তিনি চিঠিটা খুলে পড়লেন। যাদের কাছে চিঠি এসেছে তাদের কাছে চিঠি পাঠানো যাবে না। ছেলেটা জেলে যাওয়ার পর তারা রাতের আঁধারে কাউকে না জানিয়ে তিনতলা থেকে চলে গেছে। একজন খুনীর পিতামাতাকে জায়গা না দিতে কলোনি থেকে বাড়িওয়ালার উপর চাপ আসছিল।
‘আজই আমাদের ঢাকায় যেতে হবে।’ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন বয়স্কা মহিলাটি। ‘তোকে এখনই আমার একটা ছুটির দরখাস্ত নিয়ে স্কুলে যেতে হবে।’
মেয়েটি স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। মেয়েটার বয়স তেরো। দেখায় আরো কম। মেয়েটি বোবা। কিন্তু কালা নয়। বোবারা কানে শোনে না বলেই বোবা হয়। মেয়েটি কানে শোনে। ডাক্তার পরিক্ষা করে দেখেছেন। কানে কোন সমস্যা নেই।
মেয়েটি দরখাস্ত নেয়ার জন্য তার পাশে এসে দাঁড়াল। নিঃশব্দে চলাচল করে মেয়েটি, বেড়ালের মত। তিনি টেবিলের উপর থেকে কাগজ টেনে চেয়ারে বসলেন। সস্তা রেডিমেড চেয়ার টেবিল, বিবর্ণ-রঙচটা-মলিন। মেয়েটা খাতার ফাঁকে থাকা কলম বের করে তার হাতে দিল।
‘তুই দরখাস্তটা স্কুলে নিয়ে যা।’ বয়স্কা মহিলা দরখাস্ত লিখতে লিখতে বললেন, ‘এই ফাঁকে আমি ছেলেটার জন্য কিছু খাবার বানিয়ে নেই। যা যা ও খেতে ভালবাসত।’
মেয়েটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের মুখে এক ধরণের কাঠিন্য। পোড়খাওয়া বিধবার সব উপকরণ চেহারার মধ্যে। মা ভেতরে ভেতরে কিছু একটা নিয়ে যুদ্ধ করছে।
‘দরখাস্তটা দিয়েই চলে আসবি।’ মহিলাটি মেয়েটার হাতে দরখাস্ত দিলেন। ওড়না ঠিক করে বুকের উপর টেনে দিলেন ‘পথে কোন ছেলে ছোকরা আটকানোর আগেই। দৌড়ে যাবি দৌড়ে আসবি।
মেয়েটা বেরিয়ে যেতেই মহিলাটি কোমরে আঁচল পেচিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন। ছেলেটি পোলাওয়ের চালের খিচুড়ি ও ঝাল ঝাল ভুনা গরুর গোশত ভালবাসত। তিনি অনেক সঞ্চয়ে কেনা সবুজরঙা সস্তা মাঝারি ফ্রিজটা খুললেন। কয়েক টুকরো চাকা করে বেগুনও ভাজা দরকার। যখনই রন্টুর সাথে আসত, বলত ‘মাসিমা আপনার হাতের ভুনা গোশত খিচুড়ি বেহেশতী খানা। না, সেখানেই কি এমনটি পাওয়া যাবে?’ তিনি প্রথম দিন হেসে বলেছিলেন ‘তুই আমারে মাসিমা ডাকিস কেন?’
‘আপনার চেহারাটা আমার কাছে হিন্দু হিন্দু লাগে তাই।’ তিনি হেসে ফেলতেন। দু বন্ধু খেতে বসত। ছেলেটা বলত ‘রন্টু, খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে গেলে খাওয়া যায় না। ঠান্ডা খিচুড়ি আর গরুর গোবর সমান কথা।’
ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরে ওদের দুজনের সম্পর্ক কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে যেতে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন না। এতদিনের বন্ধুত্ব শুধু দুটি রাজনৈতিক দলের কারণে অন্যরকম হয়ে যেতে পারে?
রন্টু বাড়িতে এলেই বলত ‘সেতু ভুল দলে যোগ দিয়েছে মা। ওদের কোন আদর্শ নেই।
মা তখনও বুঝতেন না রাজনীতি ওদের হাড়ে-মজ্জায় ঢুকে গেছে। হেসে বলতেন ‘আর তোদের দলের বুঝি আদর্শ আছে?
