somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: বিবাহগীতি

১৪ ই এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিবাহগীতি

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

লাইলি এবং লীলা একই যেমন মতিন এবং যতিন। কিন্তু তাদের বিবাহ হয় না। পাশাপাশি থেকেও তারা বোঝে যে তারা বিবাহিত নয়। এ বিষয়টি তাদের পীড়া দেয়। আমাকে বলে তুমি ব্যাখ্যা করো তুমি শহরে থাকো। তোমার যোগাযোগ সম্পর্কিত জ্ঞান ভালো। এতে আমার ক্ষণিক পিপাসা জাগে। ছেলেবেলার একটি পুকুরের কথা মনে পড়ে যেখানে একটিমাত্র পদ্মফুলের বাস। স্বপ্নে আসে যায়, বাতাসের দোলা খায়। স্বপ্ন চলে গেলে তখন এটি কোনো পুকুর নয়- একটি সরল রাস্তা যেখানে ন্যাংটা একটা পাগল গান ধরেছিল। আমি ভান করি বলি বিবাহ সম্পর্কিত সকল তথ্যই এখন অর্ধলুপ্ত। আমি কিছু বৃদ্ধ জ্ঞানদানকারি লোকের নাম বলি। ওরা প্রাণীদের যৌথজীবন সম্পর্কে বইপত্র লিখেছে ওখানে বিবাহের গল্প আছে। আমার কথায় ওদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। আমরা তখন গঙ্গাসাগর রেলজংশন থেকে একটি খোলা মাঠের দিকে যাত্রা করি। মাঠে গরু চড়ে না। রাখালও নেই। মতিন বলে এটি কোনো মাঠ হলো। এতে লাইলি ক্ষুদ্ধ হয়। মাঠ না বলে একে তুমি নদী ভূমি আকাশ যে কোনো নামে ডাকো। বিষয়টি আসলে সবসময় একই রকম থাকে। গোল গতিময় এবং সন্দেহযুক্ত। একদিন বিবাহ সম্পর্কিত জটিল কিছু পুস্তক অথবা পুস্তকসম কিছু কাগজপত্রাদি থেকে ওরা বিষয়টি সর্ম্পকে কিছু তথ্য পায়। ওরা গোল হয়ে একে অপরের তিকে তাকায়। তারপর দ্বন্দ্বে ভোগে। দ্বন্দ্ব থেকে কোনো রাস্তা পায় না। তারপর একসময় লীলা খুব কাছে আসে। কি সুন্দর সক্ষাৎ দেবী। আমি বলি বিবাহ হয় -লীলা। কারণ সৌন্দর্যই লীলা আর সে সকল বাধাঁ দূর করে আর আমাদের সংযুক্ত করে। কেউ শুনতে পায় না আমার কথা। যতিন প্রাথমিকভাবে যে নিস্ক্রিয়, কথা বলে। বলে - চলো আমরা বিষয়টি ত্যাগ করি। কিন্তু প্রকৃতভাবে বিষয়টি ত্যাগ করা যায় না। রাত গেলে দিন গেলে এটি আরো ঘনীভূত হয়। জমাট বাঁধে। আমরা মাঠের পাশে ত্রিভুজ আকৃতির একটি টিলাবাড়ির শীর্ষে উঠি। বিবাহ সম্পর্কিত নানাবিধ কৌতুহল বজায় রাখি। কিন্তু লীলা খুব শার্প। তার ঠোঁটের মতো একটি ঝিনুক নদীতে নামে, জলমাংস খায়। আকাশ পাতাল দিন রাত্রি বৃক্ষমাটি ইত্যাদির মধ্যে সে বিবাহ সম্পর্ক খুঁজে বেড়ায়। বলে বিবাহ হল- চুক্তিহীনতায় লিখনছাড়া নির্দেশনার অতীত একটি ধারাবাহিক সম্পর্ক যা ভূজগতে স্বাধীনভাবে চলে। কারো কথা সে শুনে না। পৃথিবীর এই ধারা, মায়াশেকড় ছায়ামূর্তির মতো দীর্ঘদিন ধরে এক সাথে আছে। এটিই বিবাহ। মতিন লীলাকে সাপোর্ট করে। ঘাস থেকে হাত ওঠায়। বলে বিষয়টি আয়োজনের অতীত। অনুষ্ঠানের অতীত । ওরা পরস্পর বিপরীতমুখি এমন কিছু এমন কেউ। কিন্ত স্বাভাবিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য এক সাথে বসবাস। যুগ্ম বৈপরীত্যের মধ্যে একাত্মতার থিওরির মতো। যেমন শূন্যতা-পরিপূর্ণতা সুখ-দু:খ আবার ধর্ম -অধর্ম ইত্যাদি। এ গুলো বিবাহ। কারণ এতে চক্র আছে। আমি শুনে অবাক হলাম। মফস্বলে থেকেও মতিনের ভেতর দার্শনিকতা জায়গা দখল করে আছে। লীলাও তাই। ওরা পালাক্রমে এরকম আরো কথা বলে যাচ্ছে। আমার ভান করে লাভ নেই। আমি ওদের মতো শার্প নই। কিছুণ আগে দিন ছিলো। এখন রাত। আমার দাড়ি বড় হচ্ছে। লীলার পাজামার কোণা থেকে প্রাচীন বাড়ির ভেজা মাটির স্যাঁত স্যাঁতে গন্ধ। ভোঁ ভোঁ করে মাছির মতো নাকের ভেতর দিয়ে ঢুকে মাথায় থাবা মারছে। আমি বলি আমি ভেজা মাটি খাবো। ভেজা মাটির সাথে আমার মিলন হবে। এটি বিবাহ। মতিন লাইলি যতিন আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। লাইলি বলে হতে পারে। আমার পিপাসা একটু বাড়ে। সেই পুকুরটির কথা মনে পড়ে। একটিমাত্র লাল পদ্ম। সেটি কি আমার লীলা। বলি চলো বাড়ি যাই। এতে লীলা অবাক হয়। সে বলে আমরা বিবাহ সর্ম্পকে আরো ভাববো। কারণ এটি জীবনের অন্যতম একটি দিক। ভাবনার প্রকাশ কী ভাবে? প্রবন্ধের মতো ভারি নাকি কবিতার মতো রহস্যময়। মতিন বলে প্রবন্ধও নয় কবিতাও নয়। এটি আসলে লেখা যায় না। দেখাও যায় না। একজন বলে আর একজন শুনে। তারপর পালন করে। বৃদ্ধ পুরুষেরা যখন দেখল তারা আর দৌড়াতে পারছে না। গাছে ওঠে ফল আনতে পারছে না। শাদা বরফের মতো, আপেলের মতো সবুজ মেয়েগুলো আর কাছে আসছে না । তখন তারা ঠিক করলো যারা দৌড়াতে পারে তাদের সহঅবস্থানটা জটিল করা দরকার। যাতে ওরা সহজেই ফল আহরণ না করতে পারে। ওরা বললো তোমরা সামাজিক সূত্র পালন করো। স্বীকৃতি নাও আমাদের। যেই নিদের্শনামা সেই কাজ। নৌকা স্রোত কেটে কেটে অনেক গভীরে চলে গেল। বাতাসের প্রয়োজন আর হল না। আমরা দেখলাম একটি পুরুষ একটি রমণীর পাশে বসে আছে অথবা দাঁড়িয়ে শুইয়ে আছে। বাতাসে ভেসে উঠলো শব্দ.. উলা উলা দ্রি দ্রি উলা... এটিই বিবাহ। আমার এখনো যেহেতু অভিনয় পালা শুরু করিনি তাই আমরা অবিবাহিত। গাছের মতো। দূরে দাঁড়িয়ে ভাবি মিলনের শ্বাসরোধি কথা। মতিনের কথা শুনে লীলা উচ্চস্বরে বাসে। ওর হাসির সাথে শরীরের প্রকাশ হলো পাতা নড়ে ওঠার মত। আমি বললাম কি সুন্দর সরল বৃক্ষ, ফল মূলে ভরা। অথচ আমি পাখি হতে পারলাম না। সাথে সাথে আমার একটা গল্পের কথা মনে পড়লো। আমার স্কুলের বন্ধু মিনহাজ এই গল্পটা বলেছিল। কিন্তু গল্পটার ঘটনা না বলে আমি এর শেষ কথা বলি। সেটি হলো একটি দোয়াত আর একটি কলম। বিবাহ বিষয়টা হল দোয়াত কলম। কারণ দুটোই শুধু উৎসাহিত হয়। মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। কাছে আসে। দোয়াতের মূখ খোলা থাকলে কলম অস্থির হয়। আর দৌড় দেওয়ার ইচ্ছা জাগে। দোয়াতের মুখ চিরদিন খোলাই। যদিও আমরা এটিকে বন্ধ অবস্থায় দেখি। কলম জাগরিত হয়। রাত্রি বা দিবসের কোনো প্রহর জ্ঞান নেই। কিন্তু একদিন ঐ বৃদ্ধগুলো ছিপি খোলার আগে পুরুষ আর রমণীকে সূত্রের ভিতরে এসে শব্দ উচ্চারণ করতে বলল। শব্দ তখন খুবই ছোটো হলেও ধারালো ছুরির মতো কঠোর। আর তা করতে হবে অনেকের সামনে। আমি লীলাকে দেখি। লীলা ঠিক লাইলি বলা যাবেনা। কিন্তু আমার মনে হয় লীলা অধিক গতিময়। যেমন ঘ্রাণ। সবাই আমরা এমন ভাবে আছি যেন আমরা মাটি ধরে জলস্থলরূপে কাছাকাছি আছি। কিন্তু আমাদের কোনো বিবাহ হয় না। কোথাও উলা উলা ধ্বনি শোনা যায় না। কিন্তু বিষয়টি এইসব ধ্বনিপঞ্জের অতীত। আগুনে পুড়ে যাবার অতীত। আমরা যদি এই মাঠে থেকে গাছে উঠি জল ঢালি তাহলে শিশুরা আসবে। শিশুরা বৃদ্ধদের বাণীর অপোয় থাকে না। শিশুরা হিন্দু না মুসলমান বৌদ্ধ না খ্রীস্টান এইসব কিছু বোঝে না। পেটের ভেতর সুপ্ত থাকা শিশু কোনো ধর্ম পালন করে? আমরা এরকম ভাবনা মতিন ধরতে পারে। সে এক সময় বলে তুমি মনোচিকিৎসকের সাথে কথা বল। তোমার ভাবনাটা একটা রোগ। আমি বলি ডাক্তারগণ আরো উদার। ওদের অবসেশন আরো গূঢ় আর পীড়াদায়ক। নার্সদের ভেতরে পাকা ডালিমের বাসা। লাইট চলে গেলে হাসপাতালে কোথায় লাল আপেল জ্বলে।

