somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

করোনায় আমার নগদে যা লস হলো....

১৬ ই মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বছরের এ সময় আবহাওয়াটা খুবই সুন্দর এবং মোলায়েম থাকে। মার্চের খোলসছাড়া এই বাতাসে খুব ঘুরতে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু চাইলেই তো আর যাওয়া যায় না, অফিস - ফ্যামিলি সামলাতে হয়, অর্থনৈতিক ব্যাপার স্যাপার ঠিক থাকতে হয় আবার পছন্দের দলবলও জুটাতে হয়। সবকিছু ঠিকঠাক চলার পর টিকেট কেটে ফেললেও যাত্রার দিন সকালে দু’জন বলবে যে তারা যেতে পারবে না। এগুলো খুবই কমন। এ জন্য যেকোনো ট্যুরেই পনেরোজন ঠিক হলেও ধরে নিই বারোজন যাবে।

এবার ওসব ঝামেলা উৎরে গিয়েছিলো। দলবল রেডি, আকাশও পরিচ্ছন্ন। কথা ছিলো মাঝের দুদিন ছুটি নিয়ে আমরা ১৭ থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত বান্দরবান এলাকায় থাকবো। বান্দরবান শহর থেকে চাঁন্দের গাড়িতে করে সাঙ্গু নদীর রূপ দেখতে দেখতে রুমা যাবো, বগালেকে পানসি চালাবো। একটু ট্রেকিং করে পাহাড়েও উঠবো। কিন্তু কিসের কি! আচানক মীরজাদি সেব্রিনা আপা ঘোষণা দিলেন, দেশে তিনজন করোনা আক্রান্ত...! এবং প্রায় সাথে সাথেই দুর্বলচিত্ত রুবেলের ফোন, ‘শোনো, এই অবস্থায় যাওয়া ঠিক হবে না... শিমুরা একা থাকবে... কি করবা দেখো... তবে সবাই গেলে আমিও যাবো।

আমি সংগে সংগেই বুঝে গেলাম, এবারের মত ট্যুর শেষ! এরপর একে একে রিপন, মোমেন, আইজ্যাক, মারগুবুল্লাহ ফোন দিয়ে ওই ফ্যামিলির দোহায় দিয়ে বললো- তবে তুমি/আপনি/তুই সিদ্ধান্ত নিলে আমরা যাবো!! এখন আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা রে ভাই, আমারও তো বউ আছে না কি?

এখানে আপনি চাইলে ওই যে রাজ্যের সবাইকে ডেকে রাজামশায় জিজ্ঞাসা করলেন- তোমাদের মধ্যে কে কে বউকে ভয় করোনা, তারা ডান পাশে যাও.... কৌতুকটা মনে করে কিছুক্ষণ হেসে নিতে পারেন। আমি কিচ্ছুটি মনে করবো না। এখন করোনার ভয় আর বউয়ের ভয় সমানে সমান!

সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘চাচা কাহিনী’তে 'বেঁচে থাকো সর্দিকাশি' শিরোনামে সর্দিকাশিকে উপজীব্য করে অসাধারণ একটা গল্প আছে। সর্দিকাশির জন্য এক জার্মান ডাক্তারের প্রেম ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো, শেষ পর্যন্ত সেই সর্দিকাশির দৌলতেই কিভাবে প্রেম পূর্ণতা পেলো- তারই বর্ণনা। মুজতবা আলীর নিজস্ব রম্যঢঙে লেখা এই গল্প যতবার পড়ি, ততবারই মুগ্ধ হই ।

দেখা যাচ্ছে মারাত্মক সর্দিকাশিতে আক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ওই ডাক্তারের লাভই হয়েছিলো। বাংলাদেশে ‘করোনা’ চলে এসেছে; যার প্রকাশও হয় সর্দিকাশির মাধ্যমে। এই সর্দিকাশিতেও উটকো মাস্ক ব্যবসায়ীদের মত অনেকের ব্যাপক লাভ হচ্ছে। কিন্তু করোনায় নগদে আমার ব্যাপক লস হয়েছে, ট্যুরটা ভেস্তে গেছে। ভেবেছিলাম ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার এর ‘কোরাল দ্বীপের হীরা পান্না’র মত একটা সিরিজ লিখবো, পুরাই ভচকাইয়্যা গেলো। আমার থাকার কথা ছিলো পাহাড়-কুয়াশার নৈসর্গিক সবুজে, আর বসে আছি করোনার ভয়ে জর্জরিত হয়ে এই পঁচা শহরে!! কি যাতনা বিষে/বুঝিবে সে কিসে...

:( :(
যা গেছে যাক, এবার অন্য কথা হোক। বহু জলঘোলা হওয়ার পর আমরা করোনাকে স্বাগত (!) জানালাম। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এর বরাতে ব্লগার চাঁদগাজী বেশ আগেই বলেছিলেন যে করেনা ভাইরাসজনিত অসুস্থতা বৈশ্বিক মহামারী হবে, কিন্তু আমরা মানতে চাইনি; আমরা তো গরমের দেশ। সেই গরমের দেশেও এখন করোনা পুরো শৈত্যপ্রবাহের মত আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করতে গিয়ে আমার যেটা মনে হচ্ছে, তা হলো-

