ধারাবাহিক উপন্যাস : রঙমহল
= পার্থসারথি
নকশা করা খাট। খাটের চারদিকে নকশা করা রেলিং। শুধু সামনের রেলিং-এর মাঝখান দিয়ে সিড়ি নেমে মেঝেতে বসেছে ; ওইখান দিয়েই ওঠানামা করতে হয়। বড়কর্তার ঘরের লোহার সিন্দুকটা আজই আনানো হয়েছে ; আগে দোতলায় ছিল। সিন্দুক আনাতে মমতাময়ী দেবী কোনরকম বাধা দেন নি। নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছেন; প্রিয়নাথতো এখন সব ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশুনা করে। যাবতীয় নগদ অর্থ-কড়ি ওকেই নাড়াচাড়া করতে হয়। বারবার, কতবার আর দোতলায় সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠবে আর নামবে।
কিছুদিন পূর্বে প্রিয়নাথ ওর কোঠার ভেতরকার নকশা কিছু পরিবর্তন করিয়েছে। আগের চেয়ার টেবিল সরিয়ে নতুন নকশার টেবিল-চেয়ার বসিয়েছে। তবে কাঠের দেয়ালে বসানো শৌখিন আলমারীটা সরায় নি। ডাইনিং টেবিলটার পাশেই কাঠের টানানো কয়েকটা চিত্রকর্ম ; অবশ্য সবগুলোই প্রাকৃতিক দৃশ্য। অস্ত যাওয়া চিত্রকর্মটা প্রিয়নাথের খুব প্রিয়।
টেবিলের উপর সাজানো থরে থরে ফলের সামাহার। বাবা সুদর্শন চৌধুরী ও মেয়ে রাসময়ী দেবী মুখোমুখি বসা। সুদর্শন বাবু এক হাতে খাচ্ছেন আর অন্য হাতে কথাগুলো মেয়েকে বুঝানোর কাজে ব্যবহার করছেন। সুদর্শন বাবু এমনভাবে কথা বলছেন মেয়ে রাসময়ী দেবী না ঝোকে কিছুই বুঝতে পারছেন না। খুব কাছাকাছি হয়ে বাবার-বলা কথাগুলো গোগ্রাসে লুফে নিচ্ছেন। তবে চিন্তাকিষ্ট রাসময়ী তৎণাৎই ভেবে নিচ্ছেন পরিণতির ফলাফল ; যা কপালের ভাজে ভাজে ফুটে ওঠছে।
সুদর্শন বাবু একটা আঙ্গুর মুখে পুরে বলেন- আমি যা বলছি খুব ভেবে-চিন্তে বলছি।- বলে আশে-পাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।
রাসময়ী দেবী বেশ চাপা কন্ঠে বলেন- বাবা ! কিন্তু ,.. ?
সুদর্শন বাবু হালকা ধমকের সুরে বলেন- কোন কিন্তু নয়। আমি যা বলি কখনও মিথ্যা হয় না। দেখবি পরে না-আবার তোকে পথে বসতে হয়। তোর শ্বাশুড়ীকে আমার চেয়ে আর কেউ বেশি চেনে না। তাছাড়া শয়তান সুবিমল আছে, সে কখনও তোর স্বামীর মঙ্গল চাইবে না। দেখিস না ? সবসময় কেমন কেউটের মত তোর শ্বাশুড়ীর আচলের ভেতর ঢুকে থাকে। যা বলছি সময় থাকতে সব গুছিয়ে নে।
রাসময়ী দেবী- তুমি তোমার জামাইকে বুঝিয়ে বলবে। ও আবার তোমার কথা ফেলতে পারবে না।
তুই-ই বুঝিয়ে বলিস,.. আমি না-হয় পরে দেখব।
প্রিয়নাথ গলা খাকাড়ি দিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন।
বাবা প্রিয়, তোমার জন্য অপো করতে করতে শেষে নাস্তা শুরু করে দিলাম তোমাকে রেখেই।
ঠিক আছে বাবা, কোন অসুবিধা নেই। এ টা তো আপনার মেয়ের বাড়ী। কোন সংকোচ করবেন না।
একটা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে সুদর্শন বাবু বলেন- বস বাবা, এ চেয়ারটায় বস। এক সাথেই খাই।
প্রিয়নাথ ডাইনংি টেবিলের চেয়ারে না বসে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। সুদর্শন বাবুর মনটা মলিন হয়ে গেল। বাবার মলিন মুখ দেখে রাসময়ীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। সুচতুর সুদর্শন বাবু পরিবেশটা সামলে নিয়ে বলেন- মা রাসু, প্রিয়কে এক কাপ চা দাও, মনটা চাঙ্গা হবে। বিকেলে এক কাপ চা না হলে মেজাজটাই বিগড়ে থাকে। আমার চা-টা একটু কড়া করে দিও।
