somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একুশের চেতনা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


[ এই লেখাটা লিখতে গিয়ে আমি কিছু বই এবং পত্রিকার সাহায্য নিয়েছি । আবার কিছু কিছু কমেন্ট হুবহু তুলে দিয়েছি । ]

০১.
“একুশের চেতনা” ও “বাংলাদেশের স্বাধীনতা ” শব্দ দুটির অর্থবোধক মানে আলাদা হলেও একটির সাথে আরেকটির সর্ম্পক গভীর ভাবে জড়িত । একটি ছাড়া অন্যটি আমরা ভাবতে পারি না, পারাও সম্ভব নয় । বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের ঊষালগ্নের পাক-ভারত উপমহাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চিয়তার ঝড় উঠে তার প্রথম প্রতিফলন ফুটে ওঠে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ।আর বাঙালির সেই প্রথম স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার পাথেয় হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।

বাঙালি জাতির একুশ, একুশের চেতনা আর ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে ।
সন ১৯৪৭ । ব্রিটিশ-ভারত তার স্বাধীনতা লগ্নে তিনটি ভাগে বিভক্ত হলো । ১৯৪০ সালে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিলো :-
“ That geographically contiguous unit are demarcated into regions which shall be so constituted, with such territorial re-adjustment as may be necessary; that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the north-western and eastern zones on India should be grouped to constituent units shall be autonomous and sovereign ”.

কার্যত হলো তার উল্টো । নবাব, ওমরাহ্ ও ভূস্বামীদের নিয়ে গঠিত মুসলিম লীগের নেতারা ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের নামে পূর্ব বাংলার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করলো ।
বিশ্বাসঘাতকতা করলো বাংলার মীরজাফর, খাজা নাজিমুদ্দিন, খাজা শাহাবুদ্দিন, নুরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ মুসলিম লীগ নেতা । পূর্ব বাংলা শৃঙ্খলিত হলো পশ্চিম পাকিস্তানি নয়া ধনপতি ও দালালদের হাতে । দুটি দেশ মাঝখানে স্থলপথে দু’হাজার মাইল ও জলপথে তিন হাজার মাইল ব্যবধান । দুটি দেশ ।

তার ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা, আচার-আচারণ, ঐতিহ্য আলাদা । ধ্যন-ধারনা, অর্থনীতি আলাদা । দুটি ভিন্নমুখী দেশ আর জাতিকে ধর্মের দোহাই দিয়ে একটি রাষ্টে রাখা হলো । শুরু হলো পূর্ব বাংলার উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের ধন কুবেরের আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নির্যাতনের এক করুন ইতিহাস । এবং প্রথম হামলাটি এলো ভাষার ক্ষেত্রে । সংখ্যাগুরু বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে মুষ্টিমেয় সংখ্যা লঘুদের ভাষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্টভাষা করার চক্রান্ত হলো । কিন্তু বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, তরুন-ছাত্র-শ্রমিকরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ালো ।

এই আন্দোলনের একদিকে অশ্রুসজল, অন্যদিক আনন্দের । ১৯৫২ সালের ২১’শে ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করে আসেনি । এর পিছনে রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকদের কায়েমি ষড়যন্ত্রের ফলে বাঙালিদের দানা বাঁধা বহুদিনের ক্ষোভ । ১৯৪৭ সালে এ উপমহাদেশ থেকে ইংরেজরা বিদায় নিলে শুরু হয়েছিলো পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ । পূর্ব বাংলায় উপনিবেশিক শাসন কায়েম করতে তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথ বেছে নেয় । তারা চক্রান্ত করে বাঙালির প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে নস্যাৎ করতে । গোটা পাকিস্তানিবাসীর মধ্যে শতকরা ৫৬ জন অধিবাসীর মাতৃভাষা ছিল বাংলা ।

সুতুরাং রাষ্টভাষা বাংলার দাবি ছিলো তৎকালীন সাতকোটি বাঙালির প্রাণের দাবি, ন্যায দাবি । কিন্তু পশ্চিম শাসক গোষ্ঠী বাঙালির এ প্রাণের দাবিকে উপেক্ষা করে । উর্দুকে রাষ্টভাষা রুপে স্বীকৃতি দিয়ে তারা বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচারণ শুরু করে । ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা বলে ঘোষনা করেন । এর তিনদিন পরে ২৪-মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও তিনি এ কথার পুনরুল্লেখ করেন । তখন সেই মুহূর্তে বাংলার জাগ্রত ছাত্র সমাজ এর প্রতিবাদ জানায় । বাংলার প্রাণে আঘাত, আগুন জ্বলে উঠে । সেই আগুন আর নেভেনি ।

