গল্পটির তিনটি পর্বের মধ্যে 1মটি নিচে পোষ্ট করা হলো )[/ইটালিক]
অর্নব নামেই আমি পরিচিত । অত্যন্ত ভ্রমনবিলাসী বলেই নিজেকে ভাবি। আমি যেন এক যাযাবর। অবসর পেলেই ঘুরে বেড়াই। মন যেখানে যেতে চায় সেখানেই আমার ভ্রমন।
পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। শেষ আপাতত ক্যাম্পাসের আড্ডা, যে আড্ডার উজ্জ্বল প্রতিফলনের মাঝেও আমি সদাই ম্রিয়মান। সব কিছু থেমে যেতেই অবসর এল আর সুপ্ত মন যেন জেগে উঠল ভ্রমনের দুর্নীবার আশায়। যা ভাবা সেই কাজ। পরদিন সকালেই ভৈরববাজারের ট্রেনের উদ্দেশ্যে পৌঁছালাম কমলাপুর স্টেশন। সাথে আমার সঙ্গী অন্য সবসময়ের মতই চামড়ার একহাতি ব্যাগটা। কমলাপুর রেল স্টেশনে আসলে, বিশেষ করে এই ভোরবেলা যে লোকগুলোকে যত্রতত্র শুয়ে থাকতে দেখা যায় তারা যেন পৃথিবী নামক কাহিনী ভান্ডারের মূল গতি সঞ্চালক। সুরম্য অট্টালিকায় চোখ ধাধানো বৈভবে আরম্বর পালঙ্কে শুয়ে গনতন্ত্রের নির্যাস আত্ত্বস্ত কারিরা ভুল গল্প রচে রচে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে না পারলেও প্রকৃতির উদাম বিস্তৃতিতে এদের নিশ্চিন্ত ঘুম ঠিকই হয়। এদের নেই নিরাপত্তার ভাবনা, নেই বিত্তের প্রচন্ডরকম দুর্বিষহ চাপ; সমাজের কোন ভাবনাও নেই এদের। এদের শুধু এক ভাবনা ক্ষুধার্ত পেট যার পূজোতে ঘুম থেকে উঠেই এরা দৌড়াতে শুরু করবে আর কেবল দৌড়াতেই থাকবে নিগৃহীত বেশে অত্যন্ত বিভেদী একপেশী অচেনা সমাজে।
টিকেট কেটে সময়মত ট্রেনে চড়লাম। ট্রেনের ঘটাং ঘটাং শব্দকে সাদরে বরণ করে নিতে নিতে একসময় পৌঁছে গেলাম ভৈরব জংশনে এবং সেখান থেকে মেঘনার তীরে অপূর্ব নিসর্গ আবেশে জড়ানো ছোট খালার ছিমছাম বাড়ীতে। অজানা সাগরের দিকে বয়ে চলা মেঘনার জলের গতি আর হিমেল হাওয়ায় ভ্রমনের মাঝে খুঁজে পেলাম সজীব উদ্যম। কিন্তু পথিকের কি আর এক জায়গায় বসে থাকলে হয়। একদিন যেতে না যেতেই ভীষণ উদ্যমে খালার মনটাও খারাপ করে দিয়ে চট্টগ্রাম যাব বলে মন স্থির করে নিলাম। যা ভাবা তাই। পরদিন সন্ধ্যায় ট্রেনের টিকেটও কাটা হয়ে গেল। খালার অকৃত্রিম অনুরোধ উপেক্ষা করে যথাসময়ে উপস্থিত হলাম ভৈরব স্টেশনে। এসেই শুনলাম ঢাকা থেকে ট্রেন দেরী করে ছেড়েছে। তাই যা হবার, অপেক্ষা করতে হবে। বিশাল জংশনের প্লাটফর্মেরএকপাশে নিরিবিলি একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম অপেক্ষার সাথে ক্ষণিকের বন্ধুত্ব গড়তে। সহযাত্রী হবে যাদের মনে হচ্ছিল তাদের অনেককেই চলে যেতে দেখলাম। হয়তো আশেপাশেই বাড়ী। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আসবে আর কি। মোটামুটি নির্জন একটা প্লাটফর্ম হয়ে গেল জনাকীর্ণ এলাকাটা। একাএকা বসে আছি বলে ঘুম যেন আগ্রাসী হয়ে সঙ্গ দিতে চাইছে সুযোগে।
হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাশের ছোট এক কামরায়।বসে আছি জানালার পাশে। বাইরে একটি ঘন সবুজ গাছ। অন্ধকারেও স্পষ্ট ভাবে চেনা গেল বকুল গাছের পাতাগুলোর ঘন সন্নিবেশ।
বকুল ফুলের অপূর্ব গন্ধও ভেসে আসছে নাকে। গাছের লম্বাডালটিতে বসে একটা কাঠঠোকরা পাখী ঠক্ ঠক্ করে ঠোকরাচ্ছে আর বিলোচ্ছে দৃষ্টিতে সোনালী বর্ণের আনন্দ তার অপূর্ব সোনালী পালক হতে। আকাশে হালকা মেঘ মাঝে মাঝে লকোচুরি খেলছে জ্যেৎস্নালো ছড়ানো চাঁদের সাথে। সত্যিই মায়াবী আবহ। খুব ভাল বোধ হতে লাগল মনে মনে। মুখটা ঘোরাতেই দেখতে পেলাম আমার সামনের সিটে মুখোমুখি বসে একজন হাসছে অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে। বেশ চেনাচেনা মুখ তবুও চিনতে পারছিনা কিছুতেই।
আমি কিছু বলার আগেই সেই বলে উঠল, কি ওমন করে কি দেখছিস। চিনতে পারছিস না।
সত্যিই আমি আপনাকে চিনতে পারছিনা।
মনে মনে ভাবলাম আমাকে তুই করে বলছে , ঘনিষ্ঠ কেউই তো হবার কথা , চিনতে পারছিনা কেন?
