মহীউদ্দীন সাহেবের জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে।
যার জন্য কবর খোঁড়া হয় তাকে সাহেব বলা যায় কিনা তা গবেষণার বিষয়। তাকে লাশ বলে ডাকাই যুক্তিসংগত। তবে মহীউদ্দীন সাহেবকে লাশ বলা যাচ্ছে না কারণ তিনি এখনও পুরোপুরি মারা যাননি।
মহীউদ্দীন সাহেবের নিশ্বাস ও হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডাক্তাররা তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘কিনিক্যালি ডেড’ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন। নানা বৈজ্ঞানিক আনুষঙ্গিক প্রযুক্তি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। ডাক্তাররা ডিফাইব্রিলেটরস দিয়ে চালু রেখেছেন তার হৃদযন্ত্র।নকল দাঁতের পাটি খুলে সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছেন ব্রিদিং টিউব।
চিকিৎসা শাস্ত্রের যতগুলো গোলমেলে দিক আছে তার মধ্যে ‘কিনিক্যাল ডেথ’ একটি। ডাক্তারদের মৃত ঘোষণাকৃত রোগীও অনেক েেত্র বেঁচে যায় এবং দিব্যি ঘরসংসার করে।
তবে মহীউদ্দীন সাহেবের নিকট আত্মীয় পরিজনেরা তার কিনিক্যাল ডেথ থেকে বেঁচে ওঠার সম্ভবনা শুধু ছেড়েই দেননি তার জন্য কবর খোঁড়ার তোড়জোড়ও করছেন।বৃদ্ধ মানুষকে যত তাড়াতাড়ি কবরে পাঠানো যায় ততই মঙ্গল। বৃদ্ধদের বেশিদিন বেঁচে থাকার অর্থই হচ্ছে মরণকে অস্বীকার করা। কিন্তু কবরের খাঁদ কেউই এড়াতে পারেনা।
পারিবারিক গোরস্তানে মহীউদ্দীন সাহেবের স্ত্রীর কবরের পাশে কবর খোঁড়া হতে থাকে। বাড়ির বড়জামাই যিনি সব কিছু দ্রুততার সাথে করতে ভালবাসেন, তার নির্দেশেই কবর খোঁড়া হতে থাকে যেন লাশ আসার সাথে সাথেই কবর দিয়ে দেয়া যায়, যাতে লাশের আজাব কম হয় ;লাশ যত বেশী সময় ধরে মাটির উপরে থাকে ততই নাকি লাশের আজাব হতে থাকে!
বাড়ির বড়ছেলে মাহবুব হোসেন এখনও বাড়িতে এসে পৌছাননি। মাহবুব চট্রগামে চাকরিরত।মুলত তার উপার্জিত টাকার একটা বড় অংশ দ্বারা তার পিতার সংসার চলে।
প্রাক্তন চাটার্ড একাউটেন্ট মহীউদ্দীন সাহেবের পেনশনের টাকা তার নিজের চিকিৎসা খাতেই সিংহভাগ ব্যয় হয়ে গেছে। তাছাড়া পৈত্রিক সম্পত্তির উপর পাকা দোতলা বাড়ি দিতে গিয়েই চাকরি জীবনে অর্জিত অর্থ ব্যয়িত হয়েছে।ভাল পাত্র দেখে দু’মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ,ছেলেদের স্ব স্ব েেত্র প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বড় ছেলে বড় চাকুরিজীবী ,মেজোটার অবশ্য পড়াশুনার দিকে বেশি ঝোঁক ছিল না ;চাকরি করে নাকি তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়া যায় না তাই সে ব্যবসায় নেমে পড়ল তিনিও ছেলেকে ব্যবসায়ী হতে সাহায্য করলেন। মেজো ছেলে এখন দু’দুটো গার্মেন্টেসের দোকান,একটি স’মিল এবং রাজশাহী-নওগা রুটের তিনটি বাসের অংশীদার। ছোট ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স পড়ে।
বড়ছেলে মাহবুব হোসেন আগের সপ্তাহে পিতার অসুস্থতাজনিত ছুটি নিয়েছিলেন বলে এবার আর ছুটি নেননি। তবে বউ এবং ছেলে মেয়েকে রেখে এসেছেন পিতার পাশে এবং ভাল-মন্দ কিছু হয়ে গেলে তাকে জানানো হলে তিনি সাথে সাথে চলে আসবেন এরকম তথ্য জানিয়ে চলে গেছেন চাকরিতে। তাছাড়া তার পিতা এত দীর্ঘকাল যাবৎ শয্যাশায়ী যে পিতার পাশে পাশে থাকতে গেলে তার চাকরি তিগ্রস্থ হবে। তিনি তো তার কাজ করছেনই! বাংক থেকে লোনে টাকা তুলে পিতার চিকিৎসা করাচ্ছেন।
ফোনে বড় দুলাভায়ের কাছে বাবার কিনিক্যালি ডেথের খবর শুনেই মাহবুব হোসেন রওনা দিয়েছেন। অফিস থেকে সাথে সাথে ড্রাইভার সহ অফিসের প্রাইভেট কার দিয়ে তাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে পিতার সৎকার করে আসা পর্যন্ত।
গাড়িতে বসে ছোট দুলাভাইয়ের কাছে মোবাইল করে যখন তিনি জেনেছেন যে বড় দুলাভাই কারো কথাকে গ্রাহ্য না করে বাবার জন্য কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করেছেন তখনই তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে আজ বাড়িতে যেয়ে বড় দুলাভাইকে তাদের কোন ব্যাপারে নাক না গলানোর জন্য কঠোর ভাবে নিষেধ করে দেবেন।
কি ভয়ংকর! একজন মারা যাওয়ার আগেই তার জন্য কবর খুঁড়ে রাখা হচ্ছে!
