somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইঁদুর তাড়ানো তাবিজ (রম্য গল্প)

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

অগ্রহায়ণ মাস। সব ঘরেই এলোমেলো ভাবে ধান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে। ঘরে বা উঠানে ধান জমিয়ে রাখলেই ইঁদুর গর্ত করে মাটির নিচে নিয়ে যায়। ইঁদুরের এই উৎপাত থেকে কোন ভাবেই রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি ঘরে তুলে রাখা কাঁথা কাপড়গুলাও কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে।

ইঁদুরের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে দাদী দাদাকে দিয়ে হাট থেকে “ইদুরের যম” নামে ইঁদুর মারার বিষ টোপ কিনে এনেছেন। সন্ধ্যার সময় দাদী ইঁদুরের মুখরোচক খাবার শুটকির গুড়া, চাউল ভাজা, গম ভাজা ইত্যাদির সাথে বিষ টোপ মিশিয়ে ইঁদুরের গর্তের উপরে রেখে দিয়েছেন। এমনভাবে খাবারগুলো রেখেছেন, ইঁদুর গর্ত থেকে বের হলেই খাবারগুলো সামনে পরবে অমনি মজা করে খেয়ে মরে যাবে। খাবারগুলো শুধু দু’এক জায়গায় নয় বাড়ির ঘরে-বাইরে যেখানেই ইঁদুরের গর্ত দেখেছেন সেখানেই বিষ টোপ দিয়েছেন। বিষ টোপ প্রয়োগ করে দাদী মনে মনে ভেবেছেন, এই বিষ টোপ খেয়ে ইঁদুর লাইন ধরে মরবে, আর সকাল বেল তিনি লেজ ধরে ধরে দূরে ফেলে দিয়ে আসবেন। এই ভেবে হয়তো দাদী সারা রাত নিশ্চিন্তে মনের সুখে ঘুমিয়েছেন।

কিন্তু দুখের বিষয় সকাল বেলা সারাবাড়ি খুঁজে একটা মরা ইঁদুরও পাওয়া গেল না। গর্তের উপর যেমনভাবে বিষ টোপ দেয়া ছিল তেমনই পড়ে আছে। অবস্থা দেখে দাদী মনের দুখে ইঁদুর না মরার রাগটা দাদার উপর ঝাড়তে লাগলেন। দাদাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে জোরে বললেন, বুড়া হইলে মাইনষের হুঁশ জ্ঞান কম হয় জানি, কিন্তু এতো কম হয় তা তো জানি না। এতো কইরা কইলাম, যত ট্যাকা লাগে লাগুক, ইঁন্দুরের ভাল বিষ টোপ কিনা আনার জন্যে, যাতে ইঁন্দুর একবার খাইলেই মইরা যায়, উনি এমন বিষ টোপ কিনা আনছেন, ইঁন্দুর মরা তো দূরের কথা বিষ টোপ খায়া ইঁন্দুর আরো উল্টা নাচানাচি শুরু কইরা দিছে। একটা ইঁন্দুরও মরে নাই। এমন ব্যাক্কল বুইড়া আমার কপালে জুটছিল। সারাটা জীবন খালি ভুইগা গ্যালাম।

দাদা ঘরেই বসা ছিল। দাদীর খোঁচা মারা কথা দাদার পৌরুষত্বে আঘাত হানল। তিনি মুহুর্তেই চটে উঠলেন। গলায় জোর খাটিয়ে দাদীকে ধমক দিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার চুপ হয়ে গেলেন। কারণ বিষ টোপ খেয়ে একটা ইঁদুরও মরে নাই। দাদীর খোঁচা মারা কথা দাদার সহ্য হওয়ার কথা নয়। বয়সকালে দাদার মুখের উপর কথা বলা তো দূরের কথা, চোখ তুলে তাকাতেও দাদীর সাহস হতো না। কিন্তু এখন বুড়া হয়েছেন তাই দাদী খোঁচামারা কথা বলার সাহস পেলেন।

কিন্তু দাদা বুড়া হলে কি হবে শরীরের শক্তি কমে গেলেও মুখের জোর কমে নাই। কারো খোঁচা মারা কথা তো দূরের কথা, সামান্য অন্যায় পেলেও তাকে ছেড়ে দেন না। সেই দাদা এমন প্রতিবাদী মানুষ হয়েও কেন যে দাদীর আলপিনের খোঁচার মত কথাগুলো সহ্য করে গেলেন সেটা আমাদের কারো বুঝে এলো না। তবে দাদীর কথায় প্রতিবাদ না করলেও রাগে দুঃখে বাড়ির ভিতরে নয় বাহিরে চলে গেলেন।