এসব বলতে বলতে এবং বিবাহ সর্ম্পকিত নানাবিধ বিষয় ভাবতে ভাবতে একদিন মোরগের বাচ্চার মেতা শীতকাল উপস্থিত। আমরা দেখলাম আমাদের গরম জামা কাপড় নেই। তাই ঠাণ্ডা করতে লাগল। লাইলি বলে চলো আমরা সামনের দিকে যাই। আমরা জামা কাপড়ের সবগুলো বোতাম লাগিয়ে হাঁটতে শুরু করি। সূর্য অস্ত যাবার কাছাকাছি। শীত ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। হঠাৎ করে যতিন বলে - নুশা নুশা দেখো সামনে একটা জঙ্গল। আমি বলি জঙ্গল না এটি বন। লীলা বলে সত্যি তো। এগুলোতো আমরা বইতে পড়েছিলাম। আমি বলি দেখো বনের ভেতর ছোট ছোট পাহাড়। পাহাড়গুলো এমনভাবে কাটা যেন ভেতরে রাস্তা আছে। মতিন বলে ঐতো মানুষের মতো কিছু। লাইলি বলে থাম। সামনে যেওনা। দেখছ না মানুষটা কাচা মাংস খাচ্ছে। তাজা মাংস। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। যতিন বলে চলো আমরা অন্যদিক দিয়ে আরো ভিতরে যাই। পাহাড় ছেড়ে আরো ভিতরে যেতে যেতে রাত হয়ে গেল। কিন্তু আকাশে চাঁদ ঝুলে থাকার কারণে পুরো বনটাকে পরিস্কার আয়নার মতো লাগছিল। আমরা একটু সামনে এগিয়ে যেতেই একটা শব্দ শুনতে পাই। শব্দটা ধীরে ধীরে গর গর সো সো এবং সবশেষে হিস হিস এইসব ধ্বনিতে পরিণত হল। আমরা দেখলাম চাঁদের আলোয় একটি গাছ নড়ছে। গাছ থেকে আপেল পেড়ে আনল একটি যুবক। সে অন্য একটি গাছের দিকে তাকিয়ে কি জানি বলে যাচ্ছিল। আমরা কিছই বুঝলাম না। তবে একটা শব্দ বারবার বলার কারণে ওটা ধরতে পারলাম। শব্দটা হল -ইভানা। এর মানেটা কি। লাইলি বলে ঐযে গাছের নিচে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পিঠে একটি বাচ্চা। লম্বা চুল। ঐ যুবতীর নাম হয়ত ইভানা। যুবক দেীড় দিয়ে যুবতীর কাছে যায়। লম্বা চুলের বাচ্চা আপেল হাতে ঝোপের ভেতর হারিয়ে গেল। যুবক ইভানাকে ঝাপটে ধরে বনের খোলা উপত্যকায় শুয়ে পড়লো। লীলা বলে দেখ কোনো লজ্জা নেই। মতিন বলে এটি একটি বিবাহ। বিবাহ বিষয়টা আসলে এরকমই। খোলামেলো সরল আর অনাবৃত। এই দৃশ্যের মত। লীলা কেমন যেনো লাল রঙ ধারণ করে। সে একসময় আমার একটা আঙুল ধরে ফেলে। আমি নিশ্চুপ থাকি। লীলার এই মনোহর স্পর্শ কি বিবাহ? আমাদের কি একদিন বাচ্চা হবে মানে এই রকম ঘন স্পর্শ থেকে।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা কান্ত হয়ে পড়ি। যতিন বলে একটু ঘুমিয়ে নিলে ভালো হয়। তিনদিন ধরে আমরা ঘুমাই না। আমরা এক সময় সবুজ জামা রঙের ঘাসে শরীর ছেড়ে দিই। দূরে হরিণ অথবা এমন কিছুর ডাকে আমাদেও ঘুম ভাঙ্গে। লাইলি বলে আমি তৃষ্ণার্ত। আমি ইশারা দিয়ে বনের পাশ দিয়ে বহে চলা নদীকে দেখাই। না আসলে নদী নয় একটি সরোবর। পরিস্কার জল টলটল করছে। পাশে একটা বিরাট পুরনো বটগাছ। গায়ে লেখা কমলা সাগর। যতিন বলে রাজার মেয়ে কমলা অশোক মালিকে দেখে উন্মাদ হল। রাজার অবাধ্য হল। অশোক জন্ম পরিচয়হীন। রাজা প্রকৃতভাবে কমলাকে কাছছাড়া করতে চায় না। কমলার সুঠাম দেহ, দুধে আলতা রঙ মুখে জড়ানো মিষ্টি কথা রাজার ভালো লাগে। চোখ প্রশান্তিতে ভরে যায়। রাজা ভাবে তার মৃত রানির দ্বিতীয়বার জন্ম হয়েছে। অন্য নামে। অন্য গর্ভে। কমলা অশোককে নিয়ে এই সরোবর ঘাটে এক সাথে সাতদিন সাতরাত পার করে দিল। রাজা জ্বলে পুড়ে পাগল প্রায়। নিদ্রাহীন সুখছাড়া। একদিন অমাবশ্যা রাতে দুজনকে পুড়িয়ে মারলো। লাইলি বলে এটা কি বিবাহ। লীলা বলে যে নামেই ডাকো এতে কোনো এসে যায় না। এটি একটি ইচ্ছাপুরণ। ঈশ্বরের ইচ্ছা। তাই এটি পবিত্র বিবাহ।

