somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিন্তার ইতিহাসে: ধর্ম কী

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চিন্তার ইতিহাসের দুই পর্যায়: ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন
ধর্মকে ভক্তিভরে দেখা যায় আবার একটা চিন্তা হিশাবে দেখা যায়। যারা চিন্তা হিসাবে দেখতে মানসিকভাবে তৈরি নন এই পোষ্ট তাদের জন্য নয়। অনেক সময় কোন পোষ্টের মন্তব্যে আমি যখন ধর্মতত্ত্ব (Theology) শব্দটা ব্যবহার করেছি, টের পেয়েছি পাঠকের অনেকের কাছে বুঝা-না-বুঝার মাঝখানে থেকে গিয়েছে ব্যাপারটা। সেসব চিন্তা করে, ধর্মকে একটা চিন্তা হিশাবে দেখার উপর দাঁড়িয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করব। ধর্ম ও দর্শন নিয়ে আলোচনা সমাজে হয় না বলেই চলে। ব্যাপারগুলো শেষ পর্যন্ত বড় জোড় দ্রুত জামাত রাজাকার পর্যন্ত ঠেকে গালাগালির রাস্তা ধরে শেষ হয়ে যায়। ফলে এখানে একটা চেষ্টা নেব, ছোট ছোট করে হলেও এনিয়ে কোন সিরিয়াস আলোচনা টানতে পারি কী না।

দর্শনের ইতিহাস মানে চিন্তার ইতিহাস। তাহলে দর্শন আর চিন্তা - এই দুইয়ের সম্পর্ক কী? একই জিনিষ? হ্যাঁ, একই জিনিষ; তবে চিন্তা মানে ধর্মতত্ত্ব হতে পারে, আবার দর্শনও হতে পারে। চিন্তার একটা বড় পর্যায় কেটেছে ধর্মতত্ত্বে, ধর্মতত্ত্বের ইতিহাস হয়ে, এরপর কেটেছে দর্শনে, দর্শনের ইতিহাসে যতক্ষণ পর্যন্ত না কার্ল মার্কস এসে দর্শনকে ব্যবহারে চর্চায় একে প্রতিষ্ঠা করার বিষয় ফলে দর্শনচর্চার নতুন নাম রাজনীতি বলে মানে দিয়েছেন। তাহলে, ধর্মতত্ত্ব বলতে কি বুঝাচ্ছি? দর্শনের সাথে তার তফাৎ কোথায়?
বলা হয়ে থাকে জর্মন দার্শনিক ফ্রেডরিক হেগেল দর্শনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে একটা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন ও মোকাবিলাও করেছেন। তাই হেগেল বরাতেই এপ্রসঙ্গে কিছু কথা শুনি। তাঁর কথাটা এরকম, " ধর্মের দাবি হচ্ছে - ওর মারফত সত্যের যে রূপ আমাদের সামনে নাজিল হয় মানুষের মধ্যে তার আবির্ভাব ঘটে বাইরের আমদানি হিসাবে; এই বরাতে এটাও ধর্মের দাবি যে মানুষ যেন বিনয়ের সঙ্গে তা মেনে নেয় কারণ নিজের মুরোদে মানুষের চিন্তাশক্তি ঐ কামেলিয়াত হাসিল করতে পারে না"। এর মানে হলো, মানুষের চিন্তাশক্তি যখন মুরোদহীন ছিল, নিজেকে নিজে জানতে শেখেনি, চিনে না, তাঁর চিন্তা স্বাধীন নয়, নিজে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে নাই, আছেময়তা (being) এর সত্য বা জ্ঞানকে নিজেই আবিস্কার বা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম নয় - তখন সত্য বা জ্ঞান তাঁর কাছে নবী রসুলের মারফতে নাজিল হয়েছিল, এছাড়া পথ ছিল না। তাঁর চিন্তা তখন অতটুকুই স্বাধীন যে ভাবতে পারে নবী-রসুল বা অবতারের মারফতে সত্য বা জ্ঞান তাঁর কাছে আসে। তাঁর চিন্তার সত্যতা কী? তাঁর চিন্তার সত্যাসত্যের যাচাই কে করবে, কীভাবে