(১৫ই জুলাই তুরস্কে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান অবলম্বনে)
"বাবা, তুমি এখনও অনেক ছোট, তুমি বাসায় থাক, কেমন? আমি এবং তোমার বড় ভাইজান মিছিলে যাচ্ছি"। ১৫-ই জুলাই রাতে সেনা অভ্যুত্থান প্রতিহত করার জন্য প্রেসিডেন্টের ডাকে হালিমা হানম এবং তার বড় ছেলে মেহমেত মিছিলে যাচ্ছিল। কিন্তু ঝামেলা বাঁধাল ছোট ছেলে আলী। সেও যেতে চাই। তাকে উদ্দেশ্য করেই হালিমা খাতুন কথা গুলো বলছিল।
আলী নিজেকে ছোট হিসেবে মানতে রাজি নয়। আলী ভাবে, আমি তো অনেক বড় হয়েগেছি। নিজে নিজে কাপড় পরতে পারি, জুতো পরতে পারি, এমনকি একা একা স্কুলেও যেতে পারি, খাবারও কাউকে খাইয়ে দিতে হয় না। মাকে এসব কে বুঝাবে। বাবা থাকলে হয়ত মাকে বুঝাতে পারত।
আলীর বাবা ছিল অনেক সাহসী। পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টে টেররিস্টদের সাথে এক যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। মায়ের কাছ থেকে শুনেছে, ওর বাবা প্রায়ই একটা কথা বলত, "শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতে স্বদেশের এক ইঞ্চি মাটিও শত্রুদের হাতে ছেড়ে দেব না"। স্বদেশের জন্য জীবন দিয়ে বাবা তাঁর কথা রেখেছিলেন।
স্বদেশ আবারও শত্রুর কবলে। স্বদেশের এই বিপদ মুহূর্তে ঘরে বসে থাকা শহীদ পিতার সন্তান হিসেবে কাপুরুষতার লক্ষণ। কিন্তু মাকে তো কোন ক্রমেই রাজি করানো যাচ্ছে না।
মা আর ভাইয়া চলে গেছে। হয়ত ততক্ষণে মিশে গেছে বিশ্বাসী জনতার ভীরে।
আলী তার বাবার মৃত্যু সহজভাবে নিতে পারেনি। ওর বিশ্বাস বাবা মরে নি। বেঁচে আছে, আমাদের কর্মকাণ্ড উনি দেখছেন কাছে থেকেই। আলী প্রায়ই একা একা বিড়বিড় করে ওর বাবার সাথে কথা বলে। সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান শেয়ার করে। ওরা চলে যাবার পর আলী তার বাবার কাছে অভিযোগ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। বাবার কাছে একটা চিঠি লেখা যেতে পারে,
প্রিয় বাবা,
কেমন আছ তুমি? তবে আমি কিন্তু ভাল নেই। কি করে ভাল থাকব
বল? তুমি জীবন দিয়েছ একটি নিরাপদ স্বদেশ উপহার দেওয়ার জন্য।
কিন্তু বাবা, তোমার প্রিয় স্বদেশ কে শত্রুদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র
করা হচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীরা এ দেশের আলো বাতাসে বড় হওয়া বিদেশী
শত্রুদের দালাল এবং স্বদেশের বিশ্বাসঘাতক গ্রুপ। দালালদের প্রতিরোধ
করার জন্য, জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মা এবং ভাইয়াও রাস্তায় নেমেছে।
কিন্তু তোমার কাছে আমার অভিযোগ হল, ওরা আমাকে নিয়ে যায়নি।
বল বাবা, একজন শহীদ বাহাদুর পিতার সন্তান হয়ে এই মুহূর্তে আমাকে
কি ঘরে বসে থাকা মানায়?
আলী কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে বলতে পারে না। খুব সুন্দর একটা স্বপ্নে নিজেকে বিশাল এক মিছিলে আবিষ্কার করে। সাথে ওর বাবা, ওর হাত ধরে আছে। আলী বাবাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা, ওরা কারা? এত মানুষ কেন এখানে?
বাবা বলল, এটা হল বিশ্বাসী জনতার মিছিল হে প্রিয় পুত্র। তুমি না চেয়েছিলে মিছিলে যেতে। মিশে যাও হে প্রিয় পুত্র, বিশ্বাসী জনতার সাগরে। ওরা হারিয়ে গেল জনসমুদ্রে। আর শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত চারপাশ।
আলীর ঘুম ভাঙ্গে সকালে মায়ের কান্নার শব্দে। ঘুম থেকে উঠে দেখে বাড়ির সামনে আলীর ভাইয়ের রক্তাক্ত লাশের সামনে মা কাঁদছে। স্বপ্নে মিছিলে অংশগ্রহণ করার পর সর্বশেষ ঘটনার কথা আলীর মনে পড়ে গেল। মিছিলে হঠাৎ করে বোমা হামলা শুরু হল। কিছু বুঝে উঠার আগেই মাথায় কি এসে যেন আঘাত করছে। আলী ভেবেছিল সে শহীদ হতে যাচ্ছে। কিন্তু না, বাস্তবে তার ভাই মেহমেত শহীদ হয়েছে।
এক পা দু'পা করে মায়ের কাছে গেল আলী। কিছু একটা ভাবল। প্রিয় বড় ভাইকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে চাইলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। মাকে সাহস দিতে হবে, কাঁদলে চলবে কি করে।
আলী মাকে জিজ্ঞেস করল, মা কাঁদছ কেন? এমনভাবে জিজ্ঞেস করল যেন, উপস্থিত সবাই শুনতে পায়।
মাও জবাব দিল এমন ভাবে যেন উপস্থিত সবাই শুনতে পায়, স্বদেশের জন্য আমার স্বামী জীবন দিয়েছে, পুত্র জীবন দিয়েছে। কিন্তু আমি তাদের দুঃখে কাঁদি না। আমি কাঁদি এই দুঃখে যে, আমার ঘরে উপযুক্ত কোন পুরুষ লোক নেই। স্বদেশ রক্ষায় নিজের জীবন অকাতরে কে বিলিয়ে দিবে?
দৃপ্ত কণ্ঠে আলী তার মাকে বলল, কেঁদো না মা, চিন্তা করো না, আমি আছি। আমি থাকতে এই মাতৃভূমি কে শত্রুর হাতে তুলে দেব না মা। মনে হচ্ছিল, আলীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জনগণ জাগ্রত কণ্ঠে বলছিল, কেঁদো না মা, চিন্তা করো না, আমরা আছি। আমরা থাকতে এই মাতৃভূমিকে শত্রুর হাতে তুলে দেব না মা।
পুনশ্চঃ তুর্কিদের স্বদেশ প্রেম সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলে নেয়।
মেয়েটির নাম খাদিজা। বয়স ১৪/১৫ হবে। খুবই সুন্দরী একটি মেয়ে ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, সে জন্মগতভাবে কোন দিন নিজের সুন্দর মুখটি দেখে পুলকিত হতে পারেনি। Damla Project-এ জন্মান্ধ প্রতিবন্ধীদেরকে নিয়ে একটি প্রগ্রামে ওর সাথে পরিচয়। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি জান, তুমি অনেক সুন্দর? ওকে খুব আনন্দিত মনে হল। ও বলল, হ্যাঁ জানি, মা বলেছে আমি অনেক সুন্দর। ওর মার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে, সে লিখতে ও পড়তে জানে। অন্ধদের জন্য নির্দিষ্ট বই থেকে সে আমাকে নাসিরুদ্দিন হুজ্জার গল্প পড়ে শুনাল।
আমি সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি খাদিজা মেয়েটির স্বদেশ প্রেম দেখে। এই কথা সেই কথা থেকে দেশ সম্পর্কে কথা উঠল। সে বলল, বিশ্বাসঘাতকরা স্বদেশ কে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে, দোয়া করবেন। ওর মা মাঝখান থেকে বলল, দেশের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে, তারা খুবই খারাপ মানুষ। খাদিজা বলল, মা ওদেরকে মানুষ বলছ কেন!! ওরা তো মানুষ নয়! কোন মানুষ কি নিজের দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে? আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে কোন দিন তার জন্মভূমিকে দেখেনি। অথচ স্বদেশের প্রতি কি অগাধ ভালবাসা! অদেখা জন্মভূমির প্রতি মেয়েটির ভালবাসা দেখে সত্যিই ঈর্ষা হচ্ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৬