০২.
১৯৫২ সালের ৩০-এ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেন । আর সেটা হয় আগুনের শিখায় কেরোসিন ঢালা । বাংলার অপমার জনসাধারণ নতুন করে জেগে উঠে । প্রাণের ভাষাকে, মায়ের ভাষাকে রক্ষায় এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে পূর্ব বাংলার সচেতন ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-জনতা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আন্দোলন, সংগ্রাম অব্যাহত রাখে । অবশেষে এলো একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশ শো বাহান্ন সাল । বাঙালির জাতীয় উন্মেষের প্রথম দিন । স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ ।

সেদিন পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলার ছাত্রসমাজ এগিয়ে যায় এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় এলে নিষ্ঠুর শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায় । ঝড়ে পড়ে কতগুলো তাজাপ্রাণ । বাংলার তরুণের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার পিচ ঢালা কালো রাজপথ । প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়ে যায় । শুধু কবির আবেগী কলম চলতে থাকে ...



“আধো দুপুর, আধো বিকেল
ফাল্গুনের শির্ শির্ বাতাস
আর বাংলার দামাল ছেলেদের-
প্রতিবাদী স্লোগান মিলেমিশে একাকার ।

সবুজ প্লাকডে রক্তিম অক্ষর জ্বলজ্বল –
মাতৃভাষা বাংলা চাই……
পোষ্টার, ফেস্টুন, প্লাকড ও
মানুষের ঢল আর স্লোগান
বইছে সমান তালে-
নাড়ীর টানে, ভাষার টানে, মায়ে্র টানে !

ফাল্গুনের হাওয়া হঠাৎ থমকে গেল !
ওকি! ও কিসের শব্দ?
চারদিকে কোলাহল, অন্ধকার বারুদের গন্ধ
বুলেট ছুড়ছে পাষাণেরা !!!
থেমে থেমে আসছে আর্তচিৎকার
আর তা ছাপিয়ে—
“আমার মায়ের ভাষা বাংলা চাই”

পশ্চিম কোণে হেলে পড়েছে সূর্য; আর-
তারি আভায় লালে লাল কৃষ্ণচূড়া ।
লালে লাল বাংলার রাজপথ !!!

সেই রক্ত বৃথা যায়নি । বাংলার অকুতোভয় ছাত্ররা রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনলো বাংলাকে, বাংলার ভাষাকে ।

আর এ চেতনায় উজ্জীবিত বাংলার প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচন; শাসকদল মুসলিম লীগের তথা আমলাতন্ত্রের বিপর্যয়; গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট নৌকার জয় । আমলাতন্ত্রের প্রত্যাঘাত । গণতন্ত্র শিবির রক্ষায় ছাত্রসমাজ । আর এ প্রভাব লালন করেই ষাটের দশকের আন্দোলিত ক্রান্তিকাল পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় । এখানেই একুশের কালখন্ড- প্রখর সূর্যালোকের নিচে সংঘঠিত বিস্ফোরক ঘটনাক্ষণের কালজয়ী গুরুত্ব ।

কিন্তু জাতীয় চেতনার উন্মেষের মুহূর্তে বাঙালি জাতি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলো কী নিদারুণ ভাবে তাদের শোষণ করা হচ্ছে । একুশের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি দেখলো- যদিও পাকিস্তানের শতকরা ছাপান্ন ভাগের বাস পূর্ব বাংলায় তবু বাংলার মানুষকে সবদিক দিয়ে কিভাবে বঞ্চিত করছে ওরা । কী নিদারুণ বৈষম্য । বাঙালি দেখলো । ভাষায় আঘাত দিতে না পারার ব্যর্থতায় শুরু হলো একের পর এক প্রসাদ রাজনীতির চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে ভরা অধ্যায় ।