করবে তা সে নিজের চিন্তার তৌফিকে হাজির করতে অক্ষম। তাই চিন্তার সত্যতা সে নিজের চিন্তার বাইরে থেকে হাজির করে, বাইরে কোথাও অবস্হিত, গায়েবি - এটা সেই অবস্হা। চিন্তা নিজে তার চিন্তার সত্যতা প্রমাণ করে না, করে চিন্তা যারা করতে পারে তাদের বাইরের বরাতে। চিন্তা যখন তার সত্য বা জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা চিন্তার বাইরের উৎসের বরাতে সংগ্রহ করে হাজির এটাই ধর্মতত্ত্ব বা Theology। এখানে যেটা গুরুত্ত্বপূর্ণ তা হলো, বাইরের উৎসের বরাতে হলেও আসলে তখনও এটা কিন্তু চিন্তাই; চিন্তার ধর্মতাত্ত্বিক পর্যায়। এপর্যায়ে চিন্তা নিজেকে মানুষের ইন্দ্রিয়পরায়ণ তৎপরতা হিসাবে তো নয়ই নিজের চিন্তাশক্তি দিয়ে নিজের অস্তিস্ত্ব বা আছেময়তাকে টের পেতে শিখেনি।
অনেকে বিতর্ক করতে পারেন এই বলে যে মানুষের চিন্তার উপর ভিত্তি করে চিন্তালব্ধ জ্ঞানের সত্যতার উপর ভরসা করা যায় না। এরচেয়ে গায়েবি বরাতের সত্য বা জ্ঞান ভাল। কথাটার মানে হল যেন একজন বলছে, এই দুনিয়াটা একটা মায়া, এর কিছুই সত্যি না। এর কিছুই জ্ঞেয় বা চিন্তায় জ্ঞানলাভ যোগ্য নয়। এককথায় মানুষের পক্ষে নিজ মুরোদে নিশ্চয়তাজ্ঞান সম্ভব নয়। আসুন, তাহলে এটা কথাটা বিচার করে দেখি।
দুনিয়াতে মানুষই একমাত্র চিন্তা করতে পারে। একজন দাবি করছে, "মানুষ চিন্তা করে দেখেছে তাঁর পক্ষে জ্ঞানের যাচাই বিচার করা সম্ভব নয়"। ফলে চিন্তার বাইরে গায়েবি উৎস ছাড়া তার ভরসা ও নিস্তার নাই। পাঠক লক্ষ্য করবেন, বয়ানটা নিজেই একটা বিচারমূলক বা যাচাইমূলক বয়ান। এবং বয়ানটা নিজে দাবি করছে মানুষের চিন্তার পক্ষে সত্যাসত্য যাচাই বিচার করা সম্ভব নয়। তাহলে দাঁড়াচ্ছে, বয়ানটা নিজেও সত্য নয়। কারণ ওটা মানুষের চিন্তারই একটা বয়ান। যারা বিতর্ক করছিলেন মানুষের চিন্তার পক্ষে সত্য বা জ্ঞানলাভ অসম্ভব তাদের মত করে ভাবতে গিয়ে এএক মহা ফাঁপড়ে পড়লাম দেখা যাচ্ছে।
এখান থেকে তাহলে আমরা কী শিখলাম? বয়ান দাঁড় করাতে চাইলে আগে মেনে নিতে হবে, মানুষের চিন্তার পক্ষে বয়ানের সত্যাসত্য যাচাই বিচার সম্ভব। চিন্তা নিজেই নিজের চিন্তার একমাত্র বিচারক। চিন্তা যাচাইকর্তা না হলে সত্যাসত্যের নিশ্চয়তা, জ্ঞান, বয়ান কিছুই সম্ভব না। চিন্তার সত্যতা চিন্তার বাইরের বরাতে, গায়েবি থাকতে পারে না।

চিন্তা স্বাধীন, স্বাধীনভাবে সে ভাবতে পারে:
চিন্তার সত্য চিন্তার বাইরে থেকে নয়, চিন্তার ভিতর থেকেই যাচাই সম্ভব ফলে বাক্য বয়ান সম্ভব। অতএব চিন্তা স্বাধীন, স্বাধীনভাবে সে ভাবতে পারে - একথা মেনে নেয়া। যতদিন পর্যন্ত চিন্তা এটা বুঝে নাই, চিন্তাশক্তির মুরোদ হয় নাই ততদিন গায়েবি উৎসের বরাতে চিন্তা নিজেকে হাজির করেছে। এটাই সব ধর্মের ধর্মতত্ত্ব। মানুষের চিন্তার ধর্মতাত্ত্বিক পর্যায়।
