রিটায়ার্ড পার্সন ও বেকারদের মধ্যে কোথায় যেন মিল আছে। কাজের লোকেরা এদের মানুষ বলে গণ্য করে না। একজন কাজ না পাওয়ায় কাজ করে না। আরেকজন কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে করে না। দুজনেই অকমর্ণ্য। অথচ নির্দিষ্ট কাজ না থাকায় এদেরকেই সংসারেই সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হয়।
এই যেমন মোবারক সাহেব। তিনি রিটায়ার্ড পার্সন। রিটায়ার্ড করার পর তাকে প্রতিদিন কোন না কোন কাজে ব্যস্ত দেখা যায়। প্রায় প্রতিদিনই বাজারে যেতে হয়। বাজার করা ছাড়া সংসারের কিছু টুকিটাকি কাজ আছে। পানির কলের মিস্ত্রি ডেকে আনা। বিভিন্ন বিল জমা দিয়ে আসা। হঠাৎ কারো অসুখ বিসুখে ওষুধ এনে দেয়া। দীর্ঘ তিরিশ বছর চাকরির পর তিনি রিটায়ার করেন। অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাশ সেকশনের জুনিয়র অফিসার হিসাবে চাকরিতে যোগ দিয়ে এজিএম হিসাবে অবসর নিয়েছেন। অবসর নেয়ার পর নিজেকে সংসারের বোঝা, অকাজের লোক মনে হচ্ছে।
ছেলে মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করে। সকাল আটটার আগে বেরিয়ে যায়। বাসায় ফেরে সন্ধে মিলাবার পর। সংসার বলতে গেলে সেই চালায়। টাকার বড় গুণ আছে। টাকা দিয়ে দায়িত্ব থেকে খালাস হওয়া যায়। অথচ তিনি পারেননি। সংসারের জন্য টাকাও দিয়েছেন। ভুতের খাটনিও খেটেছেন। অফিস থেকে ফিরে বাজারে গেছেন। সন্ধ্যের পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে পড়াতে বসেছেন। ছেলে ভাল চাকরি পেয়েছে। ভাল বিয়ে হয়েছে। দুই মেয়েরও ভাল বিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ে জামাইয়ের সাথে ক্যালির্ফোনিয়া থাকে। বছরে একবার দেশে আসে। ছোট মেয়ে জামাই ঢাকায় সেটেলড। ছুটিছাটায় বাড়ি আসে।
সকালে উঠে তিনি বাজারের যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। স্ত্রী সুরমা বেগমকে ডেকে বললেন, ‘কই বাজারের ব্যাগ আর টাকা দাও। চট করে বাজার সেরে আসি। সকাল সকাল গেলে টাটকা জিনিস পাওয়া যায়।’
সুরমা বাজারের ব্যাগ দিল না। নামী কোম্পানির একটা প্যাকেট নিয়ে এল। ‘আজ বাজারে যেতে হবে না। ফ্রিজে যা আছে রান্না করব। তুমি এই প্যাকেটটা নিয়ে পল্লবীতে যাও তো। এখনি বেরিয়ে পড়বে। জামাই অফিসে যাওয়ার আগে পাকড়াও করতে হবে।’
‘কি আছে প্যাকেটে?’
‘প্যাকেটে কি আছে সেটা তোমার জানার দরকার নেই। তোমার দরকার টুটুল বেরিয়ে যাওয়ার আগেই তার হাতে প্যাকেটটা দেয়া।
‘এখনই বেরুব?’
‘হ্যা এখনই। না হলে জামাইকে পাবে না।
‘নাস্তা করব না?’