মহীউদ্দীন সাহেব এক ধরনের ঘোরের মধ্যে আছেন। তিনি জীবত না মৃত তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি এই যে ‘জীবিত না মৃত’ এটাই চিন্তা করতে পারছেন সেজন্য তিনি ধরেই নিয়েছেন তিনি জীবিত। মৃতের চিন্তা করার মতা থাকে না। অথচ তিনি বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারছেন যে তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না ,হাঁপরের মত ওঠানামা করছে না তার বুক ;হৃদপিন্ডের ধুকপুকানিও শুনতে পাচ্ছেন না তিনি ;এজন্য এটাকে তিনি ঠিক বেঁচে থাকা বলেও মেনে নিতে পারছেন না।
চিন্তা করার মতা যখন টিকেই আছে তখন এটা ব্যবহার করতে তিনি কার্পন্য করবেন না বলে ঠিক করেছেন। কখন এ শক্তিটুকুও ফুরিয়ে যায় কে জানে! তিনি প্রাণাধিক প্রিয় স্ত্রীর কথা স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। স্ত্রীর লম্বাটে মুখের আবছা অবয়ব চোখের সামনে ভাসলেও পুরো মুখটা মনে করতে পারলেন না। ছয় বছর আগে কবরের মাটি মুড়ি দেয়া আমিনাকে তিনি কিছুতেই ধরতে পারলেন না। স্ত্রীরা নাকি চায় যে স্বামীর আগে তাদের মরণ হোক ! সেটাই সুখের মরণ! সেই হিসাবে আমিনাকে সৌভাগ্যবতীই বলতে হবে!
আমিনার মুখ মনে করতে যেয়েই মাহবুবের বলিষ্ঠ অবয়বটা গোচরে আসে। সব পিতাই বোধ হয় বড়ছেলের উপর সবচেয়ে বেশী নির্ভর করে ; সবচেয়ে বেশী ভালও বাসে বোধ হয়। মায়েদের টান অবশ্য ছোটছেলের উপর বেশী বর্তায়।
একে একে তিনি অন্যান্য ছেলেমেয়ে তাদের পরিজন ,নাতি-নাতনী সবাইকে দেখতে পেলেন। তার চোখের সামনে জীবতরা ছবির মত ভেসে বেড়াতে লাগল। তার মৃত স্ত্রী,মৃত ভাই বোনেরা,অন্যান্য মৃত আত্মীয়পরিজন কাউকে তিনি দেখতে পেলেন না। কাচের দেয়ালের মধ্যে মুখোশ পরা ডাক্তারদের মাঝে তিনি কোথাও আজরাইলের ছায়াটি পর্যন্ত দেখতে পেলেন না। তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে জোরে শ্বাস টানলেন।
ডাক্তারদের বিষ্ময়বোধের অন্ত রইল না। কিনিক্যালি ডেথ সার্টিফিকেট দেয়ার পরে রোগী বেচেঁ যায় এতদিন তারা শুধুই শুনে এসেছেন ;আজ সচে দেখলেন। তাদের কিনিকে এই অঘটন ঘটে গেল। বৃদ্ধ হার্টের রোগী শুধু বেঁচে আছেন তাই না ;সর্ম্পূ সুস্থ আছেন। এমনকি চাইলে আজই কিনিক থেকে রোগী রিলিজ করে নিয়ে যেতে পারে।
কিনিকের চত্বরে মহীউদ্দীনের সন্তানেরা, আত্মীয়পরিজনেরা আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরল। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার মত বিরল ঘটনায় তারা সবাই অভিভুত। সব বিরল ঘটনা তাদের পিতার েেত্রই ঘটে।
আনন্দের মধ্যেই হঠাৎ করে কার জানি খেয়াল হয় এত বড় ঘটনাটা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া বড় ভাইকে এখনো জানানো হয়নি। সাথে সাথে ছোট দুলাভাই মোবাইলে বড় ভাইকে রিং দেয়।
রিং ঢোকে না ;‘গাড়ির মধ্যে নেটওয়ার্ক নেই বা ভাইজান মোবাইল অফ করে রেখেছেন ’এই জাতীয় মন্তব্য করে সে মোবাইল রেখে দিয়ে সবার সাথে কবর সংক্রান্ত আলোচনায় যোগ দেয়।
বড় দুলাভাই আগে থেকে কবর খোঁড়ার মত বোকামী করার জন্য লজ্জিত হয় এবং এখনই বাড়িতে যেয়ে কবর সংক্রান্ত সব আয়োজন বন্ধ করতে হবে জানায়।
বড় ভাইয়ের মোবাইল থেকে কল আসে। কল রিসিভ করে ছোট দুলাভাই স্তব্দ হয়ে যায়।
বড় ভাইয়ের প্রাইভেট কারের সাথে ট্রাকের সংঘর্ষ হয়েছে।
প্রাইভেট কারের ড্রাইভার এবং আরোহী দুজনেই স্পট ডেড।
ট্রাক ড্রাইভার পলাতক। ট্রাক আটক।
লাশ স্থানীয় হাসপাতালে। পুলিশের তত্বাবধানে।
লাশ আনতে যেতে হবে।
পিতার জন্য খোঁড়া কবরে পুত্রকে সমাহিত করতে হবে। কবর খুড়লে তার মধ্যে কাউকে না কাউকে যেতেই হয়। কবর ডাকে।
মহীউদ্দীন সাহেব আরো ছ‘বছর বেঁচে ছিলেন বড় ছেলের কবর বুকের মধ্যে নিয়ে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