বিপরীতে চিন্তাশক্তির মুরোদ হওয়া মানে চিন্তার সত্যাসত্য যাচাইয়ের ক্ষমতা টের পাওয়া মানে চিন্তার টের পাওয়া চিন্তা স্বাধীন, স্বাধীনভাবে সে ভাবতে পারে। এবার তাই দর্শন সম্ভব। চিন্তার সত্যাসত্য জ্ঞান, যাচাই বিচার চিন্তা নিজেই করে বলে জানে মানে - চিন্তা যাচাই বিচারের এক ক্রমাগত প্রক্রিয়ার শুরু, এটাই দর্শনের ইতিহাসের গোড়া। চিন্তার দার্শনিক পর্যায়।
দর্শনের ইতিহাস (History of Philosophy) লিখতে গিয়ে হেগেল কোথা থেকে শুরু করবেন, কেন করবেন - তা ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল আগে। ধর্মতত্ত্ব আর দর্শনের সীমারেখা টেনে তিনি বলেছিলেন, দর্শন শুরু হতে গেলে চিন্তার স্বাধীনতা হচ্ছে এর পয়লা নম্বর শর্ত। এছাড়া আরও শর্তের কথা তিনি বলেছিলেন, যেমন পুব বা প্রাচ্যকে (Oriental Consciousness) গোনায় ধরা যাবে না, কারণ ওখানে দর্শনের আবির্ভাব ঘটে নাই, পশ্চিমেই একমাত্র ঘটেছে ইত্যাদি। আমি এখন সেদিকে যাচ্ছি না।
যে বাক্য দিয়ে শুরু করেছিলাম, ধর্মকে ভক্তিভরে দেখা যায় আবার একটা চিন্তা হিশাবে দেখা যায়। ধর্মকে ভক্তিভরে দেখা মানে ধর্মের অর্থ এখানে ধর্মতত্ত্ব (Theology)। ধর্মকে চিন্তা হিশাবে দেখা মানে চিন্তার দার্শনিক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দেখা। তবে ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে নয়। কারণ এখন তার দৃষ্টি আর ধর্মতাত্ত্বিক হতে পারে না। নিজের পিছনের চিন্তাকে, সত্য ও জ্ঞানকে চিন্তা কীভাবে প্রকাশিত করেছিল (গায়েবি বরাতে হলেও) তাকে বিচার করে দেখা। এখানে ধর্ম মানে চিন্তা, Religion অর্থে, আর বিচারের কাঠিটা দর্শনের (Philosophy)। এই শেষের বাক্যটা গুরুত্ত্বপূর্ণ।
এখানে এই রচনাকে কেউ নাস্তিক হবার উপাদান সংগ্রহে কাজে লাগাতে উৎসাহিত বোধ করলে নিজেকে ঠকাবেন ও আমাকে অবিচার করবেন। কোন লেখায় ধর্মতত্ত্বকে সন্ধান করে নেবেন, সমালোচনা করবেন ঠিক আছে। কিন্তু ধর্মগ্রন্হ বা ধর্মগুলোকে (Religion) চিন্তা হিসাবে বিবেচনা করে ওর থেকে প্রকাশিত সত্য ও জ্ঞান থেকে উপাদান বের করে আনার দায় কর্তব্য আমাদের শেষ হয়ে যায়নি। চিন্তার বা মানুষের যেসব সমস্যাগুলোকে ধর্ম (Religion) সমাধান করতে গিয়েছিল ধর্মতাত্ত্বিকভাবে, তার অনেক কিছুই এখনও অসমাপ্ত। এর দায় আমাদের আছে। এলক্ষ্যে একটা বিচার পর্যালোচনার বিস্তর কাজ পড়ে আছে আমাদের জন্য। এই পর্যলোচনার কাজকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোনোর কোন সর্টকার্ট রাস্তা নাই। আমরা ধর্ম মানি না বলে চিৎকার করে ঘোষণা করতে পারি; এতে যা বুঝাই তা হতে পারে বড়জোড় ধর্মতাত্ত্বিক অর্থে ধর্ম মানি না। কিন্তু চিন্তা অর্থে ধর্ম (Religion) এর পর্যালোচনার কাজ তাতে সম্পন্ন হয়ে যায় না।
প্রচলিত অর্থে ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি, বুঝাতে চাই তা আসলে ধর্মতত্ত্ব। চিন্তা অর্থে ধর্ম (Religion) কী এটা যদি আমরা বুঝতে পারি তবে এই আলোচনার একটা গতি হবে।
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×