঠিকুজি, প্রেমের শ্রেণিভেদ বিচার?
অবশ্যম্ভাবী উত্তর দিতে না পারার যাতনায় প্রেমের ছন্দপতন ঘটে। আমি হাত ছাড়িয়ে নিতেই এবার শ্বেতাই আমার হাত চেপে কানে কানে বললে,
- এটাই ভিক্টোরিয়ান লাভ।
ওরে বাব্বা! মনের অজান্তেই ভিক্টোরিয়ান লাভ করে ফেলেছি। এমন প্রেমের বিশেষত্ব কি মনে ইচ্ছে জাগলেও তাকে প্রশমিত করি। বরং নুতন করে ও প্রসঙ্গে না গিয়ে আমি ওর কথাতেই রোমাঞ্চিত হলাম। অনুভব করলাম শ্বেতার শরীরের উষ্ণতা দেহমনের প্রান্ত ছুঁয়ে চোখেমুখে জ্যোতিষপ্রভার ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। বুঝতে পারলাম ও কথা বলার অবস্থায় নেই। কিছুটা ধরা গলায় চোখ দিয়ে ইশারা করলো আমাকে নিচু হতে। আমি সেদিন আসন্ন সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে ওর আবেদনে সাড়া দিলাম। যেখানে ঈষৎ নিচু হতেই অপর দিক থেকে আলতো করে প্রেমাচিহ্ন এঁকে দিলো আমার কপালে। কিন্তু আমিও শুধু শুধু কপালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বেছে নিলাম ওর ওষ্ঠদ্বয়কে। নয়নাভিরাম প্রকৃতির মাঝে হাজার জনতার শত কোলাহলের মধ্যেও মনে হলো আমরা যেন নিজেদের হারিয়ে ফেললাম এক নির্জন দ্বীপে। কন্ঠ আসে শুকিয়ে যেখানে কোনো ভাষা আসে না।বলা যায় হারিয়ে ফেলি কথা বলবার ক্ষমতাও। হঠাৎ শ্বেতা অসহায় ভাবে ধরা দেয় আমার বাহুর মধ্যে। দুজনের সম্মিলিত ভার ঐ মূহুর্তে সইতে না পেরে টলমলিয়ে কোনক্রমে সামলিয়ে আমরা ওখানেই বসে পড়ি। খোলা আকাশের নিচে মেঝেতে বসে পড়লেও স্বস্তি আসছিল না।পিচের মেঝে ছিল যথেষ্ট ঠান্ডা সঙ্গে হিমেল হাওয়া আমাদেরকে বেশ কাবু করে ফেলেছিল। এমতাবস্থায় মুহুর্মুহু চোখ ঘুরপাক খাচ্ছিল আশেপাশের কংক্রিটের বেঞ্চের দিকে। কিছুক্ষণ বাদেই আমাদের সে আশা পূর্ণ হয়। এক দম্পতি উঠে যাওয়ায় আমরা তৎক্ষণাৎ ওনাদের জায়গা দখল করে ফেলি।
সেদিন পাহাড়ের আবহাওয়ার ছিল অত্যন্ত মনোরম। দিনের বেলা ছিল সুন্দর মেঘমুক্ত আকাশ; রৌদ্রকরোজ্জ্বল আবহাওয়া। যে কারণে সন্ধ্যার পর পরই আকাশে শত সহস্র নক্ষত্র মন্ডলী তাদের উজ্জ্বলতা বিকিরণ করতে থাকে। সম্ভবত দিনটা ছিল পূর্ণিমার পরের দিন। সন্ধ্যার বেশকিছুটা পর পরই আলো আঁধারির অবগুণ্ঠন সরিয়ে ক্রমশ বিরাজমান হতে থাকে নিশাপতি-পূর্ণিমার এক চন্দ্রদিন পরের চন্দ্রালোকিত জোৎস্না। সন্ধ্যার পর পরই চন্দ্র-তারার এমন মায়াবী দৃশ্য ম্যালের হাজার জনতাকে বাকরুদ্ধ করে ফেলেছিল।শ্বেতাই প্রথম বিষয়টি লক্ষ্য করে।আমি সহমত দিয়ে বিষয়টি চাক্ষুস করি। অসম্ভব নীরবতায় চাঁদ তারার উপস্থিতি গোটা পাহাড়কে এক অলিখিত ছন্দে বেঁধে ফেলেছে। লক্ষ্য করি প্রকৃতির সোনালী আলো পাহাড়ের প্রতিটি প্রান্তে যেন পেখম মেলে ধরেছে। সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। আর তার পাশে যেন লজ্জায় ম্লান ও ন্যূজ হয়ে কর্তব্য পালন করছিল ম্যালের কাছে ও দূরে শহরের কৃত্রিম বাতিস্তম্ভ।মনে হচ্ছিল নক্ষত্র মন্ডলীর সাথে পাহাড়ের ঢালে ঢালে অসহস্র বাতিস্তম্ভর লুকোচুরি খেলা চলছে। হঠাৎ লোডশেডিংয়ের কারণে সমবেত কন্ঠে চিৎকার সেই মোহনীয় দৃশ্যের ছন্দপতন ঘটে।শ্বেতাকে আরো কাছে টেনে প্রকৃতির মাঝে আমরা বসে থাকি। লোডশেডিং অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কিছুক্ষণ পরে আবার আলো চলে আসে। এসময় হঠাৎ দুটি ছেলেকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখি। ওদের এমন চাহনিতে আমরা সাবধানতা অবলম্বন করে নিজেদের মধ্যে একটু দূরত্ব রেখে বসি। একবার মনে হচ্ছিল জিজ্ঞেস করি কেন এমন করে আমাদের দিকে লক্ষ্য রাখছে।শ্বেতাকে বলতেই একটি ঝাঁকানি দিয়ে আমাকে কিছু না বলতে পরামর্শ দেয়। অগত্যা গোমরামুখো হয়ে মুখ নিচু করে বসে থাকি। এমন সময় মুখ তুলতেই দেখি একটি ছেলে ঠিক আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে।
আমি জিজ্ঞেস করি,
- কিছু বলবেন ?
চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২৩ সকাল ৮:৩৭