somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রণাঙ্গনের চিঠি (মুক্তি যুদ্ধের গল্প)

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৭১ সালে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেক যোদ্ধা আহতাবস্থায় মাইনকার চর সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সামছু এক পা হারিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। প্রচন্ড ব্যাথায় সারা শরীরে জ্বর। উঠতে বসতে পারছে না। এই অবস্থায় তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। কিন্তু যত কষ্টই হোক আহত হওয়ার কথা মাকে বলা যাবে না। ছেলে আহত হয়েছে একথা শুনলে মা হয়তো সহ্য নাও করতে পারে। কেঁদে কেঁদে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। তাই হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিজের এত কষ্ট সত্বেও মাকে চিঠি না লিখে বন্ধু সৈকতের কাছে চিঠি লিখল।

প্রিয় বন্ধু সৈকত,

প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল। আজ সাত মাস হলো তোদের সাথে দেখা করতে পারছি না। জানিনা তোরা কেমন আছিস? আমি বর্তমানে ভারতের তুরা পাহাড়ের একটি হাসপাতালে আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে, সাথে তোদের কথাও। এখানে আমার পরিচিত কেউ নেই। সবাই অপরিচিত।

তোদের না জানিয়ে হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধে চলে এসেছি। জানিয়ে আসার সুযোগ ছিল না। মাকে ফাঁকি দিয়ে এসেছি। মাকে যুদ্ধের কথা বললে আসতে দিতো না। মায়ের বুক জুড়ে আমরা মাত্র দুটি ভাই। ছোটকালে বাবা মারা গেছেন। অনেক কষ্টে মা নিজে খেয়ে না খেয়ে আমাদের মানুষ করেছেন। সেই মাকে যদি বলি, মা যুদ্ধে যাব, মা কোন দিনই রাজী হতো না। তাই মাকে না জানিয়ে আমার পাশের গ্রামের অন্য তিনজন বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে ভারতের পথে রওয়না হই। আমরা চারজন নিজেদের কাছে থাকা সামান্য কয়টি টাকা নিয়ে প্রথমেই যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে মোল্লার চর আসি। সেখানে এক কৃষকের গোয়াল ঘরে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে নৌকায় সানন্দবাড়ী পৌঁছি। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মাইনকার চর এসে আমরা চারজন মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাই।

তুরা পাহাড়ে একমাস ট্রেনিং করার পর ১৩ জনের একটি টিম নিয়ে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি এবং রাতের অন্ধকারে একটি ব্রীজে পাহারারত খান সেনাদের সাথে যুদ্ধ করি। এই যুদ্ধে আমরা পুরোপুরি সফল হই এবং কয়েকজন খান সেনাকে হত্যা করে ১টি মেশিনগান ও ৬টি রাইফেল নিয়ে পুরো টিম সশরীরে অক্ষত অবস্থায় ভারতের মাইনকার চর ক্যাম্পে ফিরে আসি। এটা আমার জীবনের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পর আমার সাহস, উদ্দীপনা, উৎসাহ দ্বিগুন বেড়ে যায়। এর পর আমি আরও ১৭টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। যদি কোনদিন তোদের সাথে সরাসরি দেখা করতে পারি, তখন সে সব যুদ্ধের দুর্ধর্ষ কাহিনী বলব।