রন্টুর চোখ মুখ কঠিন হয়ে যেত। ‘আলবৎ আছে। আমরা আর্দশের রাজনীতি করি। ওদের মত পা-চাটা রাজনীতি করিনা। সুবিধেবাদি রাজনীতি করি না। যতসব পা-চাটা কুত্তার দল।
ছেলের চোখমুখ ভাব পরিবর্তিত হয়ে কঠিন হয়ে যাচ্ছে দেখে স্কুল শিকিা মা কি বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। ‘ওকে তোদের আর্দশ রাজনীতির দলে নিয়ে নে।
‘আসবে না মা। ওরা টাকা দিয়ে ওকে কিনে ফেলেছে। প্রচুর টাকা আছে ওদের দলের। ওরা সন্ত্রাসীও লালন করে। ও একটা সন্ত্রাসী দলে যোগ দিয়েছে মা। এর পরিণতি ওর জন্য ভাল হবে না।
‘বন্ধুকে বুুঝিয়ে বললে বুঝবে না কেন?’ মা সরল বিশ্বাসে প্রশ্ন করেন।
‘ও বুঝিয়ে বলার উর্ধ্বে উঠে গেছে। টাকা ওর চোখ অন্ধ করে দিয়েছে। ও আর এখন আমার বন্ধু নেই। যারা আমাদের দল করে না তারা আমাদের বন্ধু নয়। তারা আমাদের শত্র“।’
তিনি রাজনীতির প্যাচাল বুঝতে পারেন না। দুই বন্ধু একই সাথে বড় হয়েছে। একই ছাদের নিচে বাস করেছে। একজন দোতলায়, একজন তিনতলায়। একই সাথে স্কুল কলেজ শেষ করেছে। একই সাথে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। যদিও দুজনের সাবজেক্ট আলাদা। দুজন দুই হলে থাকত। রাজনীতির পাল্লায় তারা এতটা ওলোটপালোট হয় কিভাবে? দুজনেই অবশ্য ছোটবেলা থেকে বেশ ডানপিটে।
একদিন হঠাৎ সেতু বাড়ি আসে। রন্টু তখন ঢাকায়। সেতু রাতে ভুনা খিচুড়ি গোশত খেতে খেতে বলল ‘মাসিমা, রন্টুরে সামলান। সে ভুল দলে যোগ দিয়ে ভুল পথে চলছে।’ তিনি কিছু না বলে সেতুর দিকে মুখ তুলে তাকান। ‘সে সন্ত্রাসী রাজনীতিক দলের সদস্য। ওরা রাজনীতি করে না। চাদাবাজি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এসব করে বেড়ায়। আমাদের দলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। আমি ওকে সাবধান করে দিয়েছি। তারপরও ওদের দল খুব বেড়ে গেছে।’
হাওয়ায় খবর ভাসে। রন্টু নাকি খুব ডেয়ারিং ছেলে। ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। আশেপাশের মার্কেটে চাদাবাজিও নাকি করে। প্রতিপ রন্টুরে খুব ভয় পায়। ভয়ে মার বুক কাঁপতে থাকে। একটি মাত্র ছেলে। পড়াশুনা শেষে চাকরি করবে। সংসারের হাল ধরবে। বোনটার চিকিৎসা করাবে। তিনি চাকরি ছেড়ে বিশ্রাম নেবেন। কিন্তু এসব কি হচ্ছে? রাজনীতি কেন ওদেরকে গ্রাস করছে?