কোন কথা না-বলে রাসময়ী দেবী চায়ের কাপে চা ঢালেন। তারপর দু’জনের হাতে তুলে দেন। নিজেও এক কাপ তুলে নেন। চীনা মাটির কেটলিটা বহু-বছরের পুরনো। বড় কর্তার সংগ্রহের জিনিস। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সুদর্শন বাবু বলেন- বা ! চা-টা এখনও টাটকা আছে। আমি ভেবেছিলাম এতণে ঠান্ডা হয়ে জল হয়ে গেছে।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়েই সুদর্শন বাবু চেয়ার ছেড়ে ওঠেন এবং পকেটে হাত দিয়ে পকেটটা দেখে নেন টাকাগুলো ঠিক আছে কি-না। রাসময়ী দেবী তাকান প্রিয়নাথের দিকে। প্রিয়নাথ নির্বিকার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যাচ্ছেন। আর ভাবছেন অনাগত ভবিষ্যত। চোখের তারায় তারায় ঝিলিক দিচ্ছে নতুন প্রভাতের নতুন মুহূর্ত। রাসময়ী দেবী পিতাকে বিদায় দিয়ে ফিরে আসেন।
***
সময়ের চাকা ঘুরতে ঘুরতে আরও একটা যুগ পেরিয়ে গেল। প্রিয়নাথ তিন কন্যা সন্তানের জনক। শম্ভুনাথ এক পুত্র সন্তানের জনক। ত্রিনাথ অবশ্য এখনও বিয়ে করেনি। সুনয়না শ্বশুড় বাড়িতে সুখেই আছেন ; স্বামী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। অনিমেষ দশম শ্রেণীতে পড়ছে। মমতাময়ী দেবী অনেকটা বুড়িয়ে গেছেন।
শম্ভুনাথ প্রিয়নাথের সাথে ব্যবসায় আছেন। ত্রিনাথটা একটু উড়নচণ্ডী স্বভাবের। বিয়ে তো করেই নি । এমন কোন অপকর্ম নেই যা ত্রিনাথ করে না। অনিমেষটা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আবার ফাকে ফাকে গান-বাজনা-নাটক নিয়ে সময় কাটায়। তা অবশ্য লেখাপড়ার পর। তবে অনিমেষটা ত্রিনাথের একনম্বর চেলা। ত্রিনাথ যা বলবে অনিমেষ তা চোখ বন্ধ কওে নির্দ্বিধায় মেনে নেবে। ভাল-কি মন্দ তা বিবেচ্য বিষয় নয়। ছোট’দা বলেছে তা অবশ্যই ঠিক- এমনই ধারণা ত্রিনাথ সম্পর্কে। অনিমেষটা ভাই-দাদা বলতে অজ্ঞান। এতে মা মমতাময়ী দেবীও বেশ পুলকিত হন এই ভেবে যে, ছেলেগুলো বেশ মিলেমিশেই আছে। মমতাময়ী দেবী প্রিয়নাথকে প্রচন্ড ভালবাসেন। কারণ ও খুব দায়িত্বশীল। মমতাময়ী দেবীকে নিজের মায়ের আসনেই বসিয়েছেন। প্রতিদিন মায়ের ভাল-মন্দ খোজ নেন; সুবিধাঅসুবিধা, পছন্দ-অপছন্দ সব কিছুরই খোজ রাখেন। অনিমেষ কোন কিছুর আবদার করলে মা মমতাময়ী বলেন- প্রিয়র কাছে যা’ ।
অনিমেষ পারত:পে বড়’দার মুখোমুখি হয় না। যা বলার বউ’দিকে দিয়েই বলায়।
অনিমেষ সেই কখন থেকে ঘুর ঘুর করছে। কিন্তু বড়’দা প্রিয়নাথ আজ বাড়িতেই আছেন। কীভাবে যে বউ’দিকে কথাটা বলবে সেই চিন্তায় অনিমেষ অস্থির চিত্তে বারবার এসে চুপি দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেয়ারটেকার রঘুনাথ মালি এসে অনিমেষকে খুজে বের করল, তারপর বলল- ছোট কর্তা তুমি এখানে ঘুরঘুর করছ। আর আমি তোমাকে খুজছি সেই কখন থেকে।
অনিমেষ তেমন একটা আগ্রহ না-দেখিয়েই বলে - কেন, আমাকে আবার দরকার পড়ল কেন?