‘নাস্তা কি ফুরিয়ে যাচ্ছে নাকি? নাস্তা করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ওটা দিয়ে এসে নাস্তা করবে।’
‘ও আচ্ছা।
‘শোন তোমাকে বলি। না হলে তুমি ভজঘট পাকিয়ে আসবে। আজ জামাইয়ের জন্মদিন। জামাইয়ের জন্য বাচ্চু এই কমপ্লিটটা করিয়েছে। কমপ্লিটটা পরেও যেন ও অফিসে যেতে পারে সেটা নিনুকে বলবে। তোমার মেয়েও তো তোমার মত গাধা। প্যাকেট নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখবে।
‘বাস ভাড়ার টাকা দাও।
‘সামান্য বাস ভাড়ার টাকাও তোমার থাকে না। আশর্চ্য মানুষ।’
সকালে বাসে চড়ে মজা। রাস্তায় জ্যাম থাকে না। দিনের এক ঘন্টার পথ পনের মিনিটে আসা যায়।
পল্লবীতে ছোট মেয়ে নিনুর বাসায় এসে দেখে টুটুল এখনও বের হয়নি। তিনি টুটুলের হাতে প্যাকেটটা দিলেন। টুটুল পায়ে দিয়ে ছালাম করল। তিনি আর্শীবাদ করে নিনুকে ব্যাপারটা বলার আগেই নিনু প্যাকেট খুলে কমপ্লিটটা টটুলকে দিয়ে বলল, ‘আজ বার্থ ডে তে বাবার দেয়া এটাই পরে যাবে।
টুটুল একটু আপত্তি করে, ‘এই বয়সে আবার বার্থ ডে।’ তারপর নিনুকে ডেকে বাবাকে আড়াল করে ফিসফিস করে কি যেন বলে।
নিনু জোরেই বলল, ‘তুমি দুপুরেই ফিরতে পার কিনা দেখ। পারলে আসার সময় নিয়ে এসো।’
মেয়েকে গাধা বললেও মেয়ে মায়ের চেয়ে বুদ্ধিমতী। মায়ের কর্মকান্ড সমন্ধে ওয়াকিবহাল। নাস্তা না করিয়েই যে মা বাবাকে পাঠিয়েছে বুঝে ফেলল। জোর করে নাস্তার টেবিলে বসাল। শুধু নাস্তা নয়। দুপুরেও খেয়ে আসতে হলো। আসার আগে জামাইয়ের আনা একটা প্যাকেটও তার হাতে ধরিয়ে দিল।
‘প্যাকেটে কি?’
‘তেমন কিছু না। তোমার জন্য একটা শার্ট আর প্যান্টের পিছ।’
এেেত্র বলতে হয় ‘এসবের কি দরকার ছিল।’ তিনি তা না বলে আতকে উঠলেন, ‘পিচ? মানে কাটা কাপড়?’
‘হ্যা। টেইলার্সে গিয়ে মাপ দিয়ে বানিয়ে নেবে। ও তো তোমার শার্ট প্যান্টের মাপ জানে না। এজন্য রেডিমেড আনতে পারে নি। পিচ এনেছে।
‘দরজির দোকান থেকে তো আমার কখনও কিছু বানানো হয় না। দেখি।
‘দেখাদেখি না। এই সপ্তাহের মধ্যেই বানানো চাই। কিছু না হলেও আগে শার্ট বানাবে। না হলে ও মনে কষ্ট পাবে। ভাববে পিচ বাবার পছন্দ হয়নি।’ বলে নিনু পাচশ টাকার একটা নোট বাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই টাকাটা রাখ। শার্ট প্যান্টের মুজুরি বাবদ।’
জামা কাপড়ের খুব একটা কমতি না থাকায় ওটা বানানোর কথা মনে রইল না। পড়ে রইল আলমারিতে। পরের সপ্তাহে মেয়ে মার কাছে ফোন করল। ‘মা বাবার শার্ট প্যান্ট কেমন হয়েছে?’
মা আকাশ থেকে পড়লেন। ‘কোন শার্ট প্যান্ট?
‘কেন, সেদিন বাবাকে তোমার জামাই শার্টে আর প্যান্টের পিচ দিল না। তোমাকে দেখাইনি।
‘নাতো।
‘তোমরা দুজন মানুষ! কেউ কারো খোজ রাখো না। ওর সাথে মুজরী হিসাবে পাচশ টাকাও তো বাবার কাছে দিয়েছে।’
‘ঠিক আছে। আমি পরে ফোন করছি। আগে দেখি ব্যাপারটা।
সুরমা মোবারক সাহেবের সামনে রনংদেহী মুর্তি ধারণ করল। মোবারক সাহেব মিন মিন করে বলল, ‘তুমি বাসায় ছিলে না। আলমারিতে তুলে রেখেছিলাম। পরে ওটা বানানোর কথা ভুলে গেছি।’
‘নিনু যে পাচশ টাকা দিয়েছিল সেটা আছে না তোমার গর্তে চলে গেছে?’