গত তিন দিন আগে একটি যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমরা ৭০জন মুক্তিযোদ্ধা এই দলে ছিলাম। দিনে নৌকাযোগে ৭০জন মুক্তিযোদ্ধা কালাসোনার চরে এসে একত্রিত হই। এরপর রাতে মানাস নদী পার হয়ে পশ্চিম পাড়ে এসে সবাই একসাথে লম্বা লাইন ধরে হাঁটতে থাকি। রাত ৩টার সময় আমরা কাটাখালি ব্রীজের চার দিকে অবস্থান নেই। এখানে পাক সেনাদের শক্ত ঘাঁটি। এই ব্রীজটি দখল নিতে পারলে এবং ভেঙ্গে দিতে পারলে উত্তরবঙ্গের সাথে ওদের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হবে। কিন্তু আমাদের আগমনের বার্তা এই স্থানে আসার পরপরই দালাল রাজাকারদের মাধ্যমে দ্রুত খান সেনাদের কাছে পৌছে যায়। যে কারণে ওরা সচেতন হয়ে যায়। পজিশন নিয়ে গুলি করার সাথে সাথেই তাদের তরফ থেকে ভারী কামান, মেশিন গান এবং রাইফেলের গুলি চলতে থাকে। প্রায় দু’ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর পুবাকাশ ফর্সা হয়ে আসে। ওদের ভারী অস্ত্র-সস্ত্রের কাছে আমরা খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলাম না। তারপরও আমাদের গেরিলা হামলায় ওদের বেশ কিছু সৈন্য খতম হলো। ইতোমধ্যে আমাদেরও দু’জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারালো। আমরা তাদের লাশ কাঁধে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে আসি। লাশ হায়েনাদের হস্তগত হতে দেইনি।

কাঁটাখালি থেকে প্রায় তিন মাইল উত্তর পূর্ব দিকে একটি বিশাল বাঁশ ঝাড়ের ভিতর আমরা কয়েকজন আশ্রয় নেই। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় গিয়েছে তখনও জানিনা। সকাল বেলা খান সেনারা ঐ অঞ্চলে আরো সৈন্য মোতায়েন করে। বাড়ি বাড়ি তল্লাসী করে। কিন্তু আমাদের কাউকে খুঁজে পায় নি। বাঁশ ঝাড়ের ভিতর চুপচাপ আমরা এগার জন বসে আছি। সাথে খাবার নেই। ক্ষুধায় নাড়িভুঁড়ি এক হয়ে যাচ্ছে। আধ পেটা খাবার খেয়ে রওনা হয়েছিলাম। কাঁধে ভারী অস্ত্র আর কোমরে গুলির বোঝা নিয়ে সারা রাত হেঁটে হেঁটে এবং দু’তিন ঘন্টা যুদ্ধ করে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত হয়েছি। চারিদিকে খান সেনা এবং রাজাকারদের পাহারা। এর মধ্যে কারো কাছে খাবার চেয়ে খাওয়ার জন্য বাঁশ ঝাড় থেকে বের হওয়া নিরাপদ নয়। সারাদিনে একফোটা পানিও মুখে পড়েনি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চেয়ে দেখি বাঁশ ঝাড়ের মাঝখানে একটি গর্তের মাঝে কিছু পানি দেখা যায়। অগত্যা ওষ্ঠাগত প্রাণ বাঁচানোর জন্য পানির উপর ভেসে থাকা বাঁশের পঁচা পাতা সরিয়ে দু’হাতের অঞ্জলি ভরে সেই পানি সবাই খেয়ে নিলাম। এতে শুস্ক গলা ভিজার পাশাপাশি দেহে একটু শক্তি সঞ্চার হলো।

বৃষ্টি ভেজা স্যাতস্যাতে মাটিতে সারাদিন শুয়ে বসে সময় কাটতে চায় না। একেক ঘন্টা একেক বছরের মতো মনে হচ্ছে। তারোপর মশার উপদ্রব। খুব ঘন বাঁশ ঝাড় হওয়ায় বেলা কতটুকু হয়েছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। কারো হাতে ঘড়ি ছিল না। তবে আস্তে আস্তে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। তাতে মনে হলো পরন্ত বিকাল বা সন্ধ্যা হবে হবে ভাব। রাতের অন্ধকারের অপেক্ষায় সবাই কাল ক্ষেপণ করছি। এমন সময় বাঁশঝাড়ের বাহিরে গুলির শব্দ শোনা গেল। পরিস্থিতি অবলোকন করার জন্য যেই দাঁড়িয়েছি কিছু বুঝে উঠার আগেই কোথা থেকে একটা গুলি এসে আমার ডান পায়ের হাঁটুর উপর লাগল। হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ে গেলাম। অস্ফুট স্বরে আমার পাশের মুক্তিযোদ্ধাকে স্মরণ করে বললাম, সামাদ ভাই।

