একাত্তরের ১৩ নভেম্বর ২৭ রমজান। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর থানার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের মানুষজন কেবলমাত্র সেহেরী খাওয়া শেষ করেছে। দূর থেকে আযানের সুর ভেসে আসছে ‘আছছালাতু খাইরুম মিনান্-নাউম......। আযানের পবিত্রতাকে খান খান করে দিলো পাকবাহিনীর এলোপাতারি গুলির আওয়াজ। আর দশজন গ্রামবাসীর মতো আনন্তপুর গ্রামের বাতাসী বেওয়া নামাযের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নামাজ পড়া হলো না। বাতাসী তাঁর ছেলে বক্তার আলী ও মেয়ে রহিমাকে নিয়ে আবছা আলো-আঁধারিতে বাড়ির পাশে ধান ক্ষেতে লুকিয়ে পড়লেন।
আস্তে আস্তে সকালের আলো ফুটে উঠেছে, পাকবাহিনী ততক্ষণে গোটা গ্রামটাকে ঘিরে ফেলেছে। বাতাসী তাঁর ছেলে বক্তার আলী ও মেয়ে রহিমা ৩ জন বেলুচ সেনার হাতে ধরা পড়লেন। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো বাড়ি থেকে কিছু দূরে দাগারকুঠি গ্রামে। তাঁর মতো আরো দুই শতাধিক লোককে লাইন করে দাঁড় করানো হয়েছে। এরই মধ্যে বক্তার এক পাকসেনার হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নেয়। বাট দিয়ে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেয় ওই হানাদারকে। বাকি দুজনের রাইফেল তাক করে ট্রিগারে টান দেয়। কিন্তু গুলি বের হয় না। সে জানতো না, রাইয়েলে গুলি ছোড়ার আগে কক্ বা বোল্ট করার পর সেফটি ক্যাচ অন করতে হয়। এই অজ্ঞতা ধরে ফেলে অপর পাকসেনাটি। সে সাথে সাথে বক্তারের পেটে গুলি চালায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। এরপর দুই পাকসেনা বেয়োনেটের ডগা দিয়ে বক্তারের চোখের মনি তুলে ফেলে। এক পর্যায়ে তপ্ত বুলেট দিয়ে বক্তারের কপালে লাল টিপ এঁকে দেয়। আর এই লোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটে বক্তারের মা বাতাসী বেগমের চোখের সামনে। আবার গুলির শব্দ হয়। মনে হয় শরীরের গরম কিছু প্রবেশ করছে। জ্ঞান হারান তিনি। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন সন্ধ্যে, ছেলে বক্তার ও তার পাঁচ চাচা মারা গেছেন। পাকবাহিনী চলে গেছে। চতুর্দিকে থেমে থেমে কান্নার আওয়াজ।
তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেদিনের পৈশাচিক ঘটনা চোখবন্ধ করলেই সামনে এসে হাজির হয়। তখন থর্ থর্ করে কাঁপতে থাকেন তিনি। কিন্তু চোখ বেয়ে শোকের অশ্রু নামে না। যেনো এক পাথরের মুর্তি। ইতিহাসের এক করুণ ¯^v¶x| এভাবেই বললেন, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা একাত্তরে জোয়ান ছেলে হারানোর সেই বীরত্ব আর শোকাবহ কাহিনী।
আজ শনিবার। ৩৯ বছর পর আবার ফিরে এসেছে সেই শোকাবহ দিন। বাতাসীর এই পাথর সময়ে এতটুকু পরিবর্তন আসেনি। তার ভিটে মাটি একাত্তরের পাকবাহিনীর মতো নির্মম ক্রোধে কেড়ে নিয়েছে নদী । ৭৮ বছররের অসুস্থ্য শরীরে এখন থাকেন দিনমজুর জামাইয়ের আশ্রয়ে। তারই দয়ায় দিন কাটে তার - ছনের বেড়ার এক দরজা বিহীন ঘরে। সাহায্য তো দুরের কথা। এখন পর্যন্ত পাননি শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





