চায়ের দেরী দেখে তিনি পত্রিকার খেলার পাতাটাতে আবার চোখ বুলাতে থাকেন। এই পঞ্চোশোর্ধ বয়সে এসেও খেলার খবর তাকে উত্তেজিত করে। যৌবনে তিনি তুখোড় ফুটবলার ছিলেন। গ্রামদেশ থেকে তাকে ‘হায়ার’ করে নিয়ে যেত। তিনি ব্যাকে খেলতেন। তার পা গলিয়ে প্রতিপরে গোল দেয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
পাশের রুম থেকে সাকিবের পড়া শোনা যাচ্ছে। তার অল্পবয়স্ক টিচার তাকে কোন একটা অংক বোঝাতে চেষ্টা করছে এবং সাকিবের ‘হ্যা, হু’ শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠা-নামা বা চৌবাচ্চার দুটি নলের ব্যাপার-স্যাপার তার ছেলের কানের পর্দায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে। মগজে ঢুকতে পারছে না।
স্কুলে থাকতে পাটিগণিতের এই ব্যাপার-স্যাপার তার নিজের মাথায়ও ঢুকত না। অংক তার কাছে পাথরের মতো লাগত। নিরেট এবং ভারী। মেট্টিক পরীার আগে ভাল একটা সাজেশান পেয়ে তিনি রচনার মত অংকও মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। সেই মুখস্থ অংক দিয়ে কোনমতে টেনেটুনে মেট্রিকটা পাশ করেন। অংকে পেয়েছিলেন একত্রিশ। দুই গ্রেস দিয়ে তাকে পাশ করিয়ে দেয়া হয়। ইন্টারে এসে আর্টস নিলেও আবার ইংরেজীর যাতাকলে পড়ে যান। ইংরেজী তার কাছে শীসার মত লাগার আগেই তিনি পড়াশুনা ছেড়ে দেন। ঐ সময়ে তার জীবন দর্শন ছিল- পড়াশুনা করতে হলে কোমর বেঁধে ভালমত কওে ফাটাফাটি রেজাল্ট করা উচিত। নয়তো ছেড়ে দিয়ে যে কাজে যাওয়া দরকার আগে থেকেই তাতে লেগে পড়াই ভাল। অযথা পড়াশুনার পিছনে মিছেমিছি সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। শুধু শুধু টেনেটুনে পাশের পিছনে শক্তি য় করে কি লাভ! এখন এই বয়সে এসে দেখছেন তার জীবনদর্শন খুব একটা ভুল ছিল না। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে বাপের ছোটখাট ব্যবসায় লেগে পড়ে আজ তার বাড়ি গাড়ি সব হয়েছে। গাড়ি বলতে মিরপুর-নিউমার্কেট লাইনের নয় নম্বর বাসের মালিকানায় তার শেয়ার আছে। ইচ্ছে করলে যখন তখন প্রাইভেট কার কিনতে পারেন। কিন্তু তার চারতলা বাড়িটা চিপা গলির ভেতরে হওয়ার কারনে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। চিপা গলিতে গাড়ি ঢোকে না। দুটো রিকশা ক্রস করতে গেলেই পুরো গলিতে খবর হয়ে যায়। পাড়ার ছেলেরা ট্রাফিক সেজে জ্যাম ছাড়ায়।
সাকিবের টিচার ছেলেটা, রকিবুল হাসান না আহসান কি যেন নাম, আবার সাকিবকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে। তিনি খেলার পাতা থেকে মুখ তুলে এদিকে মনোযোগী হন। দরজা আবজানো থাকলেও জানালা খোলা বলে কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
‘শোন সাকিব, তুমি অংককে যতটা ভয় পাচ্ছ অংক কিন্তু মোটেই ভয়ের কিছু নয়। একটু মনোযোগ দিলেই বুঝতে পারবে অংক জিনিসটা কত মজার ব্যাপার,কত আনন্দের ব্যাপার। আস ,আমরা কাসের অংক বাদ দিয়ে কিছু মজার অংক করি। এতে মজা পেলে দেখবে কাসের অংকগুলোও ভাল লাগতে শুরু করেছে।’
‘জ্বি স্যার। মজার অংক দেন স্যার। দেখবেন আমি কেমন পটাপট উত্তর দিয়ে দেই।’
‘আচ্ছা,বলো তো দেখি , এক হাত পরপর একটি করে নারকেল গাছ লাগালে পাঁচ হাতের মধ্যে কতটা গাছ লাগবে?’