একদিন অগ্নিবর্ণ শাড়িতে লীলাকে কাছে পাওয়া গেল। মনে হল সে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। চারদিকে পোড়া ঘ্রাণ। আমি দেখলাম ওর হাত আর মুখের চামড়া কেমন কালচে হয়ে পড়েছে। কুচকে গেছে। লীলা ধীরে ধীরে একজন বয়স্ক মহিলা হয়ে গেল। অনেকদিন আগে দেখা পবিত্রতা বা লাবণ্য কোনটাই খুঁজে পেলাম না। একদিন সন্ধ্যাকালে একটি ফ্লাটে আমাদেরকে কিছু লোক বন্দি করে ফেলে। আমরা দেখলাম ওরা খুব সিরিয়াস এবং উন্নাসিক। ওদের মধ্যে লম্বা মতো কালো চশমা পড়া লোকটা আমাদের কাছে এসে কিছু একটা বলল। তোমরা মুক্ত তোমরা মুক্ত এরকম কিছু বাক্য। আমি বল্লাম কী ভাবে। সে প্রথমে হাসলো। তারপর আরো কিছু বলল। সারা বাড়িতে অনেক শব্দ হওয়ায় আমি কিছু বুঝিনি । কিছুক্ষণ পর সে একটা পুরনো বই আমাদের সামনে খুলে ধরে। বইটা কালো কাপড়ে ঢাকা। আমার একটু ভয় লাগে। আমার হঠাৎ করে মনে পড়ে একদিন একটা মাঠ পেরিয়ে টিলাশীর্ষে বসে আমি মতিন যতিন লাইলি আর লীলা অনেক শব্দ ব্যবহার করে ছিলাম। তখন শীতকাল। লীলার পাজামার কোণায় এমন একটি গন্ধ ছিল সেটিকে আামি বিবাহ বলে মনে করতাম। ভাবতাম ভেসে আসা বায়ুশ্রী - ইচ্ছার মিলনপ্রভা। লীলা তখন ছোট বেলার সেই পুকুরে ফোটা পদ্ম। আমি ডুব দিই আর স্পর্শ করি অসীম কুমারীজন্ম। এসব দায়িত্বহীন পবিত্র অনুভূতি জাগতো আমার ভেতর। এখন লীলা আমার সাথে একটি সূত্রমতে সংযুক্ত। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত আমরা বিবাহিত। আমরা দেখলাম দুটি লোক আমাদের ঘরে এসে ব্যাঙের বাচ্চার মত লাফাচ্ছে। বললাম কী হয়েছে? ওরা কিছু বলে না। এক সময় ভাষা বিনিময় করে। আমি কিছু বুঝি না। এই ভাষা আমার ভাষা কিনা সন্দেহ হল। মুখে দাড়ি, একটি বেটে লোক দেয়ালের দিকে ইশারা দেয়। দেয়ালে একটি ওয়েল পেইন্টিং। দৃশ্যটা এমন যে একটি মাকড়সা একটি পাখিকে খেয়ে ফেলছে। নিচে আপেল আর ছুরি। আমি বল্লাম আপনারা চলে যান। ওরা আমার বিষয়ে চিন্তা প্রকাশ করল না। নাচল গাইল আর অন্য ভাষায় কথা বলল। এক সময় সবাই কান্ত হয়ে পড়ে। দিন যায় রাত যায়। আমি কাজ করি। লীলা গোসল করে। বিকাল হলে চা তৈরী করে। একদিন একজন বলে পিচ্ছি টিচ্ছি কবে আইবো। এতে লীলা লজ্জা পায়। আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। কোথায় বাজে - হাট টিমা টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম। এভাবে কিছুদিন কাটল।

একদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়া শুরু হলে লীলা কেমন অস্থির আর অচেনা হয়ে যায়। আমিও কাজে না গিয়ে ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়লাম। সিগারেটে টান দিলাম। লীলা রান্নাঘরে মাছ কুটছিল। হঠাৎ দৌড়ে আমার কাছে আসে। নুশা নুশা আমি কে? আমি কে? আমি বলি তুমি লীলা। আমার স্ত্রী। এতে লীলার চক্ষু রক্তবর্ণ। হাতে যে মাছটা ছিল সে ওটাকে বাইরে ছুঁড়ে দিল। এরকম আচরণ গভীর রাত পর্যন্ত চলতে থাকে। পরদিন ভোরে লীলা বলে নুশা নুশা চলো আমরা যাই। আমি কিছু না বোঝার আগেই লীলার সাথে হাঁটতে শুরু করলাম। আমাদেরকে কেউ দেখে নি। কারণ সবাই তখন ঘুমে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটি অচেনা জায়গাতে চলে এলাম। জায়গাটা চেনা চেনা মনে হল। কোথাও যেন দেখেছি কিন্তু সঠিকভাবে মনে করতে পারলাম না। পাশাপাশি দুটো পাহাড়। মাঝখানে দস্যু ঝর্না। জল পড়ছে, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। লীলা দৌড়ে যায় ঝর্নার নিচে। আমি কিছু বলতে চাইছি। কিন্তু মুখ থেকে কোন কথা বের হল না। লীলা বলে নুশা নুশা আমি কে আমি কে? আমি ভাবি লীলা কে? লীলা কি কোনো সংযুক্তি কোনো স্ত্রী? আমি কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। ঝর্নাজলে শাদা পায়ের নিচে পাথর খণ্ড। নৃত্য হচ্ছে তা থা তা থা দিন তা থা দিন... । কোথাও সময় শুরু হয়েছে নতুন ভাবে। লীলা একসময় আমার দেখা সেই ইভানা। একদিন হাজার বছর আগে জঙ্গলের গাছের নিচে বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বলি ইভানা। তুমি এইমাত্র শুরু হয়েছ। এতে যুবতীর আনন্দ হয়। পোশাকের সভ্যতা শেষ হয়, দেহ বাতাস হয়। সে গান ধরে।