এদিকে ইঁদুর মরে নাই দেখে দাদী বিষ টোপগুলো পরিস্কার করার কথা চিন্তাও করেন নাই এবং কাউকে পরিস্কার করতেও বলেন নাই। দাদী না বলার কারণে বিষটোপ যেখানে যে অবস্থায় ছিল ঔ অবস্থায় পড়ে থাকল।

সকাল দশটার দিকে হঠাৎ বাড়িতে হইচই শুরু হয়ে গেল। ইঁদুর না মরলে কি হবে বাড়ির পোষা মুরগীগুলো ঠিকই মরা শুরু হয়েছে। ইঁদুর বদমায়েসগুলো না খেলেও সারা রাতের অনাহারী মুরগীগুলো খোয়ার থেকে ছাড়া পেয়েই ক্ষিদের জ্বালায় মুখোরচক বিষ টোপগুলো টপাটপ গিলে ফেলেছে। বিষয়টি কেউ লক্ষ্যই করে নাই।

চোখের সামনে দেখতে দেখতেই অর্ধেক মুরগী মরে সাফ। দাদী মরা মুরগীগুলো জড়ো করে মাথায় হাত দিয়ে হায় হায় করতে লাগলেন। এদিকে মুরগী মরার খবর পেয়ে দাদা কোত্থেকে যেন হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এলেন। মুরগী মরার জন্য নয়, তার ক্রয় করা বিষ টোপ যে দুই নম্বর নয় আসল বিষ টোপ মুরগী মরে সেটা প্রমাণ হওয়ায় তিনি বাহাদুর সেজে গেলেন। দাদীর বকাঝকায় চুপসে যাওয়া দাদার গলা সপ্তমে উঠে গেল। দাদীর উপর হাম্বাই তাম্বাই শুরু করে দিলেন। দাদীকে তিনি যাইচ্ছে তাই গালাগালি করতে লাগলেন। এমন অবস্থা শুরু করে দিলেন, পারলে দাদীকে লাঠি নিয়ে মারতে যান। কেউ তাকে শান্ত হতে বললে তিনি আরো দ্বিগুন জোরে চিৎকার করে উল্টো তাকে ধমক দিয়ে উঠেন। দাদার তর্জন গর্জনে দাদী মেচি বিড়াল হয়ে গেলেন। ডরে ভয়ে দাদার গালাগালির কোন জবাবই দিলেন না। শুধু মরা মুরগীগুলো জড়িয়ে ধরে হায় হায় করে কাঁদতে লাগলেন। এতোগুলো মুরগী মরায় দাদী মাথায় হাত দিয়ে ঠায় বসে থাকলেন। মুরগীর শোকে দু’দিন ভাতই খেলেন না।

কয়েক দিন পরের ঘটনা। দাদী বাড়ীর সামনে দাঁড়িযে আছেন। এমন সময় দু’জন বেদেনী সামনের রাস্তা দিয়ে “শিঙা লাগাই, রস খসাই, বাত খসাই” ইত্যাদি নানা ধরনের আকর্ষণীয় বাক্য বলতে বলতে যাচ্ছিল। দাদিকে দেখে বেদেনী দু’জন রাস্তা থেকে বাড়িতে চলে এলো। এসেই দাদীকে লক্ষ্য করে বলল, শিঙা লাগাবি বু।
দাদীর মুরগী মরার শোক তখনও যায় নাই। সেই দুঃখে দাদী ডান হাত নাড়িয়ে তাড়াতাড়ি জবাব দিলেন, না না, আমার কোন বাত বেদনা নাই, আমার শিঙা লাগান লাগবো না। তোমরা অন্য বাড়ি যাও।
দাদী যতই না না করতে থাকেন ততই তারা দাদীকে পটানোর চেষ্টা করতে থাকে। দাদীও শক্ত মনের মানুষ কোন ভাবেই তাদের কথায় রাজী হয় না। বেদেনীরাও নাছোর বান্দা। কোন না কোনভাবে দাদীকে পটাতেই হবে এমন শপথ নিয়ে বসেছে। তারা যখন দাদীকে পটানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হয় হয় অবস্থা, ঠিক তখনই একটি ইঁদুর পাশের ধানের খড়ের গাদার ভিতর থেকে বের হয়ে অন্য খড়ের গাদায় গিয়ে ঢুকল। ইঁদুরের দৌড়ানো দেখে অল্প বয়সী বেদেনী বলে উঠল, কি গো বু, তর বাড়িতে দেহি ইন্দুরের খামার, দিনের বেলায় ইন্দুর ঘুইরা বেড়ায়, ইন্দুরের চিকিৎসা করস না ক্যা?