তিনি মাথা চুলকে বললেন, ‘পুরোটা নাই। সত্তর টাকা খরচ করে ফেলেছি।
‘ঠিক আছে। তুমি আজই টেইলার্সে যাবে। ওগুলো বানাতে দিয়ে আসবে। মেয়ে জামাই শখ করে বাবাকে একটা জিনিস দিয়েছে। তাও বানাতে ভুলে যাও। আশ্চর্য! আমাকে তো কখনও কিছু দেয় না।’
তিনি কিছু বললেন না। বললেন না, প্রতি অনুষ্টানে ছেলে আর দুই মেয়ে মায়ের জন্য একটা করে শাড়ি বরাদ্দ করে। শাড়ি বেড়ে যাওয়ায় ছেলে অটবি থেকে নতুন আলমারি কিনে দিয়েছে।
স্ত্রীর ভয়েই তিনি চুপি চুপি আলমারি হতে শার্টের পিচটা বের করে একটা শপিং ব্যাগে নিলেন। তারপর টেইলার্সের খোজে হাটতে হাটতে নিজের মহল্লা থেকে অন্য মহল্লায় চলে এলেন। কোন টেইলার্সের দোকান চোখে পড়ল না। তিনি অবাক হলেন। ঢাকা শহরে কি দর্জির দোকান নেই? এতদিন ঢাকায় বাস করেছেন ব্যাপারটা তো খেয়াল করেননি? তাইতো ঢাকায় তো পোস্ট অফিস আর দর্জির দোকান চোখে পড়ে না।
শপিং ব্যাগ হাতে হাটতে হাটতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। স্ত্রীর কটু কথা শোনার ভয়ে তিনি আরেকটু খুজে দেখার কষ্ট স্বীকার করেন।
সন্ধ্যের আলো মিলিয়ে যাচ্ছে। মার্কেটে মার্কেটে জ্বলে উঠছে নিয়ন বাতি। তিনি মার্কেটের শেষের দিকে আরেকটু দেখার চিন্তাভাবনা করে এগিয়ে গেলেন। নতুন একটা মার্কেটের কাজ চলছে। সেখানেই কয়েকটা শাটার টানা দোকান। তার মধ্যের একটা দোকান খোলা। দোকানের নতুন সাইনবোর্ড দেখেই তার চোখ একশ বাতির মত জ্বলে উঠল। আর তখনই আশেপাশের সমস্ত বাতি নিভে গেল। লোডশেডিং।
সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে চকচক করছিল ‘দরজিবাড়ি।’ নিচে ছোট ছোট অরে লেখা রুচিশীল টেইলার্স। আর দেখতে হবে না। মরুভূমির মধ্যে মরুদ্যান পাওয়া গেছে।
লোডশেডিংয়ের কারণে অন্ধকারেই দোকানের কাছে চলে এলেন। আশেপাশের অনেকগুলো দোকান খালি পড়ে আছে। শাটারও দেয়নি। যেকটায় শাটার দেয়া। সেগুলো বন্ধ। শুধুমাত্র দরজিবাড়ি দোকানটাই খোলা আছে।
তিনি রাস্তার আলোয় দোকানের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে ভাই, দোকানে কেউ আছেন?
কোন সাড়াশব্দ নেই।
তিনি অবশ্য ইলেকট্রিসিটি থাকা অবস্থায় দোকানের ভেতর দেখেননি। উপরের সাইনবোর্ড এবং নিচে খোলা দেখেই চলে এসেছেন।
তিনি আবার গলা চড়ালেন, ‘দোকানে কি কেউ আছেন?’
হঠাৎ করে তার মুখের উপরেই অন্ধকারের মধ্যে দপ করে মোমবাতি জ্বলে উঠল। তিনি এমন ভয় পেলেন যে পড়ে যাওয়ার ভয়ে সামনের কাউন্টার টেবিল আকড়ে ধরলেন।
কাউন্টারের ওপাশের লোকটা মোমবাতি উচু করে ধরে ভারিক্কী গলায় বলল, ‘কাকে চাই?’