আমি মাছ কাটি নারে..
আমি ঘরে থাকি নারে..
আমার বাবু মাঠে মাঠে যায়
আমার মানুষ জলে নামেরে..।

আমি যুবতীর গানে উৎস থেকে যাত্রা করি। ওর মত করে গাই:

আমি রক্ত কিনি নারে..
আমি ঘরে থাকি নারে..
আমার বাবু মাঠে মাঠে যায়
আমার হাতে কালো পাখি উড়ে..।

এক সময় যুবতী লীলা হয়। আমি তার রূপ চিনতে পারি। এতকাল যে রূপ অচেনা ছিল। অন্ধকার নামে ঝর্নার নিচে। জঙ্গলে। লীলা ক্রমশ রূপ থেকে রূপান্তরিত। শামুক। হারিয়ে যায় ভেদবুদ্ধি, লোকাচার সভ্যতা। আমরা বিবাহিত।

একদিন আমাদের চার জনের খুব কান্তি আসে। শহর ছেড়ে এই বনবাদাড়ে আমরা অনেকদিন ধরে থাকছি। যতিন সে স্বভাবত নিষ্ক্রিয়, বলে চলো আমরা বাড়িতে যাই। লীলা আরো কিছুদিন থাকতে চাইলেও অন্য দুজন চায় না। আমিওনা। সুতরাং আমরা হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গাসাগর রেল জংশনের কাছে চলে আসি। রেল লাইনের উপরে সবুজ রঙ এর একটা ট্রেন গাড়ি। সামনে তিনটি রাস্তা। কোন দিকে ট্রেন যাবে আমরা কিছুই বলতে পারলাম না। মতিন বলে আমরা এখন কী করবো? লাইলি শার্প। বলে প্রকৃতিকে অনুসরণ করো। যতিন আমি লীলা এতই তৃপ্ত থাকি। এই প্রক্রিয়াটি আমাদের ভালো লাগে। আমার মনে হল লীলা এতে আনন্দিত হয়েছে বেশি। কারণ সে কোথাও অদেখা জায়গায় আবার হারিয়ে যেতে চায়। আর এইভাবে আমি তার হাটুর কাছে জামার নিচে অনেকবার বৃষ্টিভেঁজা মাটির গন্ধ পাই। সে আমাকে কাছে ডাকলেই আমরা বিবাহিত হবো বলে আমি ভাবি। কিন্তু প্রকৃতভাবে আমরা কোন সূত্রধরে বিবাহিত হইনা। একটা ঘরও থাকেনা। তবে আমরা একদিন গঙ্গাসাগর রেল জংশন ধরে একটি মাঠ পেরিয়ে যে দৃশ্যগুলোর দেখা পাই- তাতে একটু গূঢ় ধারণা জন্মে। সময়পালিত বাক্য বর্ষনের মাধ্যমে আমাদের যে বিবাহগীতি তা প্রকৃতভাবে কোনো মিলনের সূত্র তৈরী করে না । তাই কাছে থাকা বান্ধবীর নাম যাই হোক তার দেহ থেকে ইভানা নামক প্রথম পৃথিবীর একটি গন্ধ থাকে আর তাতে শৈশবে ফুটে থাকা একটি লাল পদ্ম বুকের গাছে ডালিম হয়ে জন্মায়। তাতে আমাদের বিবাহ বিষয়ে ধারণা পূর্ণ হয় আর একদিন হঠাৎ করে দু পায়ের মাঝখানে আর একটি জন্ম এসে ভর করে। এটিই বিবাহ।

রচনাকাল: ২৫/০৯/১৯৯৭
ঈষৎ পরিমার্জিত: ১৪/০৪/২০১০
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১০ রাত ৩:৪৯
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরূপের সাথে হলো দেখা

লিখেছেন রোকসানা লেইস, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৫



আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×