ধারাবাহিক উপন্যাস : রঙমহল
> পার্থসারথি
বৈঠক ঘরে হাবিবুর রহমান হাবিব। একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। সামনেই টেবিলে কিছু ফল, গুটিকতক লুচি আর মিষ্টি মেশানো ছানা ; এই প্লেটগুলো সংরতি থাকে শুধু মুসলিম অতিথিদের জন্য। পাশেই রঘুনাথ চুপচাপ দাড়িয়ে। পরনে একটা পুরনো গামছা। ডান হাতটা বুকের উপর আড়াআড়ি করে রাখা। অন্য হাতে গামছা ধরা। দৃষ্টি হাবিবের ্ওপর।
হাবিবের কাছে এ পরিবেশটা খুবই অস্বস্তিকর লাগছে। নিজেকে বেশ অপমানিত বোধই করেন হাবিব। এ বাড়িতে এলে কোন খাবারই খেতে ইচ্ছে করে না। শুধু অনিমেষটার কারণেই ্ওকে এখানে আসতে হয় আবার খার্বাও খেতে হয়।
হাবিব বেশ বিরক্ত ভাব নিয়েই বলেন- আচ্ছা রঘুকাকা, একটু আগে তোমাকে দেখলাম ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে ছিলে। আর এখন তোমার এ অবস্থা কেন? তোমাকে ভিখারীর চেয়েও খারাপ লাগছে। কেমন যেন পাগল পাগল মনে হচ্ছে। বিষয়টা কী বল তো ?
রঘুনাথ মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। ফিরেও তাকাচ্ছে না।
হাবিব আবার তাগাদা দেন- ভয় নেই রঘুকাকা, তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার। তাছাড়া আমি কিছু মনে করব না।
রঘুনাথ এবার একটু নড়েচড়ে দাড়ায়। তারপর গলা ঝেড়ে-কেশে পরিষ্কার করে বলেন- গিন্নীমার আদেশ।
হাবিব এবার মশকরা করেই বলেন- গিন্নীমা তোমাকে ছেড়া গামছা পরে অতিথি আপ্যায়ন করতে বলেছেন বুঝি ?
রঘুনাথের গলা শুকিয়ে আসে এবং বলে- না, তা বলেন নি, আপনার খাওয়া হলে ওগুলো ধুয়ে আমাকে স্নান করতে হবে তো তাই ।
কথাগুলো কানে প্রবেশ করা মাত্রই পুরো মাথাটা ঝিম ধরে গেল। চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন হাবিব।
অনিমেষ বৈঠক ঘরে প্রবেশ করেই অস্বাভাবিক পরিবেশের আচ পেলেন। একবার রঘুনাতের দিকে আবার হাবিবের দিকে তাকালেন। কিছুই বুঝে ওঠতে পারছেন না। তবে এটুকু আন্দাজ করতে পারছেন যে, কিছু একটা হয়েছে।
অনিমেষ ছেড়া গামছা পরিহিত রঘুনাথকে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না, রাগত কন্ঠেই বললেন- রঘুকাকা তোমার এ অবস্থা কেন ? ছেড়া গামছা পড়ে এখানে আসতে তোমার লজ্জা করল না?
হাবিব চোখ ঘুরিয়ে একবার অনিমেষের দিকে আবার রঘুনাথের দিকে তাকালেন ; এবং দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দিলেন রঘুনাথ হল হিন্দু সমাজের প্রতিচ্ছবি। যার বয়স অধিক অল্প বসন এবং খুবই জরা-জীর্ণ অবস্থা , দৃষ্টি অবনত।
রঘুনাথ মাথা নীচু করে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে দেখে অনিমেষ আবার বললেন- রঘুকাকা, তুমি এখান থেকে যাও।
পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য হাবিবকে অনিমেষ বললেন- স্যরি দোস্ত, তোকে অনেণ বসিয়ে রেখেছি। নে খা, এখন্ও তো কিছুই খেলে না।
হাবিব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন এবং অনিমেষের দিকে প্রশ্ন ছোড়েন- আচ্ছা অনিমেষ একটা সত্যি কথা বলবি?
অনিমেষ খুবই আন্তরিক হয়ে বলেন- তুই নি:সন্দেহে বরতে পারিস।
তোরা কি আমাদেও ঘৃণা করিস?
না তো ! এমন কথা বলছিস কেন?
আমার তো তাই মনে হয়।
এমন মনে হবার কারণ ?
গব বুঝিয়ে বলতে হবে ?
অনিমেষ কথা বাড়ায় না। হাবিবের পিঠে হাত রেখে পাশের চেয়ারটায় বসেন এবং বেশ শান্ত ভাবেই বলেন- দোস্ত কিছু মনে করিস না, কী করব বল। শত হল্ওে সমাজে বসবাস করি। সমাজের রীতিনীতি তো মেনে চলতে হবে, নাকি ?
তাই বলে এভাবে আমাদেও অপমান করার কোন অধিকার তোদেও নেই।
তুই বিষয়টা ওভাবে নিস না।
দেখ অনিমেষ , তোরা নিজেদেও যা’ই ভাবিস ওটা তোদেরও ব্যাপার কিন্তু আমাদেও ‘শেখ’ ‘শখ’ বলে অপমান করার কোন অধিকার তোদের নেই। আমি তোদেও এখানে খেতে আসি নি। আমি তো তোদের বাড়ীর ভেতরে আসতেই চাই না।- হাবিব বেশ উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে- আদর করে খেতেও দিবি আবার ছ্যূতমার্গের চরমসীমা অতিক্রম করবি। ্ওই আধ-নেংটোর নমুনাটা এভাবে উপস্থাপন না করলেও পারিস !
অনিমেষ বেশ শান্ত হয়ে বলে- প্লিজ দোস্ত, কিছু মনে করিস না। রঘুনাথটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে। ্ওদের বুদ্ধিতে এর চেয়ে আর বেশি কিছু আশা করাও বোকামি।
তোদের আদেশ না থাকলে নি:শ্চয়ই এমন করবে না।
তা মানি। কিন্তু সে একটু বাড়াবাড়ি করে। নে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, তারপর কাজের কথায় আসি।
না-রে অনিমেষ, পেটে কিছু ঢুকবে না।
হাবিব তুই যদি না খাস, তবে ভাবব তুই আমার ্ওপর রাগ করেছিস।
হাবিব হাত জোড় করে অনিমেষকে বলে- আজ অন্তত: থাক, আরেকদিন এসে খেয়ে যাব।
না বাবা, তুমি না খেলে আমি কষ্ট পাব- মহিলা কন্ঠে হাবিব সচকিত হয়।
অনিমেষ মায়ের কন্ঠ শোনে উদগ্রীব হয়ে তাকায় এবং বেশ উতফুল্ল হয়ে বলেন- মা এস।
মমতাময়ী দেবী উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে বৈঠক ঘরে প্রবেশ করেন। পেছন পেছন সুবিমল বাবু।
হাবিব উঠে দাড়ায় এবং মমতাময়ী দেবীকে সালাম জানান। সালাম নিয়ে জিজ্ঞ্যেস করেন- তোমার নাম কি বাবা ?
হাবিব নিজেকে বেশ সংকুচিত করে ফেলে এবং বেশ শংকিত চিত্তে বলেন- হাবিবুর রহমান হাবিব।
তুমি কী ফজলু সাহেবের ছেলে ?- ফাকে সুবিমল বাবু জিজ্ঞাসা করেন। চলবে ...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




