সময়টা ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখ। বন্ধু বসিরের গাড়িতে করে আমরা ৩ ফেমেলি যাবো সিলেট ট্যুরে। গাড়িতে আমরা ভোরে বাড্ডা থেকে রওনা হয়ে প্রথমে যাবো লাউয়াছড়ার বনে। সেখান থেকে মাধবপুর লেক। সেখান থেকে মাধবকুন্ড ঝর্ণা দেখে হাওরের পথ ধরে চলে যাবো সিলেট। প্লান মাফিকই সব হচ্ছিলো। দ্রষ্টব্য স্থানগুলি একে একে দেখে যখন সিলেটের পথে ছুটে চলেছি তখন অলরেডি দিনের আলো শেষ হয়ে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে।
আমাদের ড্রাইভারের বয়স ছিলো কম। রাত হওয়ার পর থেকেই সে বার বার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। বারবার ধমক দিয়ে গতি কমাতে হচ্ছিলো। হাওরের মাঝ দিয়ে চলে গেছে পথ (আসলেই হাওর কিনা আমার সঠিক জানা নেই)। দু্ই ধারে কোনো জনবসতি বা লোকালয় নেই। যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে কোনো আলোর চিহ্ন চোখে পরছে না। অন্ধকার যেনো চারপাশ থেকে চাদরে জড়িয়ে নিতে চাইছে আমাদের। পথে গাড়ির সংখ্যাও অতি নগণ্য। সাথে বিবি-বাচ্চারা থাকার কারণে বেশ একটা ভয়ের মধ্যেই আছি।
অন্ধকার চিরে আমাদের গাড়ি যখন ছুটে চলছে ঠিক তখন হঠাত করেই চলন্ত গাড়ির ইঞ্জির বন্ধ হয়ে গেলো। এইভাবে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে সম্ভবতো গাড়ির ইস্টেয়ারিং লক হয়ে যায় হয়দো। বিষয়টি সম্পর্কে আমার কোনা ধারনা নেই বলে পরিষ্কার বুঝতে পারছিনা। বেশ বিপদজনক অবস্থা। নির্জন অন্ধকার পথে আমরা বেশ একটা বাজে পরিস্থিতিতে পরে গেলাম। বিবি-বাচ্চারা ভয় পাচ্ছে অন্ধকার আর নির্জনতাকে। গাড়ি থেকে আমরা ছেলেরা নেমে ইঞ্জিনে কিছুক্ষণ গুতাগুতি কারার পরেই আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমরা সকলে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। অল্পবয়সী ড্রাইভার আবার বেশ গতি তুলছে গাড়িতে। আমি সামনে বসে বারবার বলে বলে ওকে গাতি কমাতে বাধ্য করছি। এরই মধ্যে আবারও আগের মতোই ধুম করে চলন্ত গাড়ির ইঞ্জির বন্ধ হয়ে গেলো। অন্ধকারের আড়ালে ভয় যেনো চারপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছিলো আমাদের ছোট্ট দলছুট নিশ্চল গাড়িতে। আবার গাড়ি থেকে নেমে ইঞ্জিনে কিছুক্ষণ গুতাগুতি করতেই চালু হয়ে গেলো।
কিন্তু হায়!! কিছু দূর যেতেই আবার সেই একই অবস্থা!! এভাবে বেশ কয়েকবার হওয়ার পরে আমরা একটা সময়ে নির্জন পথ পেরিয়ে এসে ছাড়া ছাড়া কিছু দোকান পাটের দেখা পেলাম। এরমধ্যে একটি ছোট মতো গ্যারেজ দেখে সেখানে গাড়ি থামালাম। একজন মিস্ত্রী ছিলো সেখানে। সে আমাদের কাছে সমস্যার বিবরন শুনেই বলে দিলো গাড়ির সিএনজির যে কিট আছে সেটি গাড়ি চালু অবস্থায় বাসাত লেগে কোনো কারণে ঠান্ডা হয়ে ইঞ্চিন বন্ধ করে দিচ্ছে। গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলেই কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে সেটির ঠান্ডা কেটে নর্মাল হয়ে গেলেই আবার ইঞ্চিন চালু হচ্ছে। সমস্যা অতি সামান্য, সমাধানও সাহজ। কিটটিকে গরম পানিতে গোসল করাতে হবে। গ্যারেজে গরম পানি পাওয়া গেলো না। মিস্ত্রীকে কিছু টাকা দিতে চাইলেও কি কিছুই নিলো না। কোনো কাজ করেনি তাই টাকা নিবে না।
আশপাশে কোনো দোকান না থাকায় আমরা উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। ততোক্ষণে বেশ রাত হয়ে গেছে। দোকানপাট বেশীর ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা খুঁজছি চায়ের দোকান। সেখানেই গরম পানি পাওয়া যাবে। একটি চায়ের দোকান পেয়েও গেলাম। টিনের ছোট্ট একটি টং ঘরের মতো দোকান। কোনো খদ্দের নেই। আমরা গাড়ি থামিয়ে সকলে নামলাম। কিছুটা গরম পানি চাইলাম। দোকানী চাচা মিয়া জানালেন দোকান বন্ধের সময় হয়ে গেছে তাই তিনি চুলায় আর কোনো গরম পানি করেন নি। চুলার উপরে একটি কেতলি আছে দেখে জানতে চাইলাম চা আছে কিনা। চাচা মিয়া জানালেন চা আছে। আমরা বেশ কয়েক কাপ ধুঁয়া উঠা গরম লিকার চা নিয়ে ধীরে ধীরে সেই কিটটিতে ঢালতে লাগলাম। চাচা মিয়া অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
চায়ের দাম দিতে গেলে চাচা মিয়া আর চায়ের দাম নিবেন না। এদিকে আমরা তার কেতলির সব চা শেষ করে দিয়েছি কিটের উপরে ঢেলে। চাচা মিয়ার কথা হচ্ছে আমরাতো চা খাই নাই, তাই চায়ের দাম উনি নিবেন না। আমরা বেশ অবাক হলাম। এই চা বিক্রি করে, এই রকম একটা দোকানে কয় টাকাইবা লাভ হয়!! সেইখানে বসে তিনি কিভাবে এক কেতলি চায়ের দাম নিতে চাইছেন না!! বিপদে পরা মানুষকে নিস্বার্থ ভাবে এখনো কিছু মানুষ উপকার করতে এগিয়ে আসে, সাহায্য করে তৃপ্তি পায়। মানুষত্ব এখনো শেষ হয়ে যায় নি। কয়েকবার বলার পরেও চাচা মিয়া টাকাটা কিছুতেই নিতে রাজি