কাটাতারে ঝুলছে বাংলাদেশ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
কাটাতারে ঝুলছে ফেলানির লাশ। শুক্রবার ভোর সোয়া ছয়টার দিকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও আধাঘন্টা ধরে পানি পানি বলে চিৎকার করতে থাকে ফেলানি। এরপর সকাল পৌনে সাতটার দিকে আর কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। কারণ এরপর বেঁচে ছিলো না সে। (বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কম) এভাবে মারা গেছে ফেলানি। সন্ধ্যায় বিয়ের আয়োজন ছিলো। নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে মেহেদি রাঙা হাত নিয়ে শ্বশুড় বাড়ি যাওয়ার কথা ছিলো ফেলানির। শ্রমিক পিতা জীবিকার সন্ধানে দালালদের মাধ্যমে শক্তিমান বন্ধু দেশের দালান কোঠা নির্মাণের জন্য ইট ভাটায় কাজের জন্য গিয়েছিলো কাটাতারের ওপারের দেশে। সাথে গিয়েছিলো ফেলানি তার মা আর ভাই। কষ্ট করে কিছু টাকাও জমা করেছিলেন পিতা ফেলানির বিয়ের খরচের জন্য। ফেলানির বাবা কাটাতার ডিঙ্গাতে পেরেছেন। কিন্তু ফেলানি পারেনি। কাটাতারের আটকে গেছে জামা। চিৎকার করছেন কাটাতারের বেড়া ডিঙ্গানোর জন্য। এমন নিশানা কী বিএসএফ মিস করে! ১৪ বছরের কিশোরির বুকে গুলি চালিয়েছে। আহা পাখি মারার চেয়েও কাজটি কত সহজ। এরপর চার ঘন্টা লাশটি ঝুলে ছিলো কাটাতারের বেড়ায়। পৌনে এগারটার দিকে লাশটি নামায় বিএসএফ। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি অনন্তপুর বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা ১৪ বছর বয়সী কিশোরীকে গুলি করে হত্যার ৩০ ঘন্টা পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের কাছ লাশ ফেরত দেয়। শনিবারের নয়াদিগন্তের ছবিতে দেখা যাচ্ছে লাল পায়জামা পড়া ফেলানির ছোট্র শরীরটা ঝুলছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাটাতারের বেড়ায়। যেনো একখন্ড বাংলাদেশ ঝুলে আছে। কেন ফেলানিকে হত্যা করা হলো?
বিদ্বেষ আর ঘৃনা। কারণ ফেলানির একটি দেশ আছে। একটি মানচিত্র আছে। কেন ফেলানিরা বলে কাটাতারের ওপারে বাংলাদেশ আমার দেশ। বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি অপরিসীম ঘৃনার মনস্তত্ব থেকে গুলির নিশানা হচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিকরা। ফেলানিকে সহজেই বিএসএফ ধরে ফেলতে পারতো। নিতে পারতো আইনগত ব্যবস্থা। কিন্তু তা তারা করেনি। কারণ ফেলানি বাংলাদেশের নাগরিক। হত্যায় ওর উপযুক্ত শাস্তি।
কিন্তু হায় ফেলানি জানেনা, এদেশ আর তার নেই। এই ভূ’খন্ড এখন পরাধীন হয়ে গেছে। বন্ধু দেশের দেনা শোধ করতে সবাই ব্যস্ত। ফেলানির হত্যায় কী বা আসে যায়। মহান বন্ধু রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হাসোজ্বল সেসব ছবি কি কখনো দেখেছিলো কখনো ফেলানি? বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় করার আয়োজন চলছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন যেকোন সময়ের চেয়ে ভালো। বন্ধুত্বের জন্য সবাই এখন গুলির নিশানা। পুরো বাংলাদেশ এখন ঝুলছে কাটাতারের বেড়ায়।
ফেলানি হত্যার পর আমরা সরকারের কারো পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাইনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো উদ্বেগ বা নিন্দা জানানো হয়নি। কারণ “বন্ধু” রাষ্ট্র মনোক্ষুন্ন হবে এমন কোনো কাজ তারা করবে না। কারণ একজন ফেলানির লাশের চেয়ে এই বন্ধুত্বের গুরুত্ব অনেক বেশি। বন্ধু রাষ্ট্রের জন্য সড়ক, বন্দর, আর চড়া সূদে ঋণ নিয়ে যেখানে বন্ধু রাষ্ট্রকে খুশী রাখা যাচ্ছে না সেখানে ফেলানির প্রসঙ্গ তুলে অযথা বিরক্তি উৎপাদন করতে চায় না এ সরকার।
ফেলানির ছবি যখন দেখছি মনে পড়ল পারুলের কথা। গত বছরের মে মাসে পারুলকে নিয়ে লিখেছিলাম। আমাদের বন্ধু দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ছোড়া গুলিতে ১৩ বছরের কিশোরী পারুল মারা যায় গত বছরের ১৪মে। বাংলাদেশ সীমান্তের এক কিলোমিটার ভেতরে পটল ক্ষেতে গরুর ঘাষ তোলার সময় তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বিএসএফ। এ সময় বিএসএফের গুলিতে মজিবর রহমান নামে এক কৃষকও মারা যায়। ঠাকুর গাওয়ে রত্নাই সীমান্তে নাগর নদীতে পানি নেই, চর পড়েছে। নদীর ওপারে ভারতের কাটাতারের বেড়া দেয়া সীমান্ত। নদীর পাড়ে দুপুরে গরুকে ঘাষ খাওয়াতে গেছেন কৃষক মজিবর। এ সময় বিএসএফ কাটাতারের বেড়া পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। মজিবরের দিকে বন্দুক তাক করে তাড়া করে। দৌঁড়াতে থাকে মজিবর। বিএসএফও পেছন পেছন আসতে থাকে এবং মজিবরকে গুলি করে। কিছু দূরে পটল ক্ষেত থেকে এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে পারুল। পারুলের চিৎকার শুনে বিএসএফ পারুলের কাছে ছুটে যায়। তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। ঘটনাস্থলে পড়ে যায় পারুল। এ সময় বিএসএফ এলোপাথাড়ি ভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। তাদের গুলিতে সাইফুল ইসলাম ও খালেদা খাতুন নামে আরো দুজন গুলিবিদ্ধ হয়। মজিবরের লাশ টেনে হিচড়ে ভারতের সীমান্তের ভেতরে নিয়ে যায় বিএসএফ। বিএসএফ গুলি করে চলে যাওয়ার সময় মজিবরের লাশ টেনে হেচড়ে ভারতে নিয়ে যায়। বিএসএফ চলে যাওয়ার পর সেখানে গ্রামের মানুষ চলে আসে। পারুলকে হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে ঘাতকের বুলেটে পারুলের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। অপর গুলিবিদ্ধ দুজনকে সদর হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হয়। মজিবর ঘটনাস্থলে মারা গেলেও বিএসএফ তার লাশ ফেরত দেয় একদিন পর।
এভাবে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে পারুল আর ফেলানিরা। কিন্তু খুব কম সময়ই এরা খবর হন। পারুল আর ফেলানিদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহেই হত্যা করা হয়েছে ৬ জন বাংলাদেশীকে। একটি দেশের সাথে আরেকটি দেশের অসংখ্য সীমান্ত রয়েছে। ভারতের সাথে শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের সীমান্ত আছে। কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর সাথে নিয়মিত গোলা বিনিময় হয় কিন্তু এভাবে নিরীহ মানুষ নিহত হয় না। আজকে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ যেনো ভারতের প্রধান শত্রু। তাহলে কী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র আর তার নাগরিকদের মেনে নিতে চাইছে না ভারত? উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে এমন ঘটনা খুবই বিরল অথচ এই মুহুর্তেও দেশ দুটি যুদ্ধ প্রস্তুতি রয়েছে।
কানাডা- আমেরিকার বর্ডারের কথা নাই বা বললাম আমেরিকা - মেক্সিকো বর্ডারে এমন হত্যাকান্ড ঘটেনা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিএসএফকে বলেছে ট্রিগ্যার হ্যাপি বাহিনী। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটির পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে এ ধরনের বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড বন্ধ এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বার বার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু ভারত সরকার এখন পর্যন্ত কোনো বিএসএফ সদস্যর বিচার করেনি। কারণ এই খুনে বাহিনীকে সম্ভবত রাজনৈতিক ভাবে হত্যাকান্ডের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ফেলানি আর পারুলদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা যে বিডিআরের সেই বিডিআর আর নেই। তার নামটিও বদলে গেছে এখন তারা শুধুই গার্ড বা পাহারাদার। চোখের সামনে সিলেট সীমান্তে জমি দখল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছুই তাদের করার নেই। এ অবস্থায় সীমান্ত এখন পারুল আর ফেলানিদের ঘাতকদের হাতে। তারা ভেতরে এসে এ দেশের নাগরিকদের হত্যা করে। আমাদের বিবেক নাড়া দেয়না। আমাদের বিবেক পরাধীন হয়ে গেছে। গণমাধ্যমে হৈচৈ তোলা বুদ্ধিজীবীদের আত্মা বিক্রি হয়ে গেছে। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। কোথায় আজ মানবাধিকার জীবিরা?
এভাবে নির্বিচারে হত্যার ঘটনা শুধু তুলনা করা যায় ফিলিস্তিন - ইসরাইল সীমান্তের সাথে। এভাবে ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যা করে। ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনিদের কাটাতারের বেড়ায় আটকে রেখেছে ঠিক একই কায়দায় এ দেশের মানুষকেও কাটাতারের বেড়ায় আটকে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশকেও ফিলিস্তিনের মতো রাষ্ট্রীয় কাঠামো বিহীন একটি ভূ’খন্ডে পরিণত করার চেষ্টা চলছে।
বছর হত্যা আহত অপহরণ পুশইন
২০০৭ ১২০ ৮২ ৯৮ ১৯৮
২০০৮ ৬২ ৪৭ ৮১ ২০
২০০৯ ৯৮ ৭৭ ২৫ ১১
২০১০ ৭৪ ৭২ ৪৩
সূত্র : অধিকার
কৃতজ্ঞতা: আলফাজ আনাম
Click This Link
২২টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমিও যাবো একটু দূরে !!!!
আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন
যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে
প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের দাদার দাদা।
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।
আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?
আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন