'এডভাইজার' হচ্ছে একটি পেশার নাম। পেশার নাম হলেও ফ্রি এডভাইজারের কিন্তু অভাব নাই; বিশেষ করে ফেইসবুকে। আমি অবশ্য মানুষের দেওয়া উপদেশ গুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনার চেষ্টা করি। তবে কিছু কিছু উপদেশ খুবই হাস্যকর এবং অদ্ভুতও বটে।
অনেক দিন আগে "এই মেঘলা দিনে" শিরোনামে একটি ছোট গল্প লিখেছিলাম। এই গল্প পড়ে তখন কিছু এডভাইজার তৈরি হয়েছিল। একজন খুবই এডভান্স হয়ে বলেছিল, "ভাই এসব প্রেম-টেম না করে সরাসরি বিয়ে করে ফেলেন"। আমি দেখলাম যে আমার গল্প সে গল্প হিসেবে নেয়নি। বস্তব হিসেবে ধরে নিয়েছে। গল্পটা ছিল অনেকটা এক্সপেরিমেন্ট মূলক। আমার অবচেতন মন চেয়েছিল, গল্পটি মানুষ বিশ্বাস করুক। সে ক্ষেত্রে আমি সফল হয়েছিলাম বলতে পারি।
*
তবে পরিস্থিতি এখন পাল্টে গেছে। তখন এডভাইস দিতে এসেছিল। এখন এডভাইস নিতে এসেছে। তাও আবার বাঙ্গালী না, তুর্কি বন্ধু রাশেদ। আমিও তাকে অভিজ্ঞ এডভাইজারের মত এডভাইজ দিয়ে গেলাম। সে নতুন চাকরী পাওয়ায় আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল সেলিব্রেট করার জন্য। আমি তার বাসায় গেলাম।
কথায় কথায় সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা কেউ যদি রাগ করে আমার কি করা উচিত”?
- রাগ ভাঙ্গানো উচিত।
- রাগ ভাঙ্গানো উচিত সেটা আমিও জানি কিন্তু কিভাবে রাগ ভাঙ্গানো উচিত?
চিন্তা করছিলাম কি বলা যায়। জিজ্ঞেস করলাম, রাগকারী ছেলে না মেয়ে?
- মেয়ে।
মেয়ে শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তাকে বললাম, তাহলে ভাই এডভাইজ নেওয়ার জন্য ভুল জায়গায় এসেছ। মেয়ে চরিত্র নিয়ে আমার জ্ঞান গল্প-উপন্যাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
- তাহলে তো আরও বেশি ভাল। গল্প-উপন্যাসে রাগ ভাঙ্গানোর বিভিন্ন ধরণের টেকনিক দেওয়া আছে। তার থেকেই একটা বলো।
সর্বনাশ! তাকে রাগ ভাঙ্গানোর টেকনিক কোথা থেকে এনে দেই।
আমি পড়লাম মহা ফ্যাসাদে। পরে ভাবলাম টেকনিক বের করতে না পারি অনন্ত ঘটনা শুনা যেতে পারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটি কি এমনিতেই রাগ করে বসে আছে নাকি রাগ করার কারণ আছে?
- অবশ্যই রাগ করার কারণ আছে।
- কারণ থাকলে তো রাগ করবেই। কোন করার নাই। এর একমাত্র সমাধান পায়ে ধরে মাপ চাওয়া।
আমার কথা শুনে রাশেদ হাসছিল। পায়ে ধরার টেকনিক মনে হয় তার পছন্দ হয়নি। সে হাসতে হাসতে বলল, আমি তার পা কোথা থেকে পাবো?
- কেন কি হয়েছে? তার কি পা নাই? আমি যখন এই প্রশ্ন তাকে খুবই আন্তরিকতার সাথে করলাম তখন সে হাসতে হাসতে ফেটে পড়ছিল যেন।
- পা আছে কিন্তু সে তো আমার সাথে নাই।
- ও আচ্ছা তাই তো।
-
আমি তার সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি ঘটনা না জেনেই। জিজ্ঞেস করে আসল ঘটনা জেনে নিলাম। ঘটনা হল এই, গত ১০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার ভেতরকার মিনিট গুলো ছিল আমার জন্য খুবই স্পেশাল। কারণ সে এই প্রথম আমার সাথে কথা বলছিল। সে আমার সাথে কথা বলেছিল সেই সন্ধ্যা সাতটায়, আর এখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। তবে কথা বলায় যে খুশি হয়েছিলাম সেই রেশ তখনো কাটেনি। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত হল যেন। সে আমাকে টেক্সট করল, “ফ্রেন্ড আছেন ফ্রেন্ডের মতই থাকেন, আত্মীয়ের মত বিহেভ করেন কেন”? আমি তৎক্ষণাৎ কি বলবো ভেবে পেলাম না। হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমার বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। সে আবার টেক্সট করে জানালো, সে মজা করেছে। আমার মেজাজ এত খারাপ হয়েছে বলার মত না। খুব ভাল মত এক রিয়েক্ট করলাম। এমন রিয়েক্ট করলাম যে সেই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল।
আমি রাশিদকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ঐ মেয়ের প্রেমে পড়ে আছো?
- আরে নাহ। আমি তো তাকে কোন দিন দেখিইনি। না দেখে প্রেমে পড়া যায় নাকি।
রাশেদ কে দেখে মনে হল সে গভীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তবে প্রেমের প্রথম ধাপে থাকার কারণে অন্যের কাছে স্বীকার করা তো অনেক দূরের কথা, নিজের কাছেই স্বীকার করছে না। আমি রাশিদকে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে রাগ ভাঙ্গানোর জন্য এত আগ্রহ কেনো?