সামাদ ভাই আমার কথা শুনে তাকিয়ে দেখে আমি মাটিতে পড়ে গেছি। আমার পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। সে তাড়াতাড়ি তার কোমরে থাকা গামছা দিয়ে আমার পা শক্ত করে বেঁধে দিল। ব্যাথায় আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কিন্তু খান সেনাদের হাত থেকে জীবন বাঁচানোর ভয়ে কোন উচ্চবাচ্য করতে পারছিলাম না। এর পর কখন অজ্ঞান হয়ে পড়েছি আর বলতে পারি না।

জ্ঞান ফিরে এলে তাকিয়ে দেখি আমাকে কালাসোনার চরে অস্থায়ী ক্যাম্পে আনা হয়েছে। একজন গ্রাম্য ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মাইনকার চর হাসপাতালে পাঠানোর জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। অসহ্য ব্যাথা নিয়ে একদিন পর মাইনকার চর এসে পৌঁছলে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আমার বর্তমানে পায়ের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। জানিনা পায়ের আগের অবস্থা ফিরে পাব কিনা? তবে তোরা আমার জন্য দোয়া করিস। আমি যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে উঠতে পারি এবং আবার যুদ্ধে যেতে পারি। যতদিন পর্যন্ত এদেশ স্বাধীন না হবে ততদিন পর্যন্ত যেন এ যুদ্ধ থেকে আমি পিছু পা না হই।

তোকে আরেকটি কথা বলতে ভুলে গেছি। আহত হওয়ার কয়েকদিন আগে মাইনকার চরের উত্তরে একটি শরণার্থী শিবিরে গিয়েছিলাম। পরিচিত কাউকে খুঁজে পেলাম না। তবে এমন একজনকে পেলাম যা কখনও কল্পনা করি নি। আমাদের স্কুলের সেই অনীতার সাথে দেখা। তোর তো চেনার কথা? বাজারের নবানু দত্তের মেয়ে অনীতা। আমাদের নিচের ক্লাসে পড়তো। তোর সেই ঘটনা মনে থাকার কথা। জৈষ্ঠ্য মাসে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে পাকা আম দিয়ে ওকে ঢিল মেরেছিলাম। ওর বাবা পরদিন স্কুলে হেডমাস্টারের কাছে বিচার দিয়েছিল। হেড মাস্টার আমাকে কান ধরে সারা স্কুল ঘুরিয়ে টিচারদের কমন রুমে নিয়ে দশ ঘা বেত মেরেছিল। এরপর থেকে ওর উপর আমার খুব ক্ষোভ ছিল। যে কোন ভাবেই হোক এর প্রতিশোধ নেব। কিন্তু এখানে দেখা হওয়ার পর আমার সে ক্ষোভ আর নেই।

নবানু দত্ত মনে হয় বেঁচে নেই। খান সেনারা বাজার থেকে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। আর ফিরে আসেনি। এই শরণার্থী শিবিরে শুধু অনীতা আর ওর মা ছাড়া আর ওদের নিজস্ব কেউ নেই। দু’জনেই একবস্ত্র পরিধান করে আছে। ওদের আর কোন পরিধানের বস্ত্র নেই। একদম খালি হাতে কোন রকমে জান নিয়ে এই শিবিরে এসেছে। অনীতার আগের চেহারা নেই। অনাহারে অনিদ্রায় শুকিয়ে গেছে। পানির অভাবে টবের ফুল শুকিয়ে যে অবস্থা হয়, অনীতার চেহারাও তেমন হয়েছে। আমি শরণার্থী শিবিরে ওকে প্রথমে দেখি নি, ওই আমাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে পিছন থেকে নাম ধরে ডাক দিয়েছে। মেয়েলি কণ্ঠে আমার নাম উচ্চারণ করায় আমি প্রথমে চমকে উঠি। তাকিয়ে দেখি অনীতা। কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠি, অনীতা তুই এখানে? আমার মুখ থেকে ওর নাম উচ্চারণ করতে যত না সময় লাগল ওর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে তত সময় লাগল না। আষাঢ়ের বরষার মত ঝরঝর করে চোখের জল ছেড়ে কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, সামছু ভাই ভাল আছেন? আমি ওর চোখের জল আর কান্না দেখে নিজের অজান্তেই নিজেই কেঁদে ফেললাম। ভিজা ভিজা কণ্ঠে বলে উঠলাম, ভাল আছি, তোরা কেমন আছিস? কাকা-কাকী কেমন আছে? এখানে কোথায় থাকিস?
আমার একথা বলার পরে ও আর আমার কথার উত্তর দিতে পারল না, কাঁদতে কাঁদতেই আমার হাত ধরে টেনে তাঁবুতে নিয়ে গেল।