আবর সে কথা বলে উঠল, অর্নব ভাবছিস আমি তুই করে বলছি কেন? ভাবতে থাক। চিনলে দেখবি তুইও ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলতে শুরু করেছিস।
কি ব্যপার মনের কথাও বুছে ফেলছো? তুমি যেই হও এখানে এলে কখন? দেখলাম না কেন?
আমি তোর সব প্রশ্নের উত্তরই দেব। কেন দেবনা। একমাত্র তুইইতো আমার সব কথা মন দিয়ে শুনিস। তুই ই যে আমার সব চেয়ে কাছের। তোর সব চিন্তা ভাবনা, মতাদর্শ সবই যে আমার জানা। আমি এসছে তোর সাথে সাথেই , টের পাবি কি করে, বাইরের পৃথিবীর মুগ্ধ মায়ায় ভুলে ছিলি যে। তোর মত প্রকৃতি প্রেমিক এই কল্পসম্ভব জগতে একবার ঢু মারতে শুরু করলে আর কি কোন কিছুর খেয়াল থাকে রে। কথা বলতে থাক আমার সাথে ঠিকই চিনতে পারবি অর্র্নব। দেখেছিস চাঁদের চারপাশ ঘিরে কি সুন্দর তারার হাট বসেছে। শুধু কিন্তু প্রকৃতিই নয় আজ রাতে পুরো জগতটাই অন্যরকম। অনেকটা তোর স্বপ্নের জগতটার মত। আজ রাতে কোথাও কেউ ক্ষুধার্ত নয়। কমলাপুর স্টেশনে শুয়ে নেই খেয়ে বা না খেয়ে কেউই। আজ রাতে পথে নেমেছে গনতন্ত্রের ধ্বজাধারী টাকায় আচ্ছাদিত জ্ঞানীর দল , তারা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে তোর ইচ্ছে।
মিথ্যে কথার আর জায়গা পাওনা, না। সব বানিয়ে বলছ আমাকে খুশি করার জন্য।
হতে পারে। কারন আমিই একমাত্র জানি তোর খুশি কিসে। তোর সাথে আমার এতটা সময় কেটেছে যে না জেনে কোন উপায় নেই। সব জানি তোর ।
কিন্তু তাহলে আমি তোমাকে চিনতে পারছিনা কেন।
আজ যে চারপাশে প্রচন্ড আনন্দ । চিনতে পারবি , এইতো সবে আপনি থেকে তুমি বলছিস। একটু পরে তুই তেও নামবি।
আচ্ছা তোর মনে পরে ঢাকায় একবার তুই রমনা পার্কে একা শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিলি। হঠাৎ একটা ছোট মেয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে তোর কাছে এলো। তার গায়ে একটুকরো ছেড়া ত্যানা, আর কিছুই ছিলনা। মেয়েটা বলল , " সাব আমি কাল তোন কিছু খাইনাই। আমারে ২ টা টাকা দিবেন।"তুই তাকে হোটেলে নিয়ে পেট পুরে খাইয়েছিলি। কিনে দিয়েছিলি নতুন কাপড়। তোর মনে পড়েনা সেদিন মেয়েটা যেন জীবনে প্রথম হেসেছিল খুশি মনে। এই নিয়মসর্বস্ব সমাজে দারিদ্রপিষ্ঠ শিশুটি চলে যাবার সময় বলেছিল," ফেরাশতা কেমুন জানিনে, তয় আপনি হেইরকম কিছু একটা। আপনি আমাগো দুনিয়ার না ।" তুই কোন কথা বলতে পারিসনি। কেবল তার চলে যাওয়া দেখেছিলি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে ঐ মেয়েটা যতি জানত তুই সেই মানুষই, ফেরেশতা টেরেশতা কিছু না, যে কিনা একটা বই এর পৃষ্টা ছেড়ার জন্য বাড়ীর কাজের ছেলেটার মুখে পাঁচ আঙ্গুলের মানচিত্র এঁকে দিয়েছিলি। বন্ধ করেছিলি পাগলা রাগে তার এক বেলার খাবার । জানতে ইচ্ছে করে মেয়টা সে ঘটনা জানলে কি বলত তোকে?
(চলবে..................)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০০৬ সকাল ৮:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