প্রথমত: আমরা এখনও করোনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারছি না। ব্যক্তিগত-প্রাতিষ্ঠানিক-সরকারি কোনো পর্যায়েই সঠিক মাত্রার বিপদটা ধরতে পারছে না। এজন্যই আমাদের যাবতীয় কার্যক্রম কথা বলা আর উপদেশ দেয়ার মধ্যেই সীমিত রয়ে গেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই করোনা নিয়ে যতটা চিন্তিত, পরিচ্ছন্নতা-নির্দেশিকা মানার বিষয়ে ততটাই অনুৎসাহী। এক্ষেত্রে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ সবাই মিলেমিশে একাকার। মাস্কতো নেই-ই, অহরহই বিনা প্রটেকশনে কাঁশি/ হাঁচি দিচ্ছি, রাস্তাঘাটে সমানে ছ্যাপ (থুথু) ফেলে একাকার করে ফেলছি। আজকের প্রথম আলোতে অর্ণব স্যানাল লিখেছেন একটি ‘ছ্যাপাক্রান্ত জাতির করোনা ভাগ্য’। তবে শান্ত্বনার কথা হলো- আমাদের পূর্বপুরুষেরও একই দোষ ছিলো। প্রায় দেড়শো বছর আগেই কুসুমকুমারী দাশ তাই লিখে গেছেন- আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?

দ্বিতীয়ত: সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি রোজা এলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বাড়ে, জ্বালানী তেলের দাম বাড়ার অযুহাতে চাল/আটারও দাম বাড়ে। ঠিক একইভাবে দেশে কোনো ক্রাইসিস তৈরী হলে তার সাথে সম্পর্কহীন জিনিষপত্রের দামও বাড়ে যা সহ্য করা মুশকিল। করোনার প্রভাবে পাঁচ টাকার মাস্ক ১৫০ টাকা হয়ে গেছে, তাও মানা যায়, কিন্তু আজ সকালে বাজারে গিয়ে দেখি পিঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে গেছে!!! আমার মা বলতেন- কয়লা যায় না ধুলে, স্বভাব যায় না ম’লে (মরলে)।

তৃতীয়ত: ব্যাংকের মুনাফার হারের মত আমাদের গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতাও কমে সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসেছে আর তার যায়গা দখল করছে অনির্ভরযোগ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই সুযোগে একক অদ্বিতীয়ম গুজবপ্রিয় জাতি আমরা ‘গু’জবের ডালপালায় পুরো বসন্তের ফুল ফুটিয়ে দিচ্ছি। সরকার কিছু বলছে না, দুই/তিনশ করোনাক্রান্ত রয়েছে দেশে, সরকার ১৭ তারিখের পর মহামারির ঘোষণা দেবে, আক্রান্তদের পরিচয় কেনো জানাচ্ছে না? ওরা বোধহয় মারা গেছে, এয়ারপোর্টের দুটো থার্মাল স্ক্যানারই নষ্ট, টাকা দিলেই চেক না করেই ছেড়ে দিচ্ছে, ইত্যকার নানারকম ‘গু’জব আমরা বিশ্বাস করে নিজে আতংকিত হচ্ছি এবং অন্যদেরকে আতংকিত করছি। এ কারণেই ‘চিলে কান নেয়া’র মত প্রবাদ-প্রবচন কেবল আমাদের ভাষাতেই হয়।

চতুর্থত: আমাদের আদি ও অকৃত্রিম রাজনীতিবিদরা! এ রকম একটা জরুরী মুহূর্তেও পরস্পরের পশ্চাৎদেশে কাটি দেয়ার সুযোগ ছাড়ছেন না। বিএনপি মহাসচিব বলছেন সরকার করোনার তথ্য গোপন করছে, অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন ‘তাঁরা দেশে আসলে নবাবজাদা হয়ে যায়’। সাধু সাধু! এদেরই এক পূর্বপুরুষরা ‘আল্লার মাল আল্লা নিয়েছেন’ বা ‘গরুছাগল চিনলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যায়’ বলে বিলকুল প্রাতস্মরণীয় হয়ে গেছেন।

প্রভূভক্ত এক চাকর তার মালিককে একবার বলেছিলো- হুজুর আপনিই আমার মা-বাপ আর আমরা সব কুত্তার বাচ্চা...। এখন অবস্থাদৃষ্টে আমাদেরও ওই চাকরের মতই মনে হচ্ছে।

পঞ্চমত: সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে মনে হয় সরকার বাহাদুর। মুজিববর্ষ নিয়ে এ মাসে ব্যাপক যজ্ঞের পরিকল্পনা ছিলো, প্রস্তুতিও ছিলো। কিন্তু আচমকা করোনা এসে কোথা থেকে কি হয়ে সব উলটপালট হয়ে গেলো। কিছুটা হতভম্ভ সরকারীদল আমার মত ভাবছে কি হওয়ার কথা ছিলো কি হচ্ছে! এই বিহ্বলতা থেকেই বোধহয় কি করতে হবে আর কি করতে হবে না, তা বুঝতে পারছে না বলে মনে হচ্ছে।

নগদে সরকারিদলের বেশকিছু লস হয়ে গেছে সত্যি, কিন্তু সময় মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নিতে না পারলে এই জাতির জন্য স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাবে, যা পূরণ করা সম্ভব হবে ন।

আমার আগের লেখায় বলেছিলাম- মুজিবর্ষের মত আনন্দ উপলক্ষ সবাইকে সাথে নিয়েই উদযাপন করা উচিৎ; সেটা হয়নি। তবু এখনও বলছি, জাতপাত, রঙবেরঙ ভূলে এখন সবাইকে আস্থায় আনা উচিৎ, পরিস্থিতির মোকাবেলায় জাত্যাভিমান ভূলে একতাবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। কারণ এটা একটা জাতীয় দুর্যোগের মুহূর্ত।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১১:৩৩
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×