‘এতো খুব ইজি স্যার। পাঁচটা।’
‘উহু,হলো না। ছয়টি। প্রথম এক হাতে দুটি মানে প্রথম হাতের দু’মাথায় দুটি। তারপর এক হাত অন্তর একটি করে। তাহলে দাঁড়ালো ছয়টি। আচ্ছা, এর চেয়ে সহজ দেখে আরেকটা দিচ্ছি।ভেবে চিন্তে উত্তর দেবে। একটা ডিম সেদ্ধ করতে পাঁচ মিনিট সময় লাগে পাঁচটা ডিম সেদ্ধ করতে কতণ সময় লাগবে?’
‘পাঁচ মিনিটে জীবনেও ডিম সেদ্ধ হবে না স্যার।ভেতরে কাঁচা থেকে যাবে।দশমিনিট করে দেন স্যার।’
‘তুমি বড্ড প্যাঁচাল পাড়।ঠিক আছে দশমিনিট ধরেই সেদ্ধ কর।’
‘স্যার পঞ্চাশ মিনিট লাগবে স্যার।এটা আরও ইজি।’
‘এগুলো আসলে ঠিক অংক না।মনোযোগ এবং ঘোরপ্যাঁচের ব্যাপার।একসাথে একটা ডিম সেদ্ধ করতে দশমিনিট লাগলে পাঁচটা ডিমও দশ মিনিটে সেদ্ধ হয়ে যাবে।’
‘স্যার, এটা কিন্তু চিটিং স্যার।আপনি কিন্তু একসাথে এ কথাটা বলেননি।না বললে আমি বুঝব কিভাবে?এটা ঠিক না স্যার। আপনি আরেকটা বলেন স্যার।এবারে আর ভুল হবে না।’
‘ঠিক আছে শোন।মনোযোগ দিয়ে শুনবে।কবুতর চেনো তো?’
‘চিনি না আবার!আমার ছোটমামার এই এত্তোগুলোন কবুতর আছে।বাড়ি মেহমান আসলে বড়মামা নানান অজুহাতে ওই গুলোন খাওয়ার চেষ্টা করে।বড়মামাটা মস্ত খাওয়নদার।খাওয়া ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।আপনি বলেন স্যার কবুতর কি খাওয়ার জিনিস?’
‘ অবশ্যই না।কবুতর পুষতে হয়।এখন অংকে আসÑধর দুটি ঘরে দুই ঝাঁক কবুতর আছে।প্রথম ঘরের একটি কবুতর দ্বিতীয় ঘরের কবুতর গুলোকে ডেকে বললো -তোমাদের দল থেকে একজন আমাদের দলে এসো,তাহলে আমরা তোমাদের ডাবল হব।দ্বিতীয় ঘরের কবুতরটি জবাবে বললো ‘তারচেয়ে তুমি আমাদের দলে এসো। আমরা তোমাদের সমান হই। এখন বলো দেখি কোন ঘরে কতটি কবুতর ছিল?
‘প্রথম ঘরে পাঁচটা দ্বিতীয় ঘরে চারটা।’
‘কিভাবে?’
‘স্যার চারটা থেকে একটা এসে পাঁচটার সাথে যোগ দিলে প্রথম ঘরে ছটা হবে যা দ্বিতীয় ঘরের তিনটার ডাবল।আবার ..আবার .না হলো না।
‘প্রায় হয়েছিল।তুমি পাঁচটা আর চারটা না দিয়ে সাতটা আর পাঁচটা দিলেই হয়ে যেতো।’
সাখাওয়াত সাহেবের স্ত্রী রেহনুমা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এলেন।সাথে বড় জামবাটিতে সবজি জাতীয় কোন একটা খাবারের নতুন আইটেম।নিশ্চয় টিভি দেখে বানানো।টিভির রান্নার শোতে মোটা মোটা মহিলাদের (যাদের দেখলেই তার মনে হয় সৃষ্টিকর্তা দুটো মহিলা বানাতে যেয়ে ভুল করে একটা মহিলা বানিয়ে ফেলেছেন।একবার একটা ছবি দেখেছিলেন ‘এ থিং উইথ টু হেড’ এই মহিলাদের দেখলে তার মনে হয় ‘টু উওম্যান উইথ ওয়ান হেড’।)দেওয়া কোন একটা রেসিপি দেখে বানানো।এতদিন তিনি একা একা এসব খাবার উপভোগ(!) করতেন।মাঝে মধ্যে অবশ্য মেয়ে জামাইরা এলে তারাও ভাগীদার হতো। এখন বোধ হয় টিচার ছেলেটাকে এই যন্ত্রনা সহ্য করতে হচ্ছে। বেচারার জন্য তার বেশ মায়া লাগল।অসাধারন একটা ছেলে।এই জাতীয় ছেলে সচরাচর দেখা যায় না।বুয়েটে পড়ে, ডাবল স্ট্যান্ড।ধের্য আছে বলতে হবে।