০৩.
১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ এই ছয়টি বছর ধরে পাকিস্তানের ইতিহাস হচ্ছে গুটিকয়েক ক্ষমতালিপ্সু, কায়েমি, সার্থবাদী, আমলা মুৎসুদ্ধি, সামন্তপ্রভু, ধনপতি, মদ্যপ বদ্ধোম্মাদ রাজনৈতিক স্বার্থশিকারির প্রসাদ ষড়যন্ত্রের ইতিহাস । আর এই ইতিহাসের গুপ্ত পথ বেয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন জেনারেল আইয়ুব খান । বাঙালির আশা- আকাঙ্ক্ষার বুকে পদাঘাত করে সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করলেন তিনি । বাঙালির বাক- স্বাধীনতা, ব্যক্তি- স্বাধীনতা, সভা-সমতি, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা সমস্ত হরণ করে নিয়ে বাংলার মানুষকে অবাধ শোষণের পথ উন্মুক্ত করলেন জেনারেল আইয়ুব খান ও তার সামরিক জান্তা ।

১৯৬২ সালে ঢাকার রাজপথে আবারো শহীদের রক্ত ঝরলো । রক্তের ধারা আবার প্রাবাহিত হলো ঢাকার রাজপথে ১৯৬৪ সালে । কিন্তু এই দুর্বার আন্দোলনের পথ বয়ে এলো ১৯৬৯ সাল । বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা আর ১১ দফার দাবিতে বাংলার ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ ঐক্যবদ্ধ এক দুর্বার গণ-আন্দোলনের জন্ম দিলো । অসংখ্য শহীদের রক্তে রাঙা হলো পূর্ব বাংলার শহর-বন্দর-নগর ।

শহীদের অমরত্ব লাভ করলেন আসাদ, জোহা, জহুরুল হক সহ আরো অসংখ্য দেশপ্রেমিক । কিন্তু শত শত গুলি বর্ষণেও এ আন্দোলনকে স্তদ্ধ করা গেলো না । ৬ দফা ও ১১ দফার মুক্তির সনদ নিয়ে বীর বেশে, বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে মঞ্চে অবর্তীণ হলো বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবর রহমান । এবং নির্বাচনে অবর্তীণ হলো তাঁর দল আওয়ামী লীগ । শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে এক বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করলো পূর্ব বাংলার জনগণ । ইতিহাস সৃষ্টি করলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল । বাংলার মানুষ যখন বিজয় উল্লাসে মত্ত , তখন............

লারকানার জঙ্গলের পশু শিকারে মিলিত হলেন তিন খল নায়ক । প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, চিফ অব স্টাফ আব্দুল হামিদ খান আর সুদক্ষ অভিনেতা প্রিন্স অব ডেনমার্ক জুলফিকার আলী ভুট্রো ।

বাঙালি জাতির এই ক্রান্তিকালে আরো শক্ত, বলিষ্ট হাতে এ টালমাটাল জাতির হাল ধরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান । বাঙালি জাতি স্বপ্ন দেখলো, স্বপ্ন দেখলো স্বাধীন বাংলাদেশের । তাদের আশায় দীপ্ত আর প্রতিবাদী মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সেই ঐতিহাসিক মার্চে । বঙ্গবন্ধু আর বাঙালি জাতি বুঝে গেছে শান্তিপ্রিয় ভাবে আর সম্ভব না হলে তাঁদের কি করতে হবে । বঙ্গবন্ধু সমন্বয় ঘটালেন গান্ধীবাদী আর নেতাজীর ঐক্যের ।

বাংলার ছাত্র-কৃষক-মুজুর অপেক্ষায় কড়িগুণতে আর রাজি নয়; তারা চায় স্বাধীনতা । ৫২’র ভাষা আন্দোলনের চেতনা আবার বাঙালির রক্তে টগবগ করে ফুটে উঠলো । এমনি সময় ৩-ই মার্চ বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের হুশিয়ারি বানী দিলেন- “বাঙ্গালিকে আর দমন করিয়া রাখা যাইবে না ।”

অবশেষে আসলো সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ । রেসকোর্স ময়দানে জনসমাবেশ । বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন । মানুষে ছেয়ে গেলো রেসকোর্স ময়দান । প্রিয় নেতা মঞ্চে এসে দাড়ালেন, বললেন তাঁর প্রতিটি শব্দই যেন হীরন্ময় দ্রুতিতে ভাস্বর। কবি নির্মেলেন্দু গুণের ভাষায়-

“ শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মত-
দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাড়ালেন ।
তখন পুলকে দারুণ ঝলকে তরীতে ঊঠিলো জল
হৃদয়ে লাগিলো দোলা-
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা
কে রোধে তাঁহার বজ্র কন্ঠ বাণী ?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি-

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ।”

৪.
সেই থেকে আজ পর্যন্ত স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের । এত গৌরবময়, এত বেদনার জীবন বাঙালির জীবনে আগে কখনো আসেনি । বছর দুটি ১৯৫২ আর ১৯৭১ । এই দুটি বছরের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব বাংলাদেশকে জানলো, চিনলো এবং বুঝতে পারলো সবুজ, শ্যমল প্রকৃতির, কাদামাটির মতো নরম বাঙালি প্রয়োজনে কতটা ভয়ংকর হতে পারে ।

কোনো সন্দেহ নেই বাঙালি বর্ষাকালে যেমন কোমল, গ্রীষ্মে তেমনই রুক্ষ ও কঠিন । কে ভাবতে পারেছিলো ‘ভেতো বাঙালি’ নামে অভিহিত, কাপুরুষ পরিচয়ে পরিচিত বাঙালি জাতি পাকিস্তান নামের অবাস্তাব একটি রাষ্ট্রের জন্মের ছয় মাস যেতে না যেতেই আত্নপরিচয় প্রতিষ্ঠায়, মাতৃভাষার অধিকার অর্জনে সোচ্চার হয়ে উঠবে ? পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত বিরল যে, শুধু ভাষার জন্য সংগ্রাম করে স্বাধীনতার বীজটি বপন করে ২৩ বছর যেতে না যেতেই একটি প্রদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রকাশ করে ।

এর জন্য সেই প্রদেশের অধিবাসীদের সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হয়েছে, যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে । এবং অবিশ্বাস্য সত্য হচ্ছে ‘ভীরু, অলস, কর্মবিমুখ, কাপুরুষ, ভেতো, যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞ’ এই বাঙালিই মাত্র নয় মাসে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে । স্বাধীনতার জন্য প্রাণের আবেগ যখন দুর্দমনীয় হয়ে উঠে তখন পৃথিবীর যতই ভয়ংকর মরাণাস্ত্রই ব্যবহার করা হোক না কেন, সেই আবেগের কাছে তা তুচ্ছ হয়ে যায় । তাঁর প্রমাণ আমরা পেয়েছি আমেরিকা- ভিয়েতনামের যুদ্ধে, বাংলার ৫২’র ভাষা আন্দোলনে । বিশ্ববাসী সেই প্রমাণ পুনরায় প্রত্যক্ষ করলো ১৯৭১ সালে এই বাংলায়, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে ।

অবশেষে বাঙালি পেলো সেই কাঙ্খিত স্বাধীনতার স্বাদ । আমরা জানি ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’ । তাই বলে যার জন্য এত বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়া, এত প্রাণ, এত রক্ত, এত আশা- আকাঙ্ক্ষা বির্সজন সেই স্বাধীনতার জন্য আমরা কি করছি । যে চেতনায় দাঁড়িয়ে বাংলার ভাষাসৈনিক আর মুক্তিসেনারা বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত করলো বাংলার রাজপথ-মাঠ-ঘাট । সেই চেতনা আজ কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে বা হয়েছে ?
সেই ৫২ থেকে ৭১’র স্বাধীনতা পর্যন্ত নিপীড়িত বাঙালি জাতি যে চেতনায় থেকে স্বাধীন করলো দেশ তাঁদের সেই চেতনা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বাদ কতটুকু সার্থক হয়েছে তা সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ । রাজনৈতিক অরাজকতা, গণতন্ত্রের নামে পুঁজিবাদী অসাধুতা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে । নিজের মনুষ্যত্ব কে বিসর্জন দিয়ে হাঁটছি চোখ বন্ধ করে । শেখ মুজিবকে যারা নৃশংসভাবে খুন করতে গেলো তারাও দেশপ্রেমিক কিংবা গণতন্ত্রের পূজারী কিংবা নিপীড়িত জনগণ; তারাও ক্ষমতালোভী । ইতিহাস থেকে এরা শিক্ষা নেয় না । একজনকে খুন করে কে কবে সেই রক্তাক্ত সিংহাসনে বসতে পেরেছে ? তারা নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুড়ে ।