মোমবাতি উচুর কারণে লোকটার বুকের উপর থেকে মুখ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। মোমবাতির আলোর কারণে কিনা কে জানে লোকটাকে বেশ অদ্ভুতই লাগছে। মাথা ভর্তি টাক। তাতে মোমবাতির আলো পড়ে চকচক করছে। লোকটার ভুরু গোফও বোধ হয় পরিষ্কার করে কামানো। এতটাই ফর্সা যে দেখে মনে হয় কেউ শরীর থেকে সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। সম্ভবত রক্তশুণ্যতার রোগী। কিন্তু এসব দেখে তার কাজ নয়। তার কাজ জামা বানিয়ে নেয়া।
মোবারক সাহেব থতমত খেয়ে বললেন, ‘আমি একটা জামা বানিয়ে নেয়ার জন্য এসেছিলাম। দর্জি সাহেব কি আছেন?’
‘আপনার জামা?’ লোকটা এবার মোমবাতি কাউন্টার টেবিলের উপর গলা মোম দিয়ে বসিয়ে দেয়।
‘জ্বি। আমার জন্যই। ছোটজামাই ছিট কিনে দিয়েছে।’
‘এখন বানাতে দিতে চান?’
‘জ্বি। সেজন্যই এসেছিলাম। কিন্তু কারেন্ট নেই দেখে..। না হয় পরে আসি...’
‘অসুবিধে নেই। মোমের আলোয় আপনার মাপ নেয়া কোন সমস্যা নয়। আপনি ভিতরে আসুন।’ দরজি কাউন্টারের একটা টেবিলের প্রবেশ অংশ তুলে ধরে আদেশের গলায় বলল, ‘এই পাশ দিয়ে ভেতরে আসুন।’
এখানকার দরজিদের কাজ কারবার এরকম ভেবেই তিনি ভেতরে ঢুকলেন। লোকটা ড্রয়ার থেকে ফিতে বের করে তার শার্টের মাপ নিতে থাকল। কাধ ঝুল শেষ করে হাতায় এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হাতা করবেন? হাফ হাতা না ফুল হাতা?’
‘ফুল হাতা।
‘ফুল হাতায় চল্লিশ টাকা বেশি পড়বে? কাফলিং দেবেন?’
‘কাফলিংই দিয়ে দেন।’
দরজি ফুল হাতার মাফ নিয়ে মাপগুলো খসখস করে খাতায় লিখল। লিখল বাম হাতে। ডান হাতে ফিতে ধরা বলে? নাকি লোকটা বাম হাতি? কিন্তু মাপ তো সব নিল ডান হাতে। যাকগে যাক, মাপ নেয়া বলে কথা।
প্যাকেট থেকে শার্টের পিছ বের করে ছিটের একাংশ কেটে তার হাতের মেমোতে পিনআপ করে দিল। ‘আপনার ঠিকানা?’
তিনি ঠিকানা বললেন। দরজি বাম হাতে খস খস করে ঠিকানা লিখে রাখল।
‘কবে আসব?
‘ওখানে ডেট লেখা আছে। আপনার কষ্ট করে আসতে হবে না। আমাদের হোম সার্ভিস। আমাদের লোক আপনার বাসায় দিয়ে আসবে।’
‘কিন্তু মুজরির টাকাটা?
