১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল দেশটির ‘জন্ম’ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ইহুদি নিধনের জন্য সারা বিশ্বের সহানুভূতিটা তখন ইসরায়েলের পক্ষে ছিল। তবে দেশ প্রতিষ্ঠর শুরুতেই ছিল গোপন তৎপরতায় আরবদের ভিটেমাটি ছাড়া করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার শুরুতে আরব মুসলমানেরা যেভাবে জায়গা জমি হারিয়ে ও বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে উদ্বস্তু জীবন শুরু করে তা আন্তর্জাতিক মহলের তত নজর কাড়েনি। দেশ প্রতিষ্ঠার পরও ইসরায়েলের নেতারা সব সময় আশঙ্কায় ছিলেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, যেকোন সময় প্রতিবেশী আরব দেশগুলো হামলা করে পুরো দেশ দখল করে নিতে পারে এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের নাম সীমানা মুছে দিতে পারে। কোনো প্রতিবেশী দেশ তখনো ইসরায়েকে স্বীকৃতি দেয়নি
এমন অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা আর ভীতির পরিবেশে ইসরায়েলি নেতারা চালায় এক দীর্ঘ ষড়যন্ত্র। দীর্ঘ ১৬ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত এ ষড়যন্ত্র চলে, বারবার নীলনকশাটা ঘষামাজা করা হয়। ১৯৭৮ সালে ইসরায়েল বিমান বাহিনীর কমান্ডার বলেছিলেন, ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পরিকল্পনাটা চলে ষোল বছর ধরে। তার মতে, আমরা তখন শয়নে স্বপনে জাগরণে এ পরিকল্পনা নিয়েই কাটিয়েছি। এমনকি ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও এ যুদ্ধ পরিকল্পনা সঙ্গে থাকতো । সবকিছুর মধ্যে আমরা এই হামলার পরিকল্পনাকেই অগ্রাধিকার দিতাম।
আক্রান্ত হওয়ার আগেই শত্রু কে আঘাত করার কৌশলটা কাজে লাগিয়েছিল ইসরায়েল। সিনাই মরুভূমিতে নাসেরের সৈন্য সমাবেশ আদৌ ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্য ছিল না। মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের সিনাই এলাকায় দুই ডিভিশন সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। ইসরায়েল জানত যে, এ সমাবেশের উদ্দেশ্য লড়াই বা দখল নয়। পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন, আইজ্যাক রবিন ও সাবেক সেনাধ্যক্ষ জেনারেল হেইম বারলেভ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে এ ঘটনা সম্পর্কে এটাই বলেছিলেন, তারা মনে করতেন না যে এতে ইসরায়েলের কোনরকম ক্ষতি হবে। তবে এটা ছিল তাদের গোপন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের এক দুর্লভ সুযোগ। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইসরায়েল এ সেনা সমাবেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। আর ভেতরে ভেতরে নিজ হামলার সবকিছু যখন ঠিকঠাক হয়, তখন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২৬ মে ওয়াশিংটনে যান এবং প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসনকে তাদের উদ্দেশ্যটা জানিয়ে আসেন। প্রেসিডেন্ট জনসন আশ্বাস দেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন দেবে।
ভূখন্ড ও সম্পদ (সিরিয়ার গোলান হাইটের জলসম্পদ) দখল এবং একটি চ্যালেঞ্জহীন আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসরায়েল ওই হামলা চালিয়েছিল। ইসরায়েলের অভিযোগ, হামলা চালাতে মিসরের দুটো ডিভিশন আসছে। সিরিয়া ইসরাইলি কৃষকদের ওপর কামানের গোলা নিক্ষেপ করছে এমন অভিযোগ তুলে ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের ৫ জুন ‘আত্মরক্ষার জন্য’ যে যুদ্ধ শুরু করে, তা এক কথায় বলা যায় অভূতপূর্ব হয়ে দাঁড়ায়।
ইসরায়েলের প্রথম আঘাতেই মিসরের ৩০০ সামরিক বিমানের ৯০ শতাংশ ভূমিতেই এবং সিরিয়ার দুই তৃতীয়াংশ বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। ২৪ ঘন্টার যুদ্ধ শেষে ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর প্রধান মোরদেচাই হেডে জানায়, আরবদের পুরো বিমান বাহিনী ধবংস হয়ে গেছে। ইসরায়েলের ১৯ টি বিমানের বিপরীতে মিসর ৩০০ টি, সিরিয়া ৬০ টি, জর্ডান ৩৫ টি, ইরাক ১৫টি ও লেবানন একটি বিমান হারায়। দ্বিতীয় দিন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা ও পশ্চিম তীর এবং তৃতীয় দিনে উত্তর সিনাই দখল করে। এ ছাড়া তারা মিসরের ব্রিগেডগুলোকে ধ্বংস করে জেরুজালেম দখল করে এবং জর্ডানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। চতুর্থ দিন তারা হারাম আল শরিফ ও মধ্য সিনাই দখল করে। পঞ্চম দিন তারা পুরো সিনাই দখল করে সুয়েজ খালের দিকে এগিয়ে যায় এবং সিরিয়ার গোলান হাইট্স এলাকা দখল করে।
১৯৬৭ সালের এ যুদ্ধ আসলে শুরুর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলি বিমানবাহিনী তাদের হামলা চালিয়ে যায় নির্মমভাবে। কোনো আকাশ প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ইসরায়েলি বিমানগুলো পাইকারি হারে গুলি ও বোমা ছুঁড়ে হাজার হাজার মিসরি সৈন্য হত্যা করে। ওয়াশিংটন গোপনে অস্ত্র দিচ্ছিল বলেই ইসরায়েল এমন নারকীয় হামলা চালিয়ে যেতে পেরেছিল। জুনের ১০ তারিখ ইসরায়েলের এই একপক্ষীয় ঝটিকা আক্রমণ যখন শেষ হয়, তখন দেখা যায় প্রাচীন ফিলিস্তিনের বাকি ২২ শতাংশ ভূখন্ড (গাজা ও পশ্চিম তীরসহ) তাদের হাতে এসে গেছে। এ ছাড়া সিনাই উপদ্বীপ এবং গোলান হাইটস তো আছেই। ইসরায়েল তার আয়তনের তিনগুণ আয়তন ভূখন্ড দখল করে ফেলেছে। জন্মের ৬০ টি বছরের মধ্যে গত ৪০ টি বছর ইসরায়েল একটি দখলদার দেশ হিসেবেই পরিচিত হয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের নানা প্রতিক্রিয়ায় দেশটির নীতি পরিচালিত হয়েছে। এ যুদ্ধে আরব দেশগুলো যে ভূখন্ড হারিয়েছিল, তা উদ্ধারের আশায় তারা ১৯৭৩ সালে আরেকটি যুদ্ধ করে। তবে এতে তেমন কোন লাভ হয়নি। অনেক নৈতিক টানাপোড়নের পর চুক্তি করে মিসর সিনাই এলাকা ফেরত পায় কিন্তু গাজা আর ফিরে পায়নি। সিরিয়া গোলান হাইটস এবং জর্ডান পশ্চিম তীর আর ফিরে পায়নি। আর পাবে বলেও মনে হয়না।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০০৯ রাত ১১:০৩