৯৪ সালের কথা। বন্যার পানিতে থৈথৈ চারিদিক। আমি তখন ভোরের কাগজে কাজ করি। মতি ভাই (সম্পাদক) আমাকে বললেন কুড়িগ্রামের বন্যার সরজমিন করতে। আমি যথারীতি একটা ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে রওনা হলাম ব্রহ্মপূত্র নদে বানভাসি মানুষের উদ্দেশ্যে। এ অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে রওনা দিলাম ভারতের আসাম রাজ্য সংলগ্ন আমাদের গ্রাম দৈ খাওয়ার চরের উদ্দেশ্যে।
নৌকা তখনো ঐ গ্রামে পৌছায়নি, আমি দূর থেকে লক্ষ্য করলাম নদীতে কি জানি ভাসছে। আর ঐ ভাসমান জিনিষটার কাছে সাতরে কিছু মানুষ আসার চেষ্ঠা করছে। আর আরো দূরে নদীর কিনারে কিছু পুরুষ-মহিলার চিৎকার। মনে হলো নদীতে সাতরানো মানুষদের উৎসাহ দিচ্ছে। মাঝিকে বলি নৌকা তীরে ভেড়াও। তীরে গিয়ে শুনলাম ভারতীয় অংশ থেকে একটি বিয়ের নৌকা স্রোতের পাঁকে ডুবে গেছে। সেই নৌকায় থাকা নব বধুর লাশ ভেসে এসেছে।
আমি নৌকার মাঝিকে বলি চলো আমাকে লাশের কাছে নিয়ে যাও। নৌকা এগিয়ে যায় লাশের কাছে। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম তা দেখার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। লাল টুকটুকে বেনারসী শাড়ি পড়া, সিঁথীতে তখনো সিঁদুরের রং মুছে যায়নি। সেখানে সাঁতরে ভেসে থাকা ৪/৫ জন মানুষ মৃত নববধূর হাতে পড়ে থাকা সোনার রুলী ও গলার সোনার হার খুলে লুট করে নিচ্ছে। মাথা ঘুরে গেলো, যখন দেখলাম একজন মানুষ মৃত ঐ মহিলার শরীর থেকে বেনারসী শাড়ি খোলার চেষ্টা করছে। আমি ঠিক থাকতে পারলাম না।
নৌকার মাঝিকে বললাম আমাকে সাহায্য করেন, আমি এদের এই অমানবিক লুট-পাট বন্ধ করতে চাই। মাঝি বললো ঠিক আছে আমি আপনার সাথে আছি। এর পর যখন বাধা দেয়ার চেষ্টা করলাম তখন লুটেরার দল আমার নৌকা ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাতে শুরু করলো। তারা বললো আমি যদি বাধা দেই তাহলে তারা আমাকে ডুবিয়ে মারবে। আমার চেষ্টা ব্যর্থ হলো এক পর্যায়ে।
আমার অক্ষমতায় আমি নিষ্ফল ক্ষোভে শুন্যে হাত ছুড়তে শুরু করলাম। এরপর দেখলাম, চরের মানুষরা মেয়েটির শরীরের কাপড়-চোপড়, সোনা-দানা ও শাড়ি খুলে নিয়ে স্রোতে ভাসিয়ে দিলো।
ভীষন এক মন খারাপ করা অনুভূতি নিয়ে ফিরে আসি। রিপোর্ট লিখি। ফ্যাক্সে পাঠাই। পরদির প্রথম পাতায় বক্স করে ছাপা হয়.... বানের জলে নববধূর লাশ।
সেদিনের সেই দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে। নববধূর এ পরিণতিতে মনটা তখন ভীষন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় আমরা কি আসলেই সভ্য মানুষ ?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





