সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় এসে দরজার দিকে তাকাতেই মেজাজটা বিগড়ে গেল! ঘরের দরজায় তালা। আম্মা বাইরে গেছে। অথচ আমাদের বলে, ‘যে দিনকাল পড়েছে, খবরদার! ঘর খালি রেখে কোথাও যাবি না!’ আজ আসুক। আম্মার দ্বিমুখী তত্ত্ব কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, সেই মর্মে একটা রুল জারি করব। কিন্তু এখন ঘরে ঢুকি কীভাবে? আম্মা মোবাইলও ব্যবহার করে না যে কল করে জেনে নেব কোথায় আছে।
আবার বাইরে যাব ভাবছি, এমন সময় কানে বাজল মিষ্টি একটা কণ্ঠ, ‘চাবি!’
পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটি। আমি চাবির জন্য হাত বাড়ালাম। মেয়েটি বলল, ‘আন্টি কোথায় যেন গেলেন। আপনি এলে চাবি দিতে বলেছেন। কখন আসবেন কীভাবে বুঝি? একটু পরপর তাই ‘আই হোল’ দিয়ে তাকিয়ে দেখছি, এলেন কি না।’
কথাগুলো শুনে বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। এমন মায়াবতী মেয়ে তো আজকাল হুমায়ূন আহমেদের বইয়েও দেখা যায় না! আনন্দে আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল, বহু কষ্টে সামলে নিলাম। আমি আবার বেশ ইমোশনাল ছেলে তো!
হাত-মুখ ধোব বলে ওয়াশরুমে ঢুকতেই টের পেলাম পানি নেই। বাড়িওয়ালার সঙ্গে বসে এর একটা বিহিত না করলেই নয়। যখন বাসায় থাকি, তখনই পানি থাকে না। বালতিতে ধরে রাখা পানি দিয়েই আমাকে গোসল সারতে হয়। আজ বালতিও খালি!
খিদেও পেয়েছে বেশ। হাত-মুখ না ধুয়েই খেয়ে নেব কি না, ভাবতে ভাবতে খাবার টেবিলের কাছে এসেছি, অমনি চোখে পড়ল বড়সড় একটা চিরকুট। আম্মার হাতের লেখা, ‘গ্যাস নাই। রান্না হয়নি। এসে রাঁধব।’
কেমন লাগে! ফ্রিজ খুললাম। ঠান্ডা পানি ছাড়া কিছুই নেই! আমার সব রাগ গিয়ে পড়ল বাড়িওয়ালার ওপর। পানি দেওয়ার নাম নেই, গ্যাস দেওয়ার নাম নেই, মাসের এক তারিখে ভাড়াটা তো ঠিকই নিয়ে যায়! আজ যদি এর একটা বিহিত না করেছি! এখনই যাব কি না ভাবছি; কিন্তু ব্যাটা এখন ঘরে আছে তো? থাক সন্ধ্যায়ই যাব। আপাতত ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে রাগটা মিটাই। ফেসবুক স্ট্যাটাসও এখন যেনতেন বিষয় না! শক্তিশালী একটি স্ট্যাটাস, দেশে বিপ্লবও ঘটিয়ে দিতে পারে। স্ট্যাটাসের জের ধরে হাইকোর্ট রুল পর্যন্ত জারি করে। আর এ তো সামান্য বাড়িওয়ালার ওপর রাগ মেটানো।
ফেসবুকে লগইন করতেই দেখি, নতুন একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এলেই বেশ ভালো লাগে, আর এখন যেটা এসেছে, সেটা তো রীতিমতো এক সুন্দরীর! নাম রাশিন রায়হান। রাশিন বড়ই সুন্দর নাম! আনন্দে আটখানা হয়ে এক্সেপ্ট করলাম। মেয়েটিকে চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি! তবে ইনফোতে বেশি কিছু লেখা নেই।
সুন্দরী মেয়ের বন্ধু হয়েছি বলে এতক্ষণের রাগ কমে গেছে ভাবলে ভুল হবে। বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী স্ট্যাটাস লিখতে শুরু করলাম। স্ট্যাটাস পড়েই যাতে সব ভাড়াটে এক হয়ে যায়! বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে!