‘ওটা আপনাকে এখনই শোধ করে দিতে হবে।
তার ইতস্তত করা দেখে দরজি বলল, ‘আপনার দেড়শ টাকা আর এক পিস ছিট মেরে দিয়ে আমরা কেটে পড়ব না। আমরা একদিনের জন্য ব্যবসা করতে আসিনি।’
এর পরে আর কথা চলে না। তিনি মুজুরির টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে খচখচে মনে দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিলেন। তিনি দোকান থেকে বের হতেই দরজি ফু দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিল। তিনি অবাক চোখে পিছনে দোকানের অন্ধকারের দিকে তাকালেন।
সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই দরজি দোকানের অল্পবয়স্ক একটা ছেলে সুরমা বেগমের কাছে একটা পিনআপ করা প্যাকেট দিয়ে গেল। সুরমা বেগম রিসিভ করে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য স্বামীর কাছে নিয়ে এল।
মোবারক সাহেব কোন উচ্ছাস দেখালেন না। বললেন, ‘প্যাকেটটা খোল। খুলে শার্টটা ধুয়ে দাও। না হলে পরা যাবে না।
সুরমা বেগম বিরক্ত কন্ঠে বললেন, ‘জিনিসটা দিয়ে গেছে। গায়ে দিয়ে দেখ। দেখ ফিট হলো কিনা। তা না আগেই ধুয়ে দাও। যত্তোসব।
‘ফিট হবে না কেন? মাপ দিয়ে বানানো।’ বলে বউয়ের রাগের আঁচ বুঝে বললেন, ‘দাও গায়ে দিয়ে দেখি।’
গায়ে দিয়ে তিনি আতকে উঠলেন, ‘একি?’
কিছু একটা সমস্যা হয়েছে বুঝতে পেরে সুরমা বেগমও আতকে উঠলেন, ‘কি হয়েছে? অন্যের শার্ট পাঠিয়ে দিয়েছে?
‘না না। শার্ট ঠিক আছে শুধু আমি ফুল হাতা দিতে বলেছিলাম। হাফ হাতা বানিয়ে পাঠিয়েছে। মুজরি তো ফুল হাতারই নিয়েছে।’
সুরমা বেগম ঝেঝে উঠলেন, ‘পাঠাবেই তো! মুচি খদ্দের পেয়েছে যে! দেখ, হয়তো তুমিই ভজঘট করে হাফ হাতারই মাফ দিয়ে এসেছো। দাম দিয়েছো ফুল হাতার। তোমারে বোকা পাঠা পেয়ে ঠকিয়েছে।
স্ত্রীর গঞ্জন্য সইতে না পেরে শাট খুলে বললেন, ‘তুমি শার্টটা ভাজে ভাজে ভাজ করে রাখ তো। দেখি আজ বিকালেই শালার দরজি ব্যাটাকে ধরব। আমার সাথে ভাওতাবাজি।
স্ত্রী ভাজ করে প্যাকেট ভরে দিয়ে বললেন, ‘তোমার মুরদ আমার জানা আছে।
বিকালে স্ত্রীকে নিয়ে মেয়ের বাসায় যাবেন। যাওয়ার সময় দরজি দোকানে শার্টটাও দিয়ে যাবেন। স্ত্রী ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে প্রসাধনী করতে করতে বললেন, ‘এ্যাই তুমি একটু কিচেনে যাও তো। চুলার উপর পানি ফুটাতে দিয়েছিলাম। ডেকচি একটু নামিয়ে রাখো।’
কমান্ড দেয়ার কিছুণ পর রান্নাঘর থেকে ‘উহু, আহা’ আর্তনাদ শুনে সুরমা বেগম প্রসাধনী ফেলে দৌড়ে কিচেনে আসেন। মোবারক সাহেব ফুটন্ত পানির ডেকচি নামাতে যেয়ে ফুটন্ত পানি দুই হাতের উপর ফেলে দিয়েছেন।
হাসপাতালে ডাক্তার দুই হাতের চিকিৎসা শেষে গাঢ় করে ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হাত ভাল না হওয়া পর্যন্ত আর কোন রকম ফুল হাতা শার্ট গায়ে দেয়া যাবে না। বাসায় হাফ হাতা শার্ট আছে তো? না থাকলে আজই একটা বানিয়ে ফেলেন।’
সত্যি বাসায় মোবারক সাহেবের কোন হাফ হাতা শার্ট ছিল না। শুধু দরজিবাড়ি থেকে আসা প্যাকেটের মধ্যের হাফ হাতা শার্টটা ছাড়া।
হাফ হাতা শার্টটা এভাবে কাজে লেগে যাবে কে জানত!
কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার জন্য সবাই একটা টুরের আয়োজন করেছে। ছেলে আর ছোটজামাই উদোক্তা। ফ্যামিলি ট্যুর। স্ত্রীর চাপাচাপিতে আলমারিতে থাকা প্যান্টের পিস বের করে দরজিবাড়িতে গেলেন। কারণ কাছে পিঠে পরিচিত আর দরজির দোকান ছিল না।
আজ ওই লোকটা ছিল না। শামছু নামের আরেকজন কারিগর। এর কাছে নিশ্চয় ওইটার অভিযোগ তোলা যায় না। আর অভিযোগও তো নয়। হাফ হাতা শার্ট বানিয়ে উপকারই করেছে দরজি।
মাপ দেয়া শেষ হলে সামছু মিয়াও একই কথা জানাল। ডেলিভারী তারাই দিয়ে আসবে। ফুল পেমেন্ট দিতে হবে।
এবারে ডেলিভারী তিনি নিজ হাতে গ্রহণ করলেন। ডেলিভারীর ছেলেটা চলে গেলে তিনি প্যাকেট খুলে হতভম্ব হয়ে গেলেন। একি! প্যান্ট তো মনে হয় পুরোপুরি বানানো হয়নি। ডানপাটা পুরোটা বানানো হলেও বামপায়ের হাটুর কাছ থেকে আর কিছু নেই। কাটা। যেন দেড়খান প্যান্ট বানিয়েছে। রাগ তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। ভাগ্যিস সুরমা আশেপাশে নেই। না হলে এরকম দেখলে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিত।
তিনি কাউকে কিছু না বলে প্যান্ট পাকেটে ঢুকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। আজ দরজিবাড়ির দরজির একদিন কি তার একদিন। এ কি ধরণের ফাজলামো।
তিনি দরজি বাড়ি পর্যন্ত পৌছাতে পারলেন না। রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের সাথে এক্সিডেন্ট করলেন। জ্ঞান হারালেন তিনি। সেই প্যাকেটটা তখনও তার হাতে ধরা।
জেগে উঠলেন হাসপাতালের বেডে। প্রচন্ড যন্ত্রণা নিয়ে। তার বেডের চারপাশে উৎকণ্ঠিত প্রিয়মুখ। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পরিজন। কিন্তু তিনি তাদের দেখলেন না। দেখলেন তার বামপায়ের হাটুর কাছ থেকে নেই হয়ে গেছে। এ্যাম্পুটেশন না কি করে কেটে বাদ দিয়েছে বাম পায়ের হাটুর নিচ থেকে।
তিনি আবার জ্ঞান হারালেন।
দরজিবাড়ির প্যান্ট এবারো ফেরত পাঠানো হলো না। ক্রাচে ভর দিয়ে হাটতে অভ্যস্ত হওয়ার পরে তিনি সেই দেড়খান প্যান্ট গলিয়ে দিনাতিপাত করতে থাকেন।
সেবারে কক্সবাজার যাওয়ার টুর বাতিল হয়ে গেল।
বছরখানেক পরের কথা। বিদেশ থাকা বড় মেয়ে নাতি নাতনী নিয়ে দেশে এসেছে। দেশ ঘুরে আবার চলে যাবে। বাবার জন্য অনেক কিছু এনেছে। ততদিনে মোবারক সাহেব পাঞ্জাবী পরতে অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। বড় মেয়ে বাবার জন্য খুব দামী সাদা ছিট কাপড় কিনে এনেছে।
‘বাবা এটা খুবই দামী কাপড়। পিওর জিনিস। একদম ফরেন জিনিস।
‘এটা দিয়ে কি করব?’