অসীম ধের্য় নিয়ে সে সাকিবকে পড়ায়।অংক ইংলিশ বোঝানোর চেষ্টা করে। সাকিব কিছুই বোঝে না।ছেলেটা পরের দিন আবার এসে লেগে পড়ে।যেন সে পণ করেছে ওকে বুঝিয়েই ছাড়বে। তার ছাত্র যে কিছু বুঝছে না তা কি এই বোকা ছেলেটার মাথায় ঢোকে না। ছেলেটা যখন সাকিবকে পড়ায় তখন তার খুব মায়া লাগে। শুকনোমত ছেলেটার মধ্যে কোন ভান নেই।আগে যেকজন ছিল সব গুলোই ছিল চাপাবাজ। এই ছেলেটা সহজ সরল।চাপাবাজি বোঝে না। মাঝে মধ্যে তার মনে হয় মেয়ে দুটোর বিয়ে না হয়ে গেলে এই ছেলেটার সাথে কাউকে দিয়ে দিতে পারতেন।জামাই দুটো তার পছন্দ না।দুজনেই চামার টাইপের।বিয়ের আগে বোঝা যায়নি।দুজনেই বিভিন্ন সোর্স থেকে তার সম্পত্তির খোঁজ খবর করে।আড়ে আবডালে লোকের কাছে তাকে কিপটে বলে বেড়ায়।দুজনই একই স্বভাবের।আপন মায়ের পেটের ভাইদের মধ্যেও এমন মিল দেখা যায় না।
মাঝে মধ্যে টিচার ছেলেটার সামনে পড়লে তাকে কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করতেই হয়।না করলে খারাপ দেখায়।তিনি বলেন ‘তোমার ছাত্র পড়াশোনা কেমন করছে?’
শুকনো ছেলেটা মোটা গলায় বলে ‘ভাল না।ম্যাথ ইংলিশ কিছুই বোঝে না।কিছুই ওর মাথায় ঢোকে না।আজ করিয়ে দিলে কাল ভুলে যায়।’ শুকনো মানুষের কন্ঠস্বর বোধ হয় মোটাই হয়।
‘পাস করবে তো?’
‘দেখি।আমি তো চেষ্টা করছি।খেলাধুলোর প্রতি ঝোঁক বেশি তো।ওইটা মন থেকে তাড়াতে পারলে বোধ হয় পড়াশুনায় মন বসত।’
রেহেনুমা সাখাওয়াত সাহেবের নাস্তা দিয়ে সাকিবের রুমে নাস্তা নিয়ে ঢোকেন।নাস্তা দেয়ার সাথে সাথে পড়ানো বন্ধ হয়ে যায়।নাস্তার সময় সাকিব গল্পের ছালা মেলে দেয়।গল্প বলতে সবই ক্রিকেট সমন্ধে।তার নতুন কেনা ব্যাট বের করে দেখায়।বিভিন্ন ম্যাচের খবরাখবর দেয়।এ সময় সাকিব তার স্যারের সাথে ‘কিভাবে রিভার্স সুইপ খেলতে হয় ,কিভাবে রুম করে নিয়ে স্টোক করতে হয়,গতকালের ম্যাচে সে কয়টি ছক্কা পিটিয়েছে এসব আলোচনা প্রানবন্ত ভাবে করতে থাকে।স্যার শুধু সায় দিয়ে যায়।
সাকিবের খেলার উচ্ছল আলোচনা ও বিভিন্ন ম্যাচ জিতে আসার খবর শুনলে তার মনে হয় ছেলেটাকে স্কুলে না পাঠিয়ে কোন একটা ক্রিকেট কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দিলে বোধ হয় ভাল হতো।হয়তো বড় কোন ক্রিকেটার হতে পারতো।খেলা যে ওর রক্তে মিশে আছে।
ওরকম ভাবলেও সেটা যে বাস্তবায়িত হবে না তা তিনি ভাল করেই জানেন।তার বাবা যেমন তিনি ফুটবলার হন তা কখনও চাননি তেমনি তিনিও চাইবেন না লেখাপড়া বাদ দিয়ে ছেলে ক্রিকেট খেলায় মেতে থাকুক।রেহেনুমার আপত্তির কথা তো বাদই দিলেন।
ওরকম একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে নিশ্চয় তিনি তার ছেলেকে ছেড়ে দিতে পারেন না।যদি খেলাধুলা করতে গিয়ে তার ভবিষ্যৎ জীবনটা নষ্ট হয়ে যায়।
অনিশ্চয়তার এই জগতে তিনি বড়ই অসহায় বোধ করতে থাকেন
আগামী পর্বে দেখুন...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