ইঁদুরের কথা বলায় দাদীর মুখটা কালো হয়ে গেল। দু’দিন আগে ইঁদুর মারতে গিয়ে বিষ টোপে অনেকগুলো মুরগী মেরেছেন। বুকের মধ্যে সেই জ্বালা এখনো জ্বলছে। বেদেনীর কথায় দাদীর জ্বালা আরো বেড়ে গেল। মুখটা ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন, আরে ব্যাক্কল মহিলা কস্ কি? আমরা চাই ইন্দুর মইরা সাফ হয়া যাক, তুই আবার ইন্দুরের চিকিৎসা করবার কস্। বিনা চিকিৎসায়ই ইন্দুর বাড়ি ভইরা গ্যাছে। চিকিৎসা করলে তো ইন্দুরের জ্বালায় বাড়িতেই থাকা যাইবো না।
যুবতী বেদেনীটা লম্বা টানে কথা বলে উঠল, আরে --- বু --- ইন্দুরের রোগের চিকিৎসা করবার কই না--, ইন্দুর যাতে ঘরে না থাকে-- হেই চিকিৎসা করবার ক-- ই-। ইন্দুর খ্যাদাইনা তাবিজ দিমু, ইন্দুর ঘর ছাইড়া পলাইতে দিশ পাইবো না। আল্লাহ রসুলের দোহাই দিয়া কইতেছি, কোনো পয়সা নিমু না, তাবিজ নিয়া সন্ধা রাইতে ঘরের দরজায় বাইন্ধা হুইয়া থাকবি, দেখবি একটা ইন্দুরও ঘরে ঢুকবো না। ইন্দুরের উৎপাত না থাকলে আরামে ঘুমাবি, আরামে থাকবি, জিনিস-পত্র নষ্ট হইবো না।
কথাটি যেন দাদীর মনঃপুত হলো। তাবিজ বেঁধে দিলে যদি ইঁদুর ঘর ছাড়া হয়, তা হলে তো এটাই ভালো। বিষ টোপ গিলে আর কোন মুরগী মরবে না। দাদীর শক্ত মন মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে গেল। দাদী তাবিজ নিতে রাজী হলো। তারা পয়সা নিবে না বললেও, নানা রকম কথার কলা কৌশল প্রয়োগ করে, আল্লা রসুলের দোহাই দিয়ে, হাজার লোকের সিন্নি খাওয়ানোর কথা বলে, অবশেষে তিন সের চাল দাদীর কাছ থেকে নিয়েই ছাড়ল।
তিন সের চাল পেয়ে বয়স্ক বেদেনী তার ঝোলা থেকে বিভিন্ন রকম গাছের ডাল শিকড়-বাকড় বের করে, তার থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ একটি শিকড় চাকু দিয়ে কেটে, লাল সুতা দিয়ে বেঁধে দাদী যে ঘরে থাকে সেই ঘরের দরজার উপরের চৌকাঠের সাথে সুতা দিয়ে বেঁধে দিল। গাছের শিকড়টি বেঁধে দেয়ার সময় ছন্দাকারে ইঁদুর তাড়ানো একটি মন্ত্র পড়ল ---

ইন্দুরেরি হুড়াহুড়ি,
ইন্দুরেরি দোড়াদোড়ি,
ইন্দুরের মাথায় বাঁশ
পথে ঘাটে মারা যাবি
যদি কিছু খাস।

মন্ত্রটি কিছুটা জোরে জোরেই বলল। মন্ত্রটি পড়ে ঝুলানো তাবিজের দিকে তিনটা ফুঁ দিয়ে দিল। বেদেনীর ছন্দাকারে মন্ত্র পড়া দাদীর খুব মনঃপুত হলো। দাদীর খুশি খুশি ভাব দেখে বয়স্ক বেদেনী দাদীর কাছে আরো কিছু দাবী করার চেষ্টা করল কিন্তু দাদী রাজী হলো না। দাদী বলল, যদি ইঁন্দুর ঘর ছাইড়া যায়, তাইলে সাত দিন পরে আইসিস, আরো চাল দিয়া দিমু।

চলবে----
ইঁদুর তাড়ানো তাবিজ (শেষ পর্ব) (রম্য গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২০
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় কুরাইশ বেশি যোগ্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫




সূরাঃ ২ বাকারা, ১২৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১২৪। আর যখন তোমার প্রতিপালক ইব্রাহীমকে কয়েকটি বাক্য (কালিমাত) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, পরে সে তা পূর্ণ করেছিল; তিনি বললেন নিশ্চয়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×