- ফ্রেন্ড তো তাই।
- ফ্রেন্ড হলে তো মেয়ে ঠিকই বলেছে। “ফ্রেন্ড আছেন ফ্রেন্ডের মতই থাকেন” কথা তাহলে মন্দ বলেনি। সেখানে রিয়েক্ট করার কি আছে?
রাশেদ এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। আমি আবার তাকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা তুমি কি ঐ মেয়ের বন্ধুত্ব হারাতে ভয় পাচ্ছ?
- নাহ। কারণ বন্ধুত্ব হয় দ্বিপাক্ষিক। সে যদি চলে যেতে পারে আমি কেন ভয় পাবো? তবে সে যদি রাগ না করে এমনিতেই চলে যেত কোন কিছু বলার ছিল না। যদিও কিছুটা খারাপ লাগত। কিন্তু রাগ করে চলে যাওয়াতে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, খুব খারাপ লাগছে।
-
হঠাৎ করে রাশেদ আমার সাথেও রিয়েক্ট করে বসল। ঘটনা কি! রাশেদ বলল, আমি তোমার কাছে এসেছি একটা সমাধানের জন্য আর তুমি আমাকে বিপথগামী করছ। তার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছ মনস্তাত্ত্বিক ভাবে।
হায় মানবজাতি! কোনটা সুপথ আর কোনটা বিপথ তা যদি আগে থেকেই উপলব্ধি করতে পারতে। কিন্তু 'অবাধ্য মন লজ্জা পায় না, দুঃখিতও হয় না। চাঁদ দেখে কলঙ্ক হবে বলে কেউ কি চাঁদ দেখা ছেড়ে দিয়েছে? তার চেয়ে চোখটাই নষ্ট হয়ে যাক না, মিটবে তখন দেখার সাধ'।
এত কিছু রাশিদকে বলতে গেলাম না। আমি তাকে বললাম, “রাগ ভাঙ্গানোর খুব সুন্দর টেকনিক আছে। তার জন্য কবিতা লিখতে পারো”।
এটা যে প্রাগৈতিহাসিক টেকনিক তাতে কোন সন্দেহ নাই। এই যুগের মেয়েরা যে লুতুপুতু প্রেম টাইপ কবিতা দিয়ে প্রভাবিত হয় না সেটাও আমার ভাল করেই জানা আছে। (তবে ব্যতিক্রমও আছে। মন থেকে কোন কিছু বললে সেটা কবিতা না হলেও প্রভাবিত হতে পারে)। কিন্তু আমার কাছে তো এরচেয়ে ভাল কোন টেকনিক নেই। এই টেকনিক মনে হয় রাশেদের পছন্দ হয়েছে। সে বলল, “আমারও তাই ধারণা। তাই তো আমি একটি কবিতা লিখেছি”।
সর্বনাশ! রাশেদ কবিতা লিখেছে! প্রেমে পড়লে কি সত্যি সত্যি কবি হয়ে যায় নাকি!
-
“যদি হার্ট করে থাকি রাগ করো
কিন্তু কোন একদিন যদি খোঁজতে ইচ্ছে হয়
কান পেতে শুনো তোমার হৃদয় কি বলে
-
হঠাৎ যদি ঘন অন্ধকার ঘিরে ধরে আমাকে
সূর্য হয়ে ঘুরে দাড়াও আমারই দিকে
আর ক্ষমা করো হে প্রিয়
একটু কঠিন মনে হলেও
-
ক্ষমা করতে পারো সন্ধ্যা নামার মুহূর্তেও
যখন ছায়া গুলো মায়া হয়ে ধীরে ধীরে রাত্রিতে এসে মিশে যায়
অথবা পড়ন্ত বিকেলও ক্ষমা করতে পারো.........”
-
রাশেদ নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করছিল আর আমি হাসি আটকে রাখার কসরত করছিলাম। হঠাৎ আমার মুখের হাসি কোথাও মিলিয়ে গেলো। সেখানে ভর করলো এক বিস্ময়। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কোন এক মেয়ের মায়ায় আটকে পড়া ছেলেটির দিকে। আটকে আছে, ছুটতে পারছে না; কাৎরাচ্ছে প্রচন্ড যন্ত্রণায়। আহা মেয়েটি যদি জানত, কি গভীর আগ্রহে বসে আছে ভালবাসার কাঙ্গাল একটি ছেলে। কবিতা আবৃত্তি শেষ হয়ে গেছে। রাশিদ এখন আমার থেকে মন্তব্য আশা করছে। যদি বলি এই কবিতা শুনে মেয়ে হাসবে কিংবা পাগল ভাববে’ তখন আমার মুক্তি নেই। আরও টেকনিক পেশ করতে হবে। আপাদত মুক্তি চাইলাম। বললাম, “কবিতা সুন্দর হয়েছে”।
-
রাশেদের মুখমণ্ডলে এক ধরণের উজ্জ্বল আভা পরিলক্ষিত হচ্ছিল। সে প্রচন্ড আশাবাদী। আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। তাই আমি রাশেদের আশাভঙ্গ করতে চাইলাম না। তা না হলে তাকে বলতাম, তুমি যেভাবে মেয়েটির মায়ায় পড়ে আছো সেও যদি তোমার মায়ায় পড়ে থাকে তাহলে সে ফিরে আসবে। আর যদি সে মায়ায় পড়ে না থাকে তাহলে কবিতা না মহাকাব্য লিখলেও কোন কাজ হবে না।
(পুনশ্চঃ “এ ভুবনে ডুবল যে চাঁদ সে ভুবনে উঠল কি তা?
হেথায় সাঁজে ঝরল যে ফুল হোথায় প্রাতে ফুটল কি তা?
এ জীবনের কান্না যত- হয় কি হাসি সে ভুবনে?
হায়! জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে"? তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি থেকে)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১২