somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লঙ্গরখানার রুটি ও একজন হাজিরন

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চুয়াত্তর সালের কথা। তখন গোটা রংপুর জুড়ে দুর্ভিক্ষ। প্রতিদিন অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে। খোলা হয়েছে লঙ্গর খানা।এই লঙ্গরখানা কেন্দ্রিক এক বিস্ময়কর ঘটনা জানার জন্য একটু ভুমিকা টানতে হচ্ছে। আমি তখন স্কুলে পড়ি। এ সময় আমার মধ্যে তবলাবাদক হবার ইচ্ছা প্রবল। এই বাসনার কথা প্রকাশ করি আমার এক নিকটতম প্রতিবেশী বাবন ব্রহ্ম'র কাছে। তিনি একাধারে আমার বড় ভাই এবং বন্ধুও বটে। তিনি আমাকে তালিম দেয়া শুরু করলেন। কিন্তু গোড়াতেই বিপত্তি দেখা দিলো। আমি বা হাতে ডুগী বাজাতে পারিনা। ডান হাতে ডুগী বাজাই আর বা হাতে তবলা। এতে তবলার চাটি বা আওয়াজ ঠিকমতো হয়না। কিন্তু আমার ওই ওস্তাদ হাল ছাড়েন না। তিনিও ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছেন আমাকে তবলাবাদক বানাবেনই। আমার তবলার ওস্তাদ বাবনদার যথেষ্ট আর্থিক অনটন ছিলো। এ কারনে তিনি গানের টিউশনি করতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় যার বাড়িতে টিউশনি করাতে যেতেন তিনি ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। পি.আই.ও বা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। তার কিশোরী মেয়ে হেলেন গান শিখতো বাবনদার কাছে। তারা থাকতেন সি.ও ( বর্তমান উপজেলা পরিষদ )অফিসের সরকারি কোয়াটারে। এই হেলেনের বড্ড বেসুরো গলা ছিলো। এ নিয়ে এক কাহিনী আর একদিন বলা যাবে।
যাহোক, সম্ভবত অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ। বাবনদা আমাকে বললো, চল হেলেনদের বাড়িতে, সেখানে হেলেনকে গান শেখাবো আর তোকে তবলার তালিম দেবো। আমি রাজী হলাম। তখন রংপুরের এই থানায় বিদ্যুত আসেনি। হেরিকেন আর কুপীর আলোই এখানকার মানুষের সম্বল। আমরা রাত আটটার দিকে গায়ে চাদর মুড়িয়ে রওনা দিলাম হেলেনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমরা সি.ও অফিস পার হওয়ার পর যখন একটা ফাঁকা যায়গায় পৌঁছলাম, তখন অন্ধকার ফুঁড়ে এক বয়স্কা মহিলা আমাদের গতি রোধ করলো। বাবনদা তার নিস্তেজ ব্যাটারির নিভু নিভু টর্চের আলোয় মহিলার মুখ দেখে বললেন, কে রে হাজিরন ? তারপর হাজিরনের কান্না জড়িত ক্ষীন কণ্ঠ- বাবা ‌দুই দিন হাতে (থেকে) না খায়া আছোঁ (আছি)কাইল নঙ্গরখানা (লঙ্গরখানা) হাতে কয়টা উটি (রুটি)আনি মোক(আমাকে)দ্যান। বাবনদা রাজী হলো। বললো কাল দুপুরে আমার সাথে দেখা করিস, তাহলে নিয়ে দেবো। হাজিরন বাবনদার গায়ে হাত বুরিয়ে দোয়া করলো- আল্লা তোর ভালো কইরবে। এরপর আবার সে অন্ধকারে মিশে গেলো। বাবনদা আমাকে বললো এই মহিলা হেলেনদের বাড়িতে মাঝে-মধ্যে কাজ করে দেয়। বাড়ি হায়াতখাঁ গ্রামে। আমরা এরপর হেলেনদের বাড়িতে পৌঁছলাম। হেলেনের গান আর আমার তবলার তালিম হলো। এরপর শুরু হলো চা পর্ব। চা খেতে খেতে পি.আই.ও সাহেব কথা তুললেন দূর্ভিক্ষ আর দেশ নিয়ে। এই কথার ফাঁকে বাবনদা বললো, আপনাদের বাসায় হাজিরন নামে যে মহিলা মাঝে-মধ্যে এসে ফুট-ফরমাশ খাটে ওই মহিলা এখানে আসার আগে আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বললো, সে নাকি দুই দিন থেকে অনাহারে আছে। কাল লঙ্গরখানা থেকে রুটি এনে দেয়ার জন্য খুব অনুরোধ করলো। একথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে বাসার পরিবেশ মুহুর্তে বদলে গেলো। ঘরে পিন পতন নিস্তব্ধতা। ঘরভর্তি সবাই আমাদের দু'জনের দিকে বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমি নিরবতা ভাঙ্গলাম। বললাম কি হলো আপনাদের! সম্বিত ফেরে সকলের। এরপর যা ঘটলো তা অবিশ্বাস্য ও ভীতিকর। হেলেনের মা জানালো, হাজিরন অনাহারে থেকে থেকে সাতদিন আগে মারা গেছে। এ কথা শোনার পর আমার গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠলো। বাবনদা শীতের রাতেও ঘামতে শুরু করলো আর ঘনো ঘনো বাথরুম যেতে লাগলো। আমরা সহ বাড়িসুদ্ধ মানুষের তখন ভয়ে ভুতঙ্গ অবস্থা। পি.আই.ও সাহেব চিতকার করে অফিসের পাহারাদারকে ডাকলেন। কারন, জীবিত হাজিরনের চেয়ে মৃত হাজিরন তখন আমাদের কাছে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
এরপর পাহারাদার আমাদের বাসায় পৌঁছে দেয়। এঘটনার পর আমারো আর তবলা শেখা হয় নাই। সেদিনের কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। আসলে আমরা কি সেদিন হাজিরন কে দেখেছিলাম নাকি অন্য কোনো ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতীকি আত্মা ? যে আমাদের সামনে এসেছিলো আমাদের বিবেককে নাড়া দিতে ? এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা নাই।
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×