somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এয়ারক্রাশ ইনভেস্টিগেশন – ভুতের কবলে বিমান (২য় অংশ)

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রথম অংশ

প্রাণ তো বাঁচলো। এবার তারা জানতে চাইলেন কেন এমনটা হয়েছে। নিরাপদে বিমান পার্ক করে, সকল সুইচ অফ করে পাইলটরা বিমানেই পেপারওয়ার্ক সেরে নিলেন। সমস্ত ফ্লাইট ডাটা পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, কোথাও তারা কোন ভুল করেছিলেন কিনা। তাদের ভয় ছিল, হয়তো তারা কোথাও কোন মারাত্মক ভুল করেছিলেন, যার কারণে সকল দূর্ঘটনার সুত্রপাত ঘটে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তারা কোন ভুলের হদিস পেলেন না।

বাইরে থেকে বিমান পরিদর্শন করে অবাক হয়ে যান তারা। সারা বিমানের রং উধাও। যেন কেউ ঘষে ঘষে তুলে ফেলেছে। সামনের নাক আর ডানা বালুর আস্তরে ঢাকা। উইন্ডশিল্ড মারাত্মক স্ক্র্যাচে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। এজন্যই তারা বাইরের কিছু দেখতে পারেননি। মনে হচ্ছে যেন মরুভূমিতে পড়ে থাকা কোন পরিত্যক্ত যুদ্ধবিমান। সম্পূর্ণ ভালো একটা বিমান, কুয়ালালামপুর থেকে তারা চড়েছেন। জাকার্তা পর্যন্ত আসতে সেটার এই অবস্থা হলো কেন তাদের মাথায় ধরলো না।



শেষে তদন্তের জন্য ডাকা হয় বিমানের ইঞ্জিন নির্মাতা রোলস রয়েসকে। এই কাজে নেতৃত্ব দেন প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার ম্যালকম গ্রেবার্ন। তারা সবরকমের ফরেনসিক ও ফটোগ্রাফিক এনালাইসিস করে ইঞ্জিনের অভ্যন্তরে ধুলো, বালি ও পাথরের অস্তিত্ব দেখতে পান।




পরীক্ষাগারে এই ধুলো আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে সৃষ্ট ধুলো বলে প্রমাণিত হয়। তার মানে এতসব ঘটনা ঘটেছিল তার কারণ এই অগ্নুৎপাতের ধুলো !!! শুনে সবাই আশ্চর্য হয়ে যায়। কোথা থেকে আসলো এই অগ্নুৎপাত, আর তা কিভাবে তা বিমানের এতবড় ক্ষতি করতে পারলো ?



এর উত্তর দেন আমেরিকার জিয়োলোজিকাল সার্ভেয়ার টম কাসাডেভাল। ১৯৮২ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার ১৬০ কিমি দক্ষিণপূর্বে গোলঙ্গন পর্বতে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী অগ্নুৎপাতের ঘটনা ঘটে। প্রচুর বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয় এতে। আশেপাশের প্রায় ৬০ হাজার অধিবাসীদের অন্যত্র সরে যেতে হয়।



যে রাতে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ০০৯ উড়ছিল, ঠিক সে রাতেই আরেকটা অগ্নুৎপাতের উদগীরণ ঘটে। অগ্নুৎপাতে সৃষ্ট ধোঁয়া ১৫ হাজার মিটার উপরে উঠে যায়। এবং বাতাসে তা দক্ষিণপশ্চিম দিকে সরে যায়, ঠিক বিমানটি যে পথ দিয়ে যাচ্ছিলো সেই পথে।






কিন্তু সামান্য ধোঁয়া কিভাবে এতবড় বিমানকে পঙ্গু করে দিলো ? টম জানান, এটা কোন সাধারণ ধোঁয়া নয়। খুব মিহিভাবে গুড়ো করা পাথর আর খনিজ পদার্থ নিয়ে গঠিত এই ধুলা।



ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে শুষ্ক পরিবেশে এই মিহি পাথরগুলো চলন্ত বিমানের গায়ে ঘর্ষণ লেগে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করে। হাজার হাজার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সারা বিমানকে ঘিরে ফেলে। ফলে মনে হয়েছিল যেন বিমানে আগুন ধরে গেছে। এই ব্যাপারটিই যখন পাইলটরা তাদের উইন্ডশীল্ডের সামনে দেখছিলেন, তাদের মনে হচ্ছিলো যেন আতশবাজী। পাথরের ঘর্ষণে বিমানের উইন্ডশিল্ড, নাক ও ডানা ঝাঁঝরা হয়ে যায় ও বিমানের রং উঠে গিয়ে ভেতরের মেটাল বেরিয়ে আসে।



এই ইলেক্ট্রিফিকেশনের কারণে বেতার যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটে, যার কারণে জাকার্তার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার পাইলটদের ম্যাসেজ বুঝতে পারেননি। কিছু পাথর ইঞ্জিনের মধ্যে দিয়ে ঢুকে প্যাসেঞ্জার কেবিনে অভ্যন্তরে গিয়ে যাত্রীদের গায়ে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে, যার কারণে যাত্রীরা আরও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েন।