গিয়ে দেখি ভারত সরকারের দেয়া তাঁবুর নিচে রিলিফের দু’টি কম্বল, দু’টি এ্যালুমনিয়ামের হাঁড়ি, দু’টি এ্যালুমনিয়ামের থালা ও একটি এ্যালুমনিয়ামের গ্লাস ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়েছিলাম। তাঁবুর নিচে কম্বলে গা এলিয়ে দিলাম। ওর মা এসে আমাকে দেখে কেঁদে দিল। মা মেয়ের কান্নায় নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। মনের অজান্তেই চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। অথচ ওর মায়ের সাথে এর আগে কখনও দেখা হয়নি। এই প্রথম দেখা। ওর মায়ের সাথে কিছু কথা বলার পর মনে হলো আমি যেন তাদের কত চেনা-জানা, কত আপন। আমি যেন তাদের হারানো ছেলে ফিরে এসেছি। এক পর্যায়ে অনীতার মা আমাকে ছেলের মত বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমিও অনেক দিন হলো মাকে দেখি না। বুকে জড়িয়ে ধরে অনীতার মায়ের কান্না দেখে আমিও মায়ের কথা ভুলে অনীতার মাকেই আপন মা ভাবতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পর অনীতার মা কান্না ভেজা চোখে তাঁবুর বাইরে গেলে অনীতা ছোট বোনের মত আমার পাশে বসল। ওর বাবাকে পাক সেনারা ধরে নেয়া থেকে এখানে আসা পর্যন্ত পুরো কাহিনী বলল। ওদের কষ্টের কাহিনী শুনে আমার গা শিউরে উঠছিল। আমি ওদের শান্তনা দেয়ার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ইতোমধ্যেই অনীতার মা একটি থালায় করে কিছু চাউলের খুদ ভেজে নিয়ে এসেছে। আমি খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম। খুদ ভাজা গো-গ্রাসে খেয়ে ফেললাম। খাওয়ার সময় ওদের কথা মনেই ছিল না। খাওয়ার পর মনে হলো সবগুলো খুদ খাওয়া ঠিক হয়নি। ওদের ঘরে হয়তো আর কোন খাবার নেই। আমি সবগুলো খুদ খেয়েছি, আমার এই বিবেকহীন কর্মের জন্য হয়তো ওরা সারাদিন না খেয়ে থাকবে। একটি মাত্র পানি খাওয়ার গ্লাস। সেই গ্লাসে করে ওর মা পানি এনে দিল। আমি ওদের গ্লাসে পানি খেতে ইতস্তত করছিলাম। অনীতা বিষয়টি টের পেয়ে বলল, দাদা এখানে ইতস্তত করে লাভ নেই, আমাদের আর কোন গ্লাস নেই, ওটাতেই খেতে হবে।
আমি বললাম, আমি মুসলমান, তোদের ধর্মে আবার ছুঁয়া ছুঁয়া ভাব বেশি, আমি গ্লাসে পানি খেলে তোর মা যদি এই গ্লাসে আর পানি না খায়? তখন তোর মায়ের খুব কষ্ট হবে।
অনীতা বলল, অসুবিধা নেই দাদা, আমি ভাল করে মাকে গ্লাস ধুয়ে দিব।
আমি তৃপ্তিসহকারে পানি পান করে উঠতেছিলাম। অনীতার মা বলল, আরেকটু বস বাবা।
আমি বললাম, আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের উপর কখন কোন নির্দেশ আসে সেই নির্দেশ মোতাবেক যুদ্ধে যেতে হয়। কাজেই কাকী আমি আর দেরি করতে পারবো না। সময় পেলে আবার আসব।

