মুক্তিযোদ্ধা খুন, গনহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের নায়ক কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার হামিদুল এখন কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা শাখা বিএনপি' আহবায়ক। পাক হানাদার বাহিনীর দোসর ৭১- এ এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত এই ব্যাক্তি এখন রং বদলে আহব্বায়ক বনে গেছে। ইতিপূর্বে বিএনপির সভাপতি পদে আসীন হওয়ার পর ওই শাখার এক সময়ের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারী বিএনপির তৎকালিন মহাসচিব ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক জিয়ার কাছে রাজাকার কমান্ডারকে সভাপতি পদ থেকে অব্যহতি দেওয়ার জন্য বহু অভিযোগ করেও ব্যার্থ হয়েছেন। এ অবস্থায় রাজাকার কমান্ডারের সাথে আপোস না করার খেসারত হিসেবে তাকে খোয়াতে হয়েছে সাধারণ সম্পাদকের পদটি। এমনই অপমান ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে, ওই রাজাকার কমান্ডার সম্পাদক আব্দুল বারীর বাড়ি ঘর লুটপাট করেছিলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন। ক্ষতিগ্রস্থ শহীদ পরিবার ও সংশ্লিষ্ঠদের সাথে কথা বলে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
কে এই হামিদুল ?
চিলমারী উপজেলার রাজারভিটা গ্রামের কুখ্যাত দালাল, রাজাকার পঞ্চু মিয়ার পুত্র হমিদুল। ৭১- এ পিতার হাত ধরে রাজাকার বনে যান। হিংস্রতা, পৈশাচিকতা ও নারকীয় হত্যাকান্ডে পারদর্শী হওয়ায় খুব অল্প সময়ে পাক বাহিনীর ঘনিষ্ট হয়ে পড়ে হামিদুল। গনহত্যার পূরস্কার হিসেবে পুরস্কৃত করা হয় তাকে রাজাকার কমান্ডারের পদ দিয়ে। এরপর আরো বেড়ে যায় হমিদুলের নৃশংসতা।
এ ব্যাপারে বিএনপি নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের রাজাকার ক্যাম্পে ধরে এনে আগুনে পুড়িয়ে, কখনো বা গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে, আবার কখনো মাটিতে অর্ধেক শরীর পুঁতে নৃশংসভাবে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলতো। তার নৃশংসতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলো যে, দেশ ¯^vaxb হওয়ার পর তার অত্যাচারের কাহিনী দিয়ে রচনা করা হয়েছিলো জারী গান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার বাবা পঞ্চু মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়লে তার দৃষ্টান্তমূলক মৃত্যুদণ্ড দেন মুক্তিযোদ্ধারা। গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। সেই সময় পালিয়ে থাকার কারনে বেঁচে যায় রাজাকার হামিদুল। দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে থাকার পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে সে বেরিয়ে আসে প্রকাশ্যে। মুখোশ খূলে, রং বদলে বনে যায় বিএনপির চিলমারী শাখার সভাপতি।
চিলমারী উপজেলা পরিষদের বর্তমাণ চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী বীর বিক্রম বলেন, হামিদুল ও তার বাবা চিলমারীসহ এতদাঞ্চলের কুখ্যাত রাজাকার এটা ছেলে বুড়ো সবাই জানে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এরাই এখন রং বদলে নেতা বনে গেছেন।
জানা যায়, হামিদুল ক্ষমতাধর বিএনপি নেতা হলেও এখনও অনেক এলাকায় যেতে পারেনা সে। প্রতিশোধের মৃত্যূ ভয় এখনও তারা করে ফেরে তাকে।
মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী হামিদুল
একাত্তরের মার্চে ক্র্যাকডাউন হওয়ার পর চিলমারী উপজেলার থানাহাট ইউনিয়নের মাচাবান্ধা গ্রামের দুই বন্ধু মজিবর ও জলিল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আসামের কাকরিমারী ক্যাম্পে প্রশিক্ষন নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন হানাদারদের বিরুদ্ধে। এরই মাঝে ছয় মাস অতিক্রম হয়। স্ত্রী ও ছোট্ট সন্তানের স্নেহ ও ভালোবাসার টানে খবর নিতে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে মজিবর ও জলিল অস্ত্র সহ বাড়িতে আসেন। ওই রাতে আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে জলিল ও মজিবর জলিলের বাড়িতে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। গ্রামেরই এক পাকহানাদার বাহিনীর দালাল খবর দেয় চিলমারী রাজাকার ক্যাম্পে।
