ধারাবাহিক উপন্যাস : রঙমহল
= পার্থসারথি
মা মমতাময়ী দেবীর নির্দেশ শেখদের বাড়ীতে যেন এক গ্লাস জলও না খায়। কীভাবে যেন মমতাময়ী দেবীর কানে চলে আসে ; অনিমেষ হাবিবদের বাড়ীতে জলখাবার খায়। অনিমেষের ডাক পড়ে।
মমতাময়ী দেবী অনিমেষকে ডেকে কাছে বসান। তারপর মাথার চুলে বিনুনি কেটে সোহাগী কন্ঠে বলেন- ‘ অনি, তোমার ব্যাপারে কীসব শুনি?’
অনিমেষ মায়ের দিকে না তাকিয়ে বলে- কী মা?
তুমি না-কি হাবিবদের বাড়ীতে জলখাবার খাও?
অনিমেষ বেশ বুদ্ধি রেখেই চলে। জানে এসব তথ্য রঘুনাথ পাচার করেছে। মাথা গরম করলে চলবে না। বেশ ভেবে চিন্তেই অনিমেষ বলে- তোমার কী মনে হয় মা ?
অনি, চালাকি করবে না। আমি যা জানতে চেয়েছি তার জবাব দাও।-এবার মমতাময়ী দেবীর কন্ঠে একটু ঝাঝ ছড়িয়ে পড়ে।
অনিমেষ নিজেকে সামলে নিয়ে, মাকে জড়িয়ে ধরে বলে- মা, তুমি বিশ্বাস কর, আমি হাবিবদের বাড়ীতে কিছুই খাই নি।
তবে কী রঘু মিথ্যে বলেছে? রঘু, এই রঘু,.. মমতাময়ী দেবী রীতিমত চেচিয়ে ডাকলেন।
রঘুনাথ দরজার পাশেই দাড়িয়ে চুপি চুপি সব শুনছিল। ডাকা মাত্রই রঘুনাথের জবাব- গিন্নীমা, আমাকে ডেকেছেন?- এই বলে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল রঘুনাথ।
অনিমেষ চোখ পাকিয়ে তাকাল রঘুনাথের দিকে। রঘুনাথ নিজেকে যেন বেশ গুটিয়ে নিল। রঘুনাথ এক পা এগুচ্ছে তো দু'পা যেন পিছিয়ে যাচ্ছে।
মমতাময় দেবী বেশ ঝাঝালো কন্ঠেই বললেন- তুই ওরকম করছিস কেন? তুই না বললি,.. ।
রঘুনাথ অনিমেষের ভয়ে কন্ঠস্বও পরিস্কার করে কিছুই বলতে পারছে না। শুধু আমতা আমতা করতে লাগল- না, মানে, গিন্নীমা,.. না মানে,.. ।
অনিমেষ এই ফাকে এক ধমক বসাল- রঘু কাকা, তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছ। আমি হাবিবদের বাড়িতে জলখাবার খেয়েছি তা তুমি কী করে দেখলে?