তাহলে এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের কারণেই কি ইঞ্জিনে আগুন ধরে গিয়েছিল, যার ফলে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় ? ইঞ্জিনিয়ার ম্যালকম গ্রেবার্নের মতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নয়, বিমানের ইঞ্জিনে আগুন ধরেছিল বাতাস শোষণের প্রতিবন্ধকতার কারণে। তিনি ইঞ্জিনের কার্যক্রম ব্যাখ্যা করে বলেন, একটি টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন প্রচুর পরিমাণ বাতাস শুষে, এই বাতাস পরে ইঞ্জিনের শক্তিশালী কমপ্রেশারের মাধ্যমে চাপে রূপান্তরিত হয়ে বিমানকে আকাশে উড়তে সাহয্য করে। ইঞ্জিনের ভেতরের কম্বাসচিয়ান চেম্বার, যেখান দিয়ে বাতাস ঢুকে তা চাপে রূপান্তর হয়, সেখানকার তাপমাত্রা প্রায় ২০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। মিহি পাথরযুক্ত অগ্নুৎপাতের ধুলো ইঞ্জিনের ভেতর ঢুকে, উচ্চতাপে গলে ইঞ্জিনের গায়ে বসে যায়। গলিত পাথরের আস্তর ইঞ্জিনের বাতাস শুষে নেয়ার পথ বন্ধ করে দেয়। এটাই সকল সমস্যার মূল কারণ। তার ফলশ্রুতিতেই সবগুলো ইঞ্জিন মাঝপথে বিকল হয়ে যায়। চলন্ত ইঞ্জিনে বাতাস শুষতে নিতে না পারায় পেছনে আগুন ধরে যায়, কারণ তখনর ইঞ্জিনে কোন অক্সিজেন নাই, কিন্তু অনেক বেশী জ্বালানী।



ম্যালকম গ্রেবার্নের মতে, এরপর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যেটি বিমানকে বাঁচিয়ে দেয়। চারটি ইঞ্জিন যখন বেশ কিছুক্ষণ বন্ধ ছিলো, তখন ভেতরের গলিত পাথরের আস্তর ঠান্ডা হয়ে খসে পড়ে। ফলে ইঞ্জিনের বাতাস শোষনের পথ পরিষ্কার হয়। এর মধ্যে পাইলটরা ইঞ্জিন রিস্টার্ট নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। এরই এক পর্যায়ে যখন পাথরের আস্তর পুরোপুরি ক্লিয়ার হয়, ঠিক তখনই বিমান রিস্টার্ট নেয়।

কিন্তু প্রথমবার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার পর, আবার কেন একই বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল ? কারণ বিমানটি গতিপথ পরিবর্তন করেছিল। প্রথমবার আগ্নেয়গিরির উপর দিয়ে যাবার পর যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, তাতে ভীত হয়ে তারা পশ্চিমদিকে ঘুরে হালিমে অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে যেতে আবার একই আগ্নেয়গিরির উপর দিয়ে হয়েছিল। ফলে দুইবার তারা একই অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তারা যদি প্রথম বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার পর পূর্বদিকেই তাদের ফ্লাইট কন্টিনিউ রাখতেন, তাহলে দ্বিতীয়বার তাদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হতোনা।

কোন বিমান এর আগে এত মারাত্বকভাবে অগ্নুৎপাতের ধোঁয়ার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি অনেক কিছু শিখেছে এই ফ্লাইট থেকে, যা এয়ার সেফটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। এরপর থেকে আকাশে বিমান চলাচলে অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টরের মতো অগ্নুৎপাতও গুরুত্বপূর্ন বলে বিবেচিত হতে থাকে। সম্প্রতি ২০১০ সালে আইসল্যান্ডে একটি অগ্নুতপাতের ঘটনায় গোটা ইউরোপে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।

এই ঘটনায় আরেকটি জিনিস আবিষ্কৃত হয়। সেটা হলো, অগ্নুৎপাতের ধোঁয়া রাডারে ধরা পড়েনা, যেহেতু এই ধোঁয়া শুষ্ক। এই শিক্ষা জিওলজিস্টদের জন্যও গুরুত্বপূর্ন হয়ে আছে যারা আগ্নেয়গিরি নিয়ে গবেষণা করেন।

এই ঘটনায় পরিসমাপ্তি ঘটে অতি মধুরভাবে। পাইলটরা তাদের সাহসিকতার জন্য উচ্চ প্রশংসিত ও পুরষ্কৃত হন। কেবিন স্টুয়ার্ডরাও প্রশংসিত হন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য। বেটি টটেল ফ্রিম্যান তার অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘অল ফোর ইঞ্জিন হ্যাভ ফেইল্ড’ নামে একটা বই লিখেন। তিনি জেমস ফার্গুসন নামে সেই ফ্লাইটের আরেক যাত্রীকে বিয়ে করেন। চার্লস কেপওয়েল ও তার ছোট দুই ছেলে দুইদিন পর পার্থ চলে যান। সেই ছোট্ট চ্যাজ ও স্টিভেন আজ অনেক বড় হয়েছে। এখনও পার্থে আছে তারা। এই ঘটনার কিছুদিন পর ক্যাপ্টেন এরিক মুডি মাউন্ট গোলাঙ্গন গ্লাইডিং ক্লাব গঠন করেন। সেই ফ্লাইটের প্রত্যেক যাত্রী ও ক্রু সেই ক্লাবের অন্তর্ভুক্ত হন। এখনও প্রতিবছর জুন মাসে তারা সেই ঘটনা স্মরণ করে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা, ও পাইলটদের ধন্যবাদ জানান।

১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×