‘তোমার পাঞ্জাবীর জন্য এনেছি। মাপ জানিনা তো একারণেই ছিট এনেছি। আর ওই খ্রীষ্টান দেশে পাঞ্জাবী জিনিসটা ভাল পাওয়া যায় না। তুমি কোন একটা টেইলার্স থেকে মাপ দিয়ে বানিয়ে নিও।’
টেইলার্সের কথা শুনে তিনি চমকে উঠলেন। কিন্তু কাউকে কিছু বললেন না।
মেয়ের আবদারের কারণেই পরদিন তিনি দরজিবাড়ি গেলেন।
দরজি দোকানে সেই টাকমাথার ভুরু কামানো লোকটা আছে। ক্রাচে ভর দেয়া তাকে দেখে কাষ্ট হেসে বলল, ‘আপনার কাটা পায়ের জন্য দুঃখিত। কিন্তু এছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।’
তিনি দরজির কথা বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, ‘না মানে দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। আমি একটা পাঞ্জাবী বানানোর জন্য...বড় মেয়ে বিদেশ থেকে শখ করে এনেছে... খুব নামী দামী কাপড়। দেখবেন ফিনিশিংটা যাতে ভাল হয়।
‘ও কথা বলতে হবে না চাচা। এখনও আমার ডেলিভারীর কেউ কোন খুঁত বের করতে পারিনি। যেরকম চেয়েছে, যেরকম দরকার, হুবুহু সেরকমই ডেলিভারী দিয়েছি। আপনারটাও সময়মত ঠিক জিনিসই ডেলিভারী পাবেন।
কি বলবেন বুঝতে না পেরে মাথা ঝাকিয়ে বললেন, ‘ও আচ্ছা।’
বড়মেয়ে দেশ থেকে চলে যাবে। সবাই গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবে। ছেলে ও জামাই বন্ধুর কাছ থেকে একটা প্রাইভেট কার ও মাইক্রো জোগাড় করেছে। সবাই এয়ার পোর্টে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
তিনি মনে মনে আফসোস করছেন। এখন পাঞ্জাবীটা ডেলিভারী দেয়নি। এবারই প্রথম সপ্তাহ পার করেছে। কোনবার ডেলিভারীতে এত দেরী হয়নি। আজক্ওে যদি দিয়ে যেত তিনি মেয়ের সামনে পাঞ্জাবীটা পরে এয়ারপোর্টে যেতে পারতেন।’
গেট খুলে প্যাকেট হাতে ডেলিভারীর ছেলেটাকে দেখতে পেলেন। ছেলেটা এলে তিনি ইঙ্গিতে বারান্দার মোড়ার উপর প্যাকেটটা রেখে দিতে বললেন। রিসিভ কপিতে সই করলেন।
ছেলেটা চলে গেলে তিনি সুরমাকে ডাকলেন, ‘সুরমা, দেখ পাঞ্জাবীটা পাঠিয়েছে। তুমি খুলে ওটা আমাকে দাও তো।’
পা কাটার পর থেকে সুরমা বেগম অনেক নরোম হয়েছেন। আগে হয়তো খিচিয়ে উঠতেন, ‘তোমারও তো হাত ছয়রাত আছে।’ এখন বললেন, ‘তুমি একটু বস। আমি আসছি। আচ্ছা রেনুকে না হয় পাঠিয়ে দিচ্ছি। চলে যাচ্ছে, যাওয়ার আগে একটু বাপের খেদমত করুক।
রেনু এসে বলল, ‘যাক শেষ মুহুর্তে তোমার পাঞ্জাবীটা এলো বাবা। নাও তাড়াতাড়ি পরে নাও। বাচ্চু এলেই আমরা বেরিয়ে পড়ব।’ বলে সে আর
দেরী না করে প্যাকেট খুলে ফেলল।
তারপর সাদা পাঞ্জাবীটা খুলেই চিৎকার দিল ‘এটা কি বাবা? মা, ও মা দেখে যাও। মা!’
মা ছুটে এলেন, ‘কি হয়েছে রে? কি হয়েছে?’
রেনু কিছু না বলে সাদা কাপড়টা মায়ের দিকে এগিয়ে দিল।
মা কাপড়টা ধরে থরথর করে কাপতে কাপতে বললেন,‘এটা কে পাঠিয়েছে? কে?’
তিনি নির্বিকার মুখে স্ত্রীর কাছ থেকে সাদা কাপড়টা নিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, ‘দরজিবাড়ি থেকে পাঠিয়েছে। এটা কাফনের কাপড়। আমার কাফনের কাপড়। আগে ওরা হাফ হাতা জামা, দেড়খান প্যান্ট পাঠিয়েছিল। কাজে লেগেছে। এবার কাফনের কাপড় পাঠিয়েছে। ওরা কখনও ভুল করে না। আগেও করেনি। এবারও না। দাও দেখি মাপটা ঠিক হলো কিনা।
তিনি সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে কাফনের কাপড় পরতে শুরু করলেন...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





