গত কয়েকদিন আগে তুরস্কের রাজধানী আংকারা থেকে ঘুরে আসলাম। তিন দিনের একটা ক্যাম্প ছিল, সেখানে অংশগ্রহণ করলাম। এর মধ্যে একদিন ছিল আংকারা ঘুরে দেখা। গত দেড় বছরে তুরস্কের বেশ কয়েকটি শহর ঘুরেছি। আংকারা থেকে ঘুরে এসে মনে হল তুরস্কের পথ-ঘাট ভালই তো চেনা হল, এবার কিছু লিখি। প্রথমে ভেবেছিলাম নিজের শহর আন্তালিয়া নিয়ে লেখা শুরু করবো। পরে ভেবে দেখলাম আন্তালিয়া তো আর চলে যাচ্ছে না। আংকারা স্মৃতি থেকে চলে যেতে পারে, তাহলে রাজধানী দিয়েই শুরু করা যাক।
আংকারা সফর সম্পর্কে লিখতে যাওয়ার আগে বন্ধুবর মুজাহিদুল ইসলামের একটি ফেবু স্ট্যাটাসের কথা মনে পড়ে গেল, "সবাই ট্যুরের প্ল্যান করছে এই সময়ে। আমি ভাবছি ২০০/২৫০ টাকায় কয়েকটা ভ্রমণ কাহিনী এনে পড়ে ফেলব"। বন্ধু যদি ইস্তাম্বুল ভ্রমণের ইচ্ছা করে তাহলে ২০০/২৫০ টাকায় ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব। কারণ ইস্তাম্বুল নিয়ে কয়েকটি বই আছে। যেমন- হুমায়ূন আহমেদের লেখা 'পায়ের তলায় খড়ম', প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁ'র 'ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র' অথবা 'ইস্তাম্বুলঃ সুলতানের শহর'(লেখকের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না) বইটি পড়া যেতে পারে। সে যদি আংকারা ভ্রমণের ইচ্ছা করে তাহলে নির্ঘাত বিপদে পড়বে। কারণ, আমার জানা মতে, বাংলাতে আংকারা ভ্রমণ সম্পর্কে এখনও কোন বই লেখা হয়নি। লেখাটি বন্ধু মুজাহিদের জন্য।
যেহেতু ভ্রমণ কাহিনী লেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই সেহেতু ভাবলাম ইতোপূর্বে লিখিত বই থেকে ফরমেট নকল করা যেতে। ইতোমধ্যে কয়েকটা বই পড়ে ফেললাম। হুমায়ূন আহমেদের লেখা 'পায়ের তলায় খড়ম'-এর ভূমিকায় (এটাও ইস্তাম্বুল ভ্রমণ সম্পর্কিত এবং ঐতিহাসিক তথ্য গুলোতে কিছুটা সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ আছে) লেখক লিখেছেন,
"ভ্রমণ কাহিনী লেখার কিছু 'ফর্মুলা' আছে। এই ফর্মুলায় যে শহরে যাওয়া হয়, তার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। বিশেষ বিশেষ স্থাপনার উল্লেখ করতে হয়। তার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে হয়। পাঠক যেন পড়েই বুঝে নেন লেখক অত্যন্ত পরিশ্রমী ও জ্ঞানী। লেখককে জ্ঞানী হতে তেমন পরিশ্রম করতে হয় না। ট্যুরিস্টদের জন্য বের করা চটি চটি বুকলেটে অনেক কিছু লেখা থাকে। সেখান থেকে 'টুকলিফাই' করলেই হয়। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন অবশ্য চটি বইও লাগে না। কম্পিউটারের সামনে বসে গুগল সার্চ দিলেই হল।
ভ্রমণকাহিনীকে রসালো করার বিষয়টির প্রতিও লেখককে লক্ষ রাখতে হয়। ভ্রমণে মজার ঘটনা(বেশির ভাগই বানানো) এবং দুর্ঘটনা(এটাও বানানো) রসালো করে লেখা হয়। অতি অবশ্য বিদেশিনী কোন তরুণীর(রূপবতী) সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে কথাবার্তা থাকে। রূপবতী বাংলাদেশ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন। তাকে জ্ঞান দেওয়া হয়।
উল্লেখযোগ্য স্থাপনার সামনে লেখকের ছবি ছাপানো হয়। ছবির নিচে ক্যাপশন থাকে। উদাহরণ- 'আয়া সুফিয়া। মুগ্ধ হয়ে দেখছেন লেখক। বাম থেকে দ্বিতীয়জন'। এই বিবেচনায় ভ্রমণকাহিনী লেখায় আমি মোটামুটি ব্যর্থ। কোথাও বেড়াতে গেলে নিজের ভাল লাগার অংশটিই আমার লেখায় প্রাধান্য পায়। শহরের বিশেষত্ব বা রহস্য ব্যাখ্যায় আমি কখনও ব্যস্ত হই না"।
হুমায়ূন আহমেদের ফর্মুলাহীন এই ফর্মুলাটা আমার পছন্দ হয়েছে।