আমি মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ করছি একথা শুনে অনীতার মা খুব খুশি হলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের মায়ের মতো আশীর্বাদ করল। আমার মাথায় হাত বুলানো দেখে মনে হলো-- আমার নিজের মা যেন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করছে। এখানে এসে হিন্দু-মুসলিম মায়েদের মধ্যে কোন পার্থক্য পেলাম না। মনে হলো সব ধর্মের মায়েরা নিজের মায়ের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের মঙ্গল কামনা করে আশীর্বাদ করছে। আসার সময় বিদায় নিতে গিয়ে তাদের দু’জনের চোখের জল দেখে নিজের চোখ আবার ভিজে গেল। ভেজা ভেজা কণ্ঠে বললাম, কাকী আসি।
অনীতার মা বিদায় দেয়ার সময় বারবার বলল, বাবা সময় পেলেই এখানে এসে তোমার এই অসহায় মা-বোনকে একনজর দেখে যাবে কিন্তু।
আমি মাথা কাত করে সায় দিয়ে বললাম, ঠিক আছে কাকী মা, আমি যখনই সমায় পাবো তখনই এসে আপনাদের দেখে যাবো।

ক্যাম্পে ফিরে এসে ওদের অসহায় দু’টি মুখ আমার চোখে বার বার ভাসতে লাগল। আমার মনে হলো ওদের কিছু সাহায্য করা দরকার। নিজের কাছে কোন টাকা ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা সামাদ ভাইয়ের কাছ থেকে পাঁচটি টাকা ধার নিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে অনীতাদের দিয়ে আসব। তাতে ওরা দু’কেজি চাল কিনে খেতে পারবে। কিন্তু রাতেই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নির্দেশ এলো। মুক্তিযোদ্ধার দলের সাথে রাতেই বাংলাদেশে চলে গেলাম। তাই আর ওদের ওখানে যাওয়া হলো না।

যুদ্ধে আহাত হয়ে ফিরে এসেছি। এখন আহত অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আপনজনদের কথা খুব মনে পড়ছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও আপনজন কারো সাথে দেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে বার বার শুধু একথাই মনে পড়ছে আমার মা, অনীতার মা এরকম কোটি মায়ের আশীর্বাদের কারণেই হয়তো এ যাত্রা ভয়াবহ যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে প্রাণে বেঁচে এসেছি।

অবশেষে তোকে একটি অনুরোধ করতে চাই, সেটা হলো-- তুই কষ্ট করে যদি আমার বাড়িতে একটু যাস, তাহলে মাকে বলবি আমি খুব ভাল আছি। আমার আহত হওয়ার কথা ঘুণাক্ষরেও বলবি না। যদি মা জানতে পারে আমি যুদ্ধে আহত হয়েছি, তা হলে হয়তো সে আমার শোকে কেঁদে কেঁদে মরে যাবে। আরেকটি অনুরোধ আমার সহজ সরল ছোট ভাইকে একটু দেখে শুনে রাখিস। যুদ্ধ থেকে ফিরে স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়ে তোদের সামনে যেন ফিরে যেতে পারি এই আশা ব্যক্ত করে এখানেই চিঠি লেখা শেষ করছি।

ইতি
তোর বাল্য বন্ধু
সামছু

ছবি নেট
(লেখাটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বইয়ে প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:২৭
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×