মেয়েটার ফিরে আসার শব্দ পান। চোখের কোণে থমকে থাকা চোখের জল আঁচলে মুছে টিফিন বাটিতে খাবার সাজান। মেয়েটি রান্নাঘরে ঢুকতেই বলেন ‘গোসল সেরে খেয়ে নে। আজ সারাদিনে আর খাওয়া হবে না কিন্তু।’ তিনি নিজে উঠে কাপড় ছাড়েন। আলমারী থেকে তোলা দামী কাপড় বের করেন। সরকারী অফিস পোশাকের মর্যাদা দেয়।
গোসল সেরে সেজেগুজে মেয়েটা তার সামনে এসে দাড়ায়। মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। মেয়েটা একাই সাজুগুজু করে। তিনি চিরুনী দিয়ে মেয়েটার চুল একটু ঠিকঠাক করে দিতে দিতে বলেন ‘দশটার বাস ধরতে পারলে মোটামুটি বিকালের মধ্যে পৌছে যাওয়া যাবে কি বলিস?’ মেয়েটা পেছনে ফিরে হাসে। বেড়াতে নিয়ে গেলে সে খুব খুশী হয়। ভাইয়া বলেছিল ‘বড় চাকরি পেলে তোকে নিয়ে সারাদেশ ঘুরে বেড়াব। সমুদ্র, পাহাড়, চাবাগান, ঝরনা দেখবি।’
মেয়েটা একা একাই খেয়ে নেয়। তিনি মেয়েটার সাথে টেবিলে বসেন। প্লেটে একমুঠো খিচুড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। মুখে রোচে না। খিদে নেই।
বাস ছাড়তে ছাড়তে এগারোটা বেজে গেল। জৈষ্ট্যের রোদ্দুর এর মধ্যে তাতিয়ে গেছে।
মেয়েটি জানালার ধারে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে মুখ বের করে দিয়েছে। পেছনের বয়স্কা যাত্রীটি বলল ‘মুখ বাইরে মুখ নিও না খুকি। গাছের ডালের বাড়ি খাবে। তাছাড়া পাশ দিয়ে বাস ঘেষাঘেষি করে..’
মা মেয়ের মুখ টেনে ভেতরে নিয়ে এলেন। জানালাটা অর্ধেকের বেশি বন্ধ করে রাখলেন। পায়ের কাছে খাবার ভর্তি টিফিন ক্যারিয়ার। মহিলাটির কোলে একটা হাতব্যাগ। আর কিছুই নেই তাদের কাছে।
কিছুদুর যেতেই আকাশ কালো হয়ে গেল। চারিদিকে অন্ধকার। তারপর বাতাস ছাড়তে শুরু করল। যাত্রীরা ধুলো ঠেকাতে ঝটপট জানালা বন্ধ করে দিল। মেয়েটা জানালা বন্ধ না করায় এক পশলা ধুলো ভরে দিল মা মেয়ের চোখমুখপোশাক। পেছনের যাত্রীটি উঠে দাড়িয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিল। বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি আর সাথে সাথে ঝড় শুরু হলো। জানালার কাচে বৃষ্টির পানি দরদর করে ঝরতে লাগল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানি। যাত্রীরা ড্রাইভারকে বারবার সাবধান করে দিতে লাগলেন দেখেশুনে চালানোর জন্য। কোন তাড়াহুড়ো নেই। সময়ের চেয়ে জীবনের মুল্য অনেক বেশি। বৃষ্টির তোড়ে ড্রাইভারের সামনের কাচ ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে। হেল্পার ন্যাতা দিয়ে বারবার সেটা মুছে দেয়। গাড়ি চলে পায়ে হেটে।
গাড়ি ঢাকায় পৌছে প্রায় সন্ধে নাগাদ। বৃষ্টি কমে গেছে। থামেনি। রাস্তায় পানি জমে আছে। বাস থেকে নেমে মিটারের চেয়ে বিশ টাকা বেশি ভাড়ার একটা সিএনজি ঠিক করে। চালক কোথায় যাবেন জানতে চাইলে বলেন ‘জেলখানায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। পুরানো ঢাকায়।’ রাস্তার পানি কেটে কেটে জলযানের মত সিএনজি যখন কারাগারের গেটে তখন ধর্মপ্রিয় মানুষ মাগরিবের নামাজে ব্যস্ত।
তিনি নামাজ শেষের জন্য জেলখানার গেটে অপো করেন। তারপর হাতব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে দেখান। চিঠিটা নিয়ে সরকারী কর্মচারীটি ভেতরে ঢোকে। কিছুণ পর ছাতা মাথায় একজন উচু পদের কর্মচারীটা এসে জিজ্ঞেস করেন ‘আপনি আসামীর কে হন?
তিনি দুদিকে মাথা নাড়েন। ‘কেউ না। পরিচিত।’
উচু কর্মকতা কি বোঝে কে জানে। তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। কিছু কাগজপত্রে সই করে নাম ঠিকানা লিখে দেন। লেখা ঠিকানা দেখে কর্মকতা প্রশ্ন করে ‘চিঠিটা আপনাদের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছিল?