জলিলের স্ত্রী সাহের বানু জানান, রাজাকাররা তার বাড়ি ঘিরে ফেললে জলিল ও মজিবর গুলি ছুড়তে ছুড়তে পাশের নওয়ারীর জংগলে আশ্রয় নেন। প্রায় ৪/৫ ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর গুলির মজুদ শেষ হয়ে যায় ওই দুই মুক্তিযোদ্ধার। এরপর তারা আশ্রয় নেয় বিশাল এক ডুমুর গাছের ফোঁকরে। এক পর্যায়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন তারা।
মাচাবান্ধা গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী সব্দুল ব্যাপারী (৯০), আবুল হোসেন (৫৫) ও বাছর উদ্দিন জানান, রাজারভিটা গ্রামের রাজাকার পঞ্চু মিয়ার ছেলে রাজাকার কমান্ডার হামিদুল, মেহের আলী ও সুবেদারীর নেতৃত্বে রাজাকারের দল মজিবর ও জলিল কে ধরে নিয়ে যায়। পরদিন তাদেরকে ব্রহ্মপূত্র নদের পারে নিয়ে যাওয়ার পর নির্মম নির্যাতন ও গুলি চালিয়ে ঝাঁঝড়া করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
মাচাবান্ধা গ্রাম ঘুরে প্রবীণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সংগে কথা বললে সকলেই সেদিনকার স্মৃতিচারণ করে বলেন, যে হামিদুল দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে লড়েছে, গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ করেছে সেই হামিদুল এখন বিএনপি নেতা। গ্রামের প্রবীণ সব্দুল ব্যাপারী বলেন, শুনেছি ওই রাজাকার কমান্ডার নাকি এখন চিলমারী বিএনপির সভাপতি।
বাবার স্মৃতি নেই, তবুও কাঁদেন গর্বিত পিতার জন্য
বিচার চান হত্যাকারীদের
রাজাকার হামিদুলের হাতে নিহত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জলিলের কন্য আলেয়া (৪০)। তার বাবা যখন যুদ্ধে যান তখন তিনি ২ বছরের ছোট্ট শিশু। তার মা বলেন, যেদিন যুদ্ধে গেল ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে চুমু দিতে দিতে বলেছিল- মা যুদ্ধে যাচ্ছি। ভালো থাকিস। সে কথা বা বাবার ঝাঁকড়া চুলের সুঠাম চেহারা- এসব কিছুরই কোন স্মৃতি এখন জাগেনা তার মনে।
গত ২৮ আগস্ট ০৮ দুপুরে তাদের বাড়িতে গেলে উনত্রিশ বছর আগের স্মৃতি নিয়ে কথা হয় আলেয়ার মা সাহের বানুর সাথে। স্মৃতিচারণ করতে করতে তাদের মুখ আলোয় উদ্ভাসিত হয়। উদ্ভাসিত আলোর কণা এক সময় তাদের দুচোখের কোণে বিন্দু হয়ে অঝোর ধারায় নামতে থাকে। বছর পর বছর ধরে যে কান্না জমেছিল তাদের মনে তা যেন বাঁধ ভাঙ্গা পানির মত বেড়িয়ে আসতে থাকে। ধাতস্থ হয় এক পর্যায়ে। বলতে থাকে কি ঘটেছিল সেপ্টেম্বরের সেই ভয়াল রাত্রিতে। গর্ববোধ করে সাহের বানু স্বামীর বীরত্ব গাঁথায়। কিন্তু এক পর্যায়ে ম্লান হয়ে যায় তার মুখ। আলেয়া বলে ওঠেন, আমার বাবার হত্যাকারীরা তো মরেনি। আজও ঘুরে বেরায়।
এরপর যখন চলে আসার পালা তখন আলেয়া চিৎকার করে বলে- আমার বাবার হত্যাকারীর যেনো উচিৎ বিচার হয়....।
বিএনপি নেতা আব্দুল বারী যা বললেন
বিএনপি চিলমারী শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী বলেন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিযেছিলেন সিলেট অঞ্চলে। তার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার খবরটি জানাজানি হলে রাজাকার পঞ্চু মিয়া তার ছেলে রাজাকার কমান্ডার হামিদুলসহ রাজাকারের একটি দল তার বাড়িতে ব্যপক লুটপাট চালায় এবং সর্বস্ব নিয়ে যায়। এরপর দেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার সবকিছু গড়ে তোলেন। সেই লুন্ঠনকারী রাজাকার তারই দলের সভাপতি হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। তখন তিনি সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, সেই সময় রাজশাহীতে বিএনপির প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত হলে সেখানে তিনি বক্তব্যে তারেক রহমানের কাছে হামিদুলের সভাপতি হওয়ার বিষয়টি আপত্তি তোলেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে তৎকালীণ মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়াসহ উর্দ্ধতন নেতৃবৃন্দের কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। উল্টো পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে।
মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী সেই রাজাকার এখন বিএনপি নেতা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।
আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন
"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন
টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।