তোমার বন্ধু হাবিব সাহেব তোমার খোজে এসেছেন।
অনিমেষ খানিক কী যেন ভাবল, তারপর বললÑ কোথায় হাবিব ?
গেইটের বাইরেই দাড়িয়ে আছেন।
কেন, বৈঠক ঘরে নিয়ে বসাতে পারলে না?
না, মানে , উনিই বাড়ীর ভেতরে আসতে চাচ্ছেন না।
তোমাদের নিয়ে আর পারলাম না।
কী করব কর্তাবাবু, আমি তো বলেছি, উনি বললেন তাড়া আছে, তোমার বাবুকে ্একটু তাড়াতাড়ি ডেকে দাও।
ঠিক আছে, ঠিক আছে যাচ্ছি।
তুমি হাবিবকে বৈঠক ঘরে ডেকে নিয়ে বসাও আমি এুণি আসছি।
রঘুনাথ মনটা বেজাড় করে হাবিবকে ডাকতে যায়।
বাড়ির ভেতরে মেহমান আসলে আপ্যায়ন করাটা এ বাড়ির রীতি ; এতে রঘুনাথের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কারণ মেহমান আসলে সাথে সাথে নিজেরও পেটে কিছুটা পড়ে। রঘুনাথ অবশ্য কিছুটা পেটুক টাইপের। খাবার দেখলে নিজেকে সামলাতে পারেন না। ‘ পেট যতই ভরা থাকুক’ চোখের সামনে খাবার আসলেই জিভে জল এসে যায়। না-খেয়ে আর থাকতে পারেন না। কিন্তু হাবিব সাহেব আসাতে তেমন গরজ দেখায় নি। কারণ ‘শেখ’-রা বাড়িতে এলে ( হিন্দুদেও কাছে সকল মুসলিমই শেখ ; তুচ্ছার্থে ) অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। ওদেও ছোয়া খাবার তো খাওয়া যায়ই না তার ওপর খাবার দেয়া থালা-বাসন সাথে সাথেই ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ফেলতে হয় এবং øান সেরে আসতে হয়।
বাবু বাড়িতে শেখদের আনাগোনা সেই বড়কর্তা নারায়ণ বাবুর সময় থেকেই। তবে এ যাতায়াত শুধু বৈঠক ঘর পর্যন্ত। ভেতর ঘরে এ পর্যন্ত কোন শেখের পদার্পণ ঘটেনি। আগে বৈঠক ঘরেও যারা আসত প্রয়োজনেই আসত। তবে দশক-দেড়দশক বছরে এর হাওয়া অনেক পাল্টে গেছে। ত্রিনাথ এবং অনিমেষের অনেক বন্ধু আছে। যাদের সাথে ওদেও অহরহ ওঠা-বসা। এরা যাচ্ছে ওদেও বাড়িতে আবার ওরাও এদেরে বাড়িতে আসছে। অনিমেষ তো কয়েক কাঠি এগিয়ে আছে ; গোপনে বন্ধুদের বাড়িতে খেয়েও আসে। তবে এ খবর শুধু ওর বন্ধু হাবিব এবং হাবিবের মা জানে।
চলবে ,..

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