আমরা(আমি এবং Phd রাকিব ভাই) আংকারা সফরে বের হওয়ার সময় নুরুল্লা রাকিব ভাইকে খুঁচা দিয়ে বলল, আন্তালিয়ার সাইকেল গুলো ইতোমধ্যে সব পড়ে গেছে, এখন আংকারার পালা। প্রসঙ্গত, আমার বন্ধু মহলে নতুন একটা ইডিয়মস চালু হয়েছে, "সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়া"। বন্ধু নুরুল্লাহ একদিন আমাকে দেখে দুষ্টামি করে বলছিল, অনেক স্মার্ট লাগছে। তুর্কি মেয়েরা দেখলে তো তোমার দিকে তাকাতে গিয়ে সাইকেল থেকে পড়ে যাবে। মজার বিষয় হল সেদিনই ভার্সিটিতে যাওয়ার পথে আমার সামনে একটি তুর্কি মেয়ে সাইকেল থেকে পড়ে গেছে। সে পড়ে গেছে ঠিক কিন্তু আমাকে দেখে নয়; আমাকে সাইড দিতে গিয়ে পড়ে গেছে। রাস্তায় বা ফুটপাথে এমন পরিস্থিতিতে হয়ত অনেকেই পড়েছেন। আপনিও সাইড দিচ্ছেন, বিপরীত দিক থেকে যে আসছে সেও সাইড দিচ্ছে। যার ফলে, কেউ কাউকে পথ করে দিতে পারছে না। আমাদের বেলায়ও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। নুরুল্লার কথা মনে পড়তেই চরম হাসি পেল। কিন্তু হাসি চেপে রাখতে বাধ্য হলাম। কারণ কোন বিপদগ্রস্ত মেয়ের সামনে হাসা মোটেই উচিত না। এই হচ্ছে সংক্ষিপ্ত আকারে "সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়া" ইডিয়মসের শানে নুযূল।
সফর সঙ্গী ছিল রাকিব ভাই। নুরুল্লারও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে ব্যক্তিগত ইগোর কারণে আসতে পারেনি। রাকিব ভাই তাকে কি কারণে যেন রাগ করে বলেছে, "তোমার ইচ্ছা হলে আসবা না হলে নাই"। এই কথায় নুরুল্লা আহত হয়েছে। তবে নুরুল্লা আংকারা সফরে না যেতে পেরে 'পিশমান' হয়নি। ('পিশমান' মানে হল 'অনুতপ্ত'। অপর দিকে টার্কিশ একটা খাবারের নাম 'পিশমানিয়া'। এটা অনেকটা বাংলাদেশের 'শন পাপড়ি'র মত। কথায় আছে এটা খেলে নাকি পিশমান বা অনুতাপ দূর হয়ে যায়। নুরুল্লাকে 'পিশমানিয়া' খাওয়ানো দরকার। অন্তরে যদি 'পিশমান' থেকে থাকে তাহলে দূর হয়ে যাবে।)
আমাদের কে বহনকারী বাসটির নাম, 'পামুক্কালি সার্ভিস'। পামুক্কালি তুরস্কের একটি শহরের নাম। আমি 'পামুক্কালি' কে 'চানাক্কালির'র সাথে গুলিয়ে ফেললাম। 'পামুক্কালি' বাস কাউন্টার থেকে টিকেট কাটার সময় রাকিব ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, পামুক্কালিই তো প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সেই বিখ্যাত যুদ্ধ ক্ষেত্র, তাই না? রাকিব ভাই আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, সেটা চানাক্কালি ছিল, পামুক্কালি নয়। আমি বললাম, অ...
চানাক্কালি তুরস্কের একটি ছোট কিন্তু বিখ্যাত শহর। এই শহরটি ছিল প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ক্ষেত্র। ইহা ছিল প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের একমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে অটোম্যান সাম্রাজ্য বিজয় লাভ করে। আতাতুর্কের নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়া এই যুদ্ধকে ইংরেজিতে Gallipoli Campaign এবং টার্কিশ ভাষায় Çanakkale Savaşı বলা হয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত চানাক্কালি যুদ্ধে তুর্কিদের বীরত্ব এবং কামাল পাশা আতাতুর্কের নেতৃত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। (যদিও কবি নজরুল প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে যোগদান করেন তুর্কি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এবং ব্রিটিশদের পক্ষে। অবশ্য পরে ব্রিটিশদের প্রত্যাখ্যান করে ফিরে আসেন এবং কবিতা লেখা শুরু করেন ব্রিটিশ বেণিয়াদের বিরুদ্ধে।)
কবির লেখা "কামাল পাশা" কবিতার প্রথম চার লাইন,
"ঐ খেপেছে পাগ্লি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্সে সামাল সামাল তাই।
কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!
হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই"!
(চানাক্কালি যুদ্ধ ক্ষেত্র)
আন্তালিয়া বাস টার্মিনালে মজার একটা স্মৃতি আছে। একদিন স্পারথায় যাওয়ার(বন্ধু ইশতিয়াকের কাছে) জন্য বাস টার্মিনালে গেলাম। চেকিং পয়েন্টে ঢুকতেই পুলিশ মহিলাটি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি কুরিয়ান? আমি কি জবাব দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আচ্ছা আমাকে কি সত্যিই কুরিয়ানদের মত লাগছে? কি মনে করে মহিলা আমাকে কুরিয়ান ভাবল কে জানে। বাঙ্গালী তো আবার সংকর জাতি। আমি মনে করতে চেষ্টা করলাম, বাঙ্গালীর রক্ত কি কোন ভাবে কুরিয়ানদের সাথে মিশেছে কিনা!!!
ওই মহিলাকে যদি বলেন, না আমি বাংলাদেশি তাহলে নিশ্চিত থাকুন সে আকাশ থেকে পড়বে এবং জিজ্ঞেস করবে বাংলাদেশ কোথায়? আফ্রিকায়? কারণ আমি নিশ্চিত সে বঙ্গ মুলুকের কথা কোনদিন শুনে নাই। শুনবে কোথা থেকে সে তো আর বাংলাদেশের ভার্সিটি বা বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নেই নি। কয়েক দিন আগে এক স্টুডেন্টের সাথে পরিচয় হল। কোথা থেকে এসেছে জিজ্ঞেস করলে বলল, 'প্রিন্সিপি'। মনে মনে বললাম যাক ভার্সিটি ভর্তি প্রিপারেশন নেওয়ায় অন্তত বুঝতে পারলাম এটা আফ্রিকা মহাদেশের একটি দেশ। তবে বাংলাদেশ কে একেবারেই কেউ চিনে না এমনটা নয়। একদিন মসজিদে নামাজ শেষ করে বের হওয়ার সময় এক মুরব্বিকে সালাম দিলে আমাকে কোন দেশ থেকে এসেছি জিজ্ঞেস করল। বাংলাদেশ থেকে এসেছি জবাব দিতেই সে বলল, Senin başbakan kadın ve o dinsiz de mi? অর্থাৎ, তোমাদের প্রধানমন্ত্রী মহিলা এবং সে ধর্মহীন তাই না? (অবশ্য তার কথায় কে ধার্মিক এবং কে ধর্মহীন এটা প্রমাণ হয় না)
যাহোক মহিলার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মহিলার জবাবে আপনাকে খুবই আন্তরিকতার সহিত বলতে হইবে, ইহা আফ্রিকায় নহে, ইহা দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্বাধীন দেশ। এরপর আরও যা জিজ্ঞেস করতে পারে( নাও করতে পারে), আপনি কি ইংরেজি বলতে পারেন? যদি বলি হ্যাঁ পারি তাহলে নির্ঘাত প্রশ্ন করবে, বাংলাদেশ কি আমেরিকায়? তখন আমাকে বাধ্য হয়ে বলিতে হইবে জী না জনাবা আমরা মহান বন্ধু ভারতের প্রতিবেশী।(এসব প্রশ্নের সম্মুখীন আরও কয়েকবার হয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।)
বিদেশে (বিশেষ করে পশ্চিমা দেশ) যারা থাকে তারা অবশ্যই জানেন যে, বাংলাদেশ কে পরিচয় করাতে হলে অবশ্যই আপনাকে হিদুস্থানের নাম নিতে হবে। তখন আসলেই বিব্রত বোধ করি। আমরা বাংলাদেশীরা গর্ববোধ করি, আমাদের আলাদা স্বাধীন ভূখণ্ড আছে, সম্মানের প্রতীক লাল সবুজের একটি পতাকা আছে। পৃথিবীর বুকে আমরা আলাদা একটা জাতি। দুঃখটা আসলে ভারতের জন্য নয়, নিজের জন্য। আফসোস নিজেকে নিজের দ্বারা পরিচিত করাতে পারলাম না।
(চলবে)
পুনশ্চঃ সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স ম্যাগাজিনের তথ্য মতে,
"মানুষ ভ্রমণে গিয়ে ছবি বা সেলফি তোলার প্রতি সমস্ত মনোযোগ দিতে গিয়ে পর্যটকরা এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর ছবি তোলার জায়গাগুলোর কথা আর সেভাবে মনে করতে পারেন না"৷তাই আংকারা ট্যুরে যতটা সম্ভব ছবি না তুলার চেষ্টা করেছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:০৬