গতকাল থেকে প্রথম আলোর অনলাইন লাল-সাদা-সবুজে সয়লাব। সাউথ এশিয়ান গেমসে আর্চারিতে বাংলাদেশ একের পর এক সোনা জয় করছে আর সাথে সাথে তার সংবাদ ও খেলোয়াড়দের লাল-সাদা জার্সি পরা হাস্যজ্বল ছবি চলে আসছে অনলাইনে। আন্তদেশীয় গেমসে একটা নির্দিষ্ট খেলার প্রতিটা ইভেন্টেই সোনা জিতেছে কোনো দেশ, এমনটা আগে হয়েছে কি না আমার জানা নেই। অন্তত বাংলাদেশের জন্য হয়নি। এটা অবিশ্বাস্য।
এই দলে রোমান সানা নামের একজন অতিমানব আছেন বলেই এই অবিশ্বাস্য কাণ্ডটা সম্ভব হচ্ছে। আর ঠিক এই কারণেই আমি যতটুকু আনন্দিত হচ্ছি, ঠিক ততটুকুই আতংকিত হচ্ছি। কারণ প্রতিভাকে লালন করার চেয়ে ধ্বংস করাতেই আমাদের ঐতিহ্য প্রমাণিত।
গত দু-তিন বছরে রোমান সানা যা করেছেন তার প্রায় শতভাগই নিজের প্রতিভাবলেই করেছেন। ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে আমরা উল্লেখযোগ্য কিছুই করিনি তার জন্য। অথচ যেকোনো দেশ, এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতেও এ ধরণের প্রতিভাকে লালন করার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকে, তাকে প্রমোট করা হয়, তার উপর বিনিয়োগ করা হয়। যে কারণে ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা অপ্রচলিত ইভেন্টগুলোতে খুব দ্রুত উঠে আসছে।
আজকে পিভি সিন্ধু, গিতা ফোগাট, সানিয়া মির্জা, সায়না নেহাওয়াল, অভিনব বিন্দ্রা, পেজ-ভূপাতি, বিশ্বনাথন আনন্দসহ আরো অসংখ্য বিশ্বমানের খেলোয়াড়তো আর হাওয়া থেকে আসেনি, তাঁদের পেছনে রাষ্ট্র বিনিয়োগ করেছে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেছে, প্রমোট করেছে।
অথচ দাবায় নিয়াজ মোর্শেদ ১৯৮৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্রান্ডমাস্টার খেতাব পাওয়ার পর গত ৩০ বছরে আরো অর্ধশত গ্রান্ডমাস্টার পাওয়া উচিৎ ছিলো এদেশের। দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু তা হয়নি। গলফে সিদ্দিকুর রহমানের উত্থানের পর বিশ্বমানের আরো গলফার পাওয়ার কথা ছিলো আমাদের। শ্যুটার সাবরিনা বা আব্দুল্লাহের বাকির জন্য আমরা কি করেছি? ওই যে পদক নিতে গিয়ে জাতীয় সংগীতের সাথে আবেগে ভেসে কেঁদে ফেলা সোনার মেয়ে মাবিয়ার বস্তিঘরটা কি বদলেছে একটুও?
এদের নিয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই, আমরা মেতে আছি প্রচলিত খেলাগুলো নিয়ে, যেগুলোতে প্রাকৃতিক কারণেই আমরা পিছিয়ে আছি। আরে ভাই, এই আকৃতি আর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আগামী শতবর্ষেও বোল্টদের মত যারা আবহাওয়াগত কারণে এগিয়ে আছে, তাদের হারানো সম্ভব নয়। আবার টেকনিকজনিত কারণে ফুটবলে আমরা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল হতে পারবোনা এটাও সত্যি। না মেনে উপায় নেই। কিন্তু আমরা পড়ে আছি ওগুলো নিয়েই। সেখানেও কি আমরা খুব এগিয়ে গেছি? সেই যে বখতিয়াররা সুইডেনে গিয়ে ব্রাজিলের ছেলেদের হারিয়ে ডানা কাপ আর গোথিয়া কাপ জিতে এসেছিলো, আমরা কি তাদের এগিয়ে নিতে পেরেছিলাম? এখন কোথায় তারা?
আমার খুব আশ্চর্য লাগে, আশি-নব্বুয়ের দশকে এ দেশে ফুটবলের যে ক্রেজ ছিলো, সেই অবস্থা থেকে ফুটবলকে বর্তমান অবস্থায় নামিয়ে আনতে রীতিমত গবেষণা করা দরকার, পরিকল্পনা দরকার, অর্থ বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু আমরা বিনে পয়সায় তা করে ফেলেছি। যে দেশের দুটি ক্লাবদলের ফুটবল খেলার ধারাবর্ণনা রেডিওতে শোনার জন্য মফস্বলের বাজারগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো, সে দেশে আজ ফুটবল খেলা দেখতে লোকে ফ্রি টিকেটেও স্টেডিয়ামে যায় না। এই অবস্থা সৃষ্টি করতে যথেষ্ট যোগ্যতা দরকার। নিঃসন্দেহে আমাদের সেই যোগ্যতা আছে! দেখতেই পাচ্ছি।
ঠিক এ কারণেই রোমান সানার মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া স্বপ্নময় চোখকে খুব ভয় করছে।
আরেকটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করে। সম্প্রতি আমির খান অভিনীত ‘দঙ্গল’ মুভি দেখে খুবই আপ্লুত হয়েছি। সেটা যতটা না সুন্দর অভিনয় দেখে, তারচেয়ে বেশি এই ফোগাট পরিবারকে সম্মান জানানোর কায়দা দেখে। এর আগে ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ দেখেও একই ধরনের অনুভূতি হয়েছিলো। এই যায়গাটাতেও আমরা কোনো কাজ করতে পারিনা। আমাদের এফডিসিসংশ্লিষ্টরা ^ল^ল যা বানায় বানাক, কিন্তু সুশীল নামে সরকারি অনুদান নিয়ে যারা কাজ করে, তারাও এদিকে একটু দৃষ্টি দিলে আমরা বর্তে যেতাম। কিন্তু সেটাতো হবার নয়, এ ধরাধামে প্রশংসা পাবেন একজনই।
এই পরিকল্পনা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং ঈর্ষাকাতরতার ফাঁপড়ে পড়ে দশে দশ পাওয়া বাংলাদেশ কতদুর যেতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৬