৫২ আর ৭১ এর ঘাতকেরা যে অপরাধ বিপুল হারে করেছিলো আজ সেই কাজই কি ছোট মাত্রায় কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে ঘটে চলছে না ? প্রায়ত হুমায়ূন আজাদের আক্ষেপ আজও কানে বাজে –“ এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম ?” আমরা চাই না এমন বাংলাদেশ । আমরা চাই না । আমরা চাই না আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে যাক আমাদের অতীতকে । মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনায় যে মুক্তিযুদ্ধ, লাখো শহীদের যে আশা, বঙ্গবন্ধুর যে আশা- আকাঙ্ক্ষা তা বাস্তবায়ন করে আমাদের গড়তে হবে একটি সত্য, সুন্দর বাংলাদেশ ।

যেখানে থাকবে না কোন শ্রেণীভেদ । হাসি কান্না, দুঃখ থাকবে মিলেমিশে । যেখানে দু’মুঠো ভাত শান্তিতে খাওয়া যাবে, মায়ের ভাষায় কবিতা লেখা যাবে, এমন বাংলাদেশ চাই ।

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে –
বাংলাদেশের মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ থেকে যে চেতনা লাভ করেছে তা জাতির সকল আন্দোলনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে । সমগ্র জাতি একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে একুশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে । ঐক্যবদ্ধ জাতি দেশ প্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে – তাঁর পিছনে একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ আজ সর্বজন স্বীকৃত ।

অত্যাচার আর শোষণের কালো হাত গুড়িয়ে দেওয়ার শক্তি ও প্রেরণা এসেছে এই একুশের চেতনা থেকেই । একুশের রক্ত থেকেই পরবর্তীকালে দেশের মুক্তির রক্তিম পতকা উড়েছে । লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙা হয়ে বাংলাদেশের আকাশে যে লাল সূর্যের আর্বিভাব হল তাঁর চেতনায় আছে ৫২’র দান করা রফিক, জব্বার আর নাম না জানা অসংখ্য ভাষা সৈনিকের রক্তের রঙ । তাই আমরা দেখতে পাই একুশের চেতনা জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে ।

৫.
“ মা কাঁদিছে পিছে ,
প্রেয়সী দাঁড়ায়ে দ্বারে নয়ন মুদিছে ।
ঝড়ের গর্জন মাঝে
বিচ্ছেদের হাহাকার বাজে !

ঘরে ঘরে শূন্য হল আরামের শয্যাতল,
যাত্রা করো, যাত্রা করো যাত্রীদল;
উঠেছে আদেশ-
বন্দরের কাল হল শেষ !”

পঁচিশে মার্চের কালরাত্রিতে যারা আত্মহুতি দিয়েছেন, পঁচিশে মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত যারা রক্তাক্ত বাংলার ইতিহাস রচনায় বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছেন, যে লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়েছেন হানাদারের কাপুরুষোচিত আক্রমণে; তাঁদের কথা স্মরণ রেখে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে নিঃসার্থভাবে । যেখানে একটা সত্য, সুন্দর ও ন্যায় বাংলাদেশ আমরা তুলে দিতে পারবো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে । আর ৫২’র চেতনায় ৭১’ এর মতো আবারো উদ্ভাসিত হতে পারবে প্রতিটি শিশু । সেখানে ভুলবে না তারা বাংলার সূর্যসন্তানদের রক্ত, ভুলবে না মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ভুলবে না বাঙালি জাতির আর্দশ ।

সব ধরণের কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, জাতি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, সাম্প্রদায়িকতার শিকল থেকে বেড়িয়ে এসে লাখো শহীদের, কোটি বাঙালির স্বপ্নের সবুজ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে সবাইকে কাজ করতে হবে একযোগে ।
মাথা তুলে এই পৃথিবীর বুকে আরেকবার দাড়াতে চাই, নিঃসংকোচে, র্নিভাবনায় এবং বীরদর্পে !

“এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয় ।”


০৯/১১/১২ পাবনা ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×