না,.. মানে,.. রঘুনাথ কোনকিছুই বলতে পারছে না।
আবার যদি কোনদিন মা'র কাছে এসে মিথ্যে বল তবে এর পরিণাম খুব খারাপ হবে । যাও বলছি,.. সুযোগে তাড়াতাড়ি তাড়াতে চাচ্ছে রঘুনাথকে।
মমতাময়ী দেবী আর কথা বাড়ায় না। রঘুনাথ চুপচাপ চলে যায়। এবার অনিমেষকে আদও করতে করতে মমতাময়ী দেবী বলেন- অনি,বাবা, রঘু কিন্তু মিথ্যে বলে নি, তোর ভয়ে ্ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। এ রকম করে না, বাবা। আমরা সমাজ নিয়ে থাকি। যদি জানাজানি হয়ে যায় তবে রক্ষা নেই। এক ঘরে করে রাখবে।
অনিমেষের বুকের ভেতরটা কেপে ্ওঠে। মা! একি বল তুমি ?- আমি মানুষ হাবিব্ও মানুষ। দেহের ভেতরে রক্তের এতটুকু পার্থক্য নেই। আমার রক্ত যেমন লাল হাবিবের রক্ত্ও লাল। একসাথে ্ওঠা-বসা করি অথচ স্নানাহারে বিধি-নিষেধ। সমাজের এ নিয়ম তো কখন্ও মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। মানুষে মানুষে বাড়ানো থাকবে শুধু বন্ধুত্বের হাত। কিন্তু সমাজ নামের এ বিধি-নিষেধে হাটা সত্যিই কষ্টকর। এ শৃংখল থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। ধর্মের সুনিপুণ ব্যাখ্যাকে দুর্মুখ-পন্ডিতেরা নিজেদের স্বার্থের ছাচে ঢেলে সাজিয়ে নিয়েছেন।
মমতাময়ী দেবীর তাগিদে অনিমেষের সম্বিত ফিরে আসে। অনিমেষ এবার মা’র কাছে বিনয়ের সাথে জানতে চায়- আচ্ছা মা, ধর আমি হাবিবদেও বাড়িতে জলাহার করেছি তাহলে তুমি কী করবে?
মমতাময়ী দেবী চোখ বড় বড় করে ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে প্রণাম করতে করতে বলেন- হায় , রাম রাম ! ঠাকুর দেখ আমার ছেলে কী অলুক্ষণে কথা বলে। ঠাকুর আমায় রক্ষা কর। আমার ছেলের ভীমরতি হয়েছে। এবার স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে অনুনয় করে বলেন- দেখ তোমার ছেলের মুখে কী কথা বেরুচ্ছে। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
আহা! মা, তুমি আমার কথাটুকু আগে শোন। আমি তো খাই নি বা খেতে যাচ্ছি না। শুধু ‘ যদি’ হয় তাহলে কী করবে সেটাই জানতে চাচ্ছি।
মমতাময়ী দেবী আহাজারি করতে শুরু করলেন। বড় বউ রাসময়ী দেবী রীতিমত দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করলেন, মা, মা, আপনার কী হয়েছে? অনি কিছু বলেছে না-কি?
মমতাময়ী দেবী ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগলেন- ঠাকুর আমি কী পাপ করেছিলাম, আমাকে এমন কথাও শোনার জন্য বাচিয়ে রেখেছ তুমি!
রাসময়ী দেবী অনিমেষের মুখোমুখি দাড়ান। তারপর শাসনের সুরেই বলেন- অনি, তুমি মাকে কী বলেছ?
কথাগুলো অনিমেষ রাসময়ী দেবীকেও শুনিয়ে দিল। রাসময়ী দেবী একেবারে বাকরুদ্ধ। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন- ঠাকুরপো, তোমার মাথা ঠিক আছে তো না-কি?
বউ’দি আমি সজ্ঞানে এবং পুরোপুরি সুস্থ মস্তিষ্কে বলছি। আমি তো শুধু জানতে চেয়েছি।
শোন ঠাকুরপো, সমাজে থাকতে হলে সমাজের রীতিনীতি মেনেই তবে চলতে হয়। তাছাড়া শেখদেও কাছ থেকে যতদূরে থাকবে ততই মঙ্গল।
কেন বউ’দি? সমাজ যদি আমাকে আগুনে ঝাপ দিতে বলে, আমি তাই করব না-কি?
সমাজ তোমাকে শুধু শুধু আগুনে ঝাপ দিতে বলবে কেন?
শোন তাহলে, এই সমাজই এক সময় সতীদাহ প্রথা চালু রেখেছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর জীবন্ত স্ত্রীকে জোর করে চিতায় তুলে দিত। আর জীবন্ত একটা রমণীর চিতকারে আকাশের বাতাস ভারী হয়ে ্ওঠত। কিন্তু ্ওই সমাজের সমাজপতিদের মনে একটুও আচড় পড়ত না। এটা কী ভাবতে পার ? চলবে,..

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