‘হ্যাঁ। আগে ওই ঠিকানায় আসামীর বাবা মা থাকত। এখন তাদের কোন হদিস নেই।’
‘হ্যাঁ আমরাও বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। পায়নি। ছেলেটাকে ফেলে রেখে ওরা পালিয়েছে। কোনদিন দেখাও করতে আসেনি।’
কর্মচারীটি সামনে, মায়ের হাত ধরে মেয়ে পেছন পেছন এগুতে থাকে। এ ক, ও ক, টানা প্যাসেজ পেরিয়ে তারা একটা নির্জন স্থানে আসে। একটা ভারী লোহার গেট খুলে যায়। তার ভিতরে দুজনে এগিয়ে যায়। মেয়েটার হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। হাঁটার তালে তা থেকে এক ধরণের ধাতব শব্দ হয়।
সেলের ভেতরে দেয়ালের দিকে মুখ করে থাকা কয়েদীর পোশাক পরা ছেলেটি ধাতব শব্দে আকৃষ্ট হয়। রাজনৈতিক নেতারা, দল, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, বাবা-মা একে একে সবাই তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে কে এল দেখতে সে পেছন ফিরে তাকায়।
লোহার গরাদের কাছে এগিয়ে এসে ভাবলেশহীন গলায় বলল ‘মাসিমা আপনি অনেক বুড়িয়ে গেছেন।
মহিলাটি হাসেন। ‘সবারই বয়স বাড়ে বাবা। সবাইকে আগে পরে চলে যেতে হয়।
ছেলেটি মেয়েটার দিকে তাকায়। ‘রেনু দেখি বেশ বড়ো হয়ে গেছে। ও কি একটু একটু কথা বলতে শিখেছে? কোন ইমপ্র“ভমেন্ট?’
রেনু এগিয়ে আসে। মায়ের হাতে টিফিন ক্যারিয়ার দেয়। মহিলাটি হাত ব্যাগ খুলে প্লেট বের করে। টিসু দিয়ে প্লেট মোছে। টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খিচুড়ি, ভুনা-গোশত বের করে চামচ দিয়ে নিচের ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেয়। ‘তুই পছন্দ করতিস। খেয়ে দেখ এখনও খাওয়ার মত আছে কিনা।
ছেলেটা প্লেট নেয়। চামচ দিয়ে খেতে থাকে।
‘খেতে খেতে একটা কথা সত্যি করে বল দেখি বাবা।’ ছেলেটা খাওয়া থামিয়ে মুখ তোলে। ‘তুই কি সত্যিই রন্টুকে খুন করেছিস? কি করে পারলি বাবা? কি করে পারলি?’
ছেলেটা আর খেতে পারে না। ঠান্ডা খিচুড়ি সত্যি তার কাছে গোবরের মত লাগে। গরুর ভুনা মাংসটা হঠাৎ করে বন্ধুর শরীরের মাংসের মত লাগে।
ছেলেটার ঠোট কাঁপে। কথা বলতে কষ্ট হয়। ‘আমি জানি না মাসিমা। আমি কিছুই জানি না। ওরা আমরা মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিলাম। দুদলের হাতেই ছিল অস্ত্র। রন্টুর হাতেও। তখন মাথার ঠিক ছিল না। ওরা তাক করতেই আমরা গুলি শুরু করলাম। না হলে ওরা গুলি করত। রন্টু আমার দিকে গুলি ছুড়ত। পরে জেনেছি আমার গুলিতেই রন্টু...’ ছেলেটা আর বলতে পারে না। শুকনো চোখ বেয়ে গরম পানি বেরিয়ে আসে।
সেল থেকে বাইরে এসে দেখে উচ্চ পদস্থ কর্মচারীটি বদল হয়ে গেছে। আরেকজনের কাছে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। মহিলাটিকে বসিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন ‘আসামীর লাশ নিয়ে যাবে কে?
মহিলাটি নির্বিকার কন্ঠে বললেন ‘আমি।’
‘আসামীর সাথে আপনার কি সম্পর্ক?
‘আমি ওর মা।’
জাতীয় ৈদনিেকর সািহত্য পাতায় প্রকািশত।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