‘পানি নাই, তাই গোসলও নাই। গ্যাস নাই, তাই খাবারও নাই। আজ ব্যাটা বাড়িওয়ালার খবর আছে!’ কথাগুলো লিখে ‘স্ট্যাটাস’ হিসেবে শেয়ার দিয়ে দিলাম। আহা! সঙ্গে সঙ্গে ‘লাইক’ পড়তে শুরু করল। কমেন্টও! কেউ আমাদের বাড়িওয়ালার মুণ্ডুপাত করতে লাগল, কেউ আবার তার নিজের বাড়ির বাড়িওয়ালার। আমি দেখলাম, স্ট্যাটাসটিকে আরও শক্তিশালী করার এই সুযোগ। একটি কমেন্ট করা দরকার। করেও দিলাম, ‘আসুন, এসব বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে সোচ্চার হই।’
এই কমেন্টেও ‘লাইক’ পড়ছে। পাল্টা কমেন্টও আসছে। সবাই বাড়িওয়ালাদের বিপক্ষে! হঠাৎই একটা নোটিফিকেশন দেখে আনন্দিত হলাম! ‘রাশিন রায়হান কমেন্টেড অন ইয়োর স্ট্যাটাস!’ মধু! মধু! কী কমেন্ট করল দেখতে ক্লিক করলাম।
রাশিন কমেন্ট করেছে, ‘পাভেল সাহেব, বাসার দরজাটা একটু খুলুন তো!’
কিছুই বুঝলাম না। কি স্ট্যাটাসে কি কমেন্ট! দরজাটা খুলুন তো মানে? এটা কি কোনো ইঙ্গিতপূর্ণ কমেন্ট? ভারচুয়ালি আবার বোকা বানাচ্ছে না তো? আজকাল অনলাইনে এসব খুব হচ্ছে।
নানা কিছু ভাবছি, ঠিক তখনই কলবেল বেজে উঠল! রাশিন নাকি! তা কী করে সম্ভব? আম্মা এসেছে নিশ্চয়! কিন্তু কমেন্টের মানেটা কী, ভাবতে ভাবতে দরজাটা খুললাম। আর খুলেই ভীষণ চমকে উঠলাম। সত্যিই রাশিন! প্রোফাইল পিকচারের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই চেহারায়। মুহূর্তের মধ্যেই আমার মনে পড়ল, কেন চেনা চেনা লাগছিল মেয়েটিকে। বাড়িওয়ালার মেয়ে সে! আসতে-যেতে দু-একবার দেখেছি আগে।
রাশিন ততক্ষণে বলতে শুরু করেছে, ‘স্ট্যাটাসে দেখলাম, বাবার নাকি আজ “খবর” আছে? কয়টার খবর জানতে এলাম। বাবাও আসছেন। কই বাবা,... এসো।’
বাড়িওয়ালার দেখাও মিলল, ‘কিহে, তুমি নাকি আমাকে গুগল সার্চ করছ? এত কষ্ট না করে একটু দুই তলায় গেলেই তো পারতে।’
পরিশিষ্ট
বিল্ডিংয়ের মেইন গেট দিয়ে বের হতেই দেখি, গাড়ি থেকে নামছে রাশিন। হাতের শপিংব্যাগগুলোই বলে দিচ্ছে, ঈদের শপিং। আমার আম্মা আর বোনেরাও শপিংয়ে গেছে। শুধু আমারই কোনো শপিং নেই। এই ভরদুপুরে যাচ্ছি বাসা খুঁজতে! বাসা পাওয়াই দুষ্কর, এর মধ্যে আম্মা শর্ত জুড়ে দিয়েছে, নতুন বাসার বাড়িওয়ালার কোনো মেয়ে থাকতে পারবে না। আর থাকলে সেই বাসায় ইন্টারনেটের লাইন ঢুকবে না!
আমাকে দেখে রাশিন বলল, ‘কী পাভেল সাহেব, আজকাল তো ফেসবুকে আপনার স্ট্যাটাসই দেখা যায় না! খুব ব্যস্ত নাকি?’
মনে মনে একটি দুঃখের ‘ইমো’ দিয়ে আমি মুখে সামান্য হাসি ফোটানোর চেষ্টা করলাম!
প্রথম আলোতে পড়তে ক্লিক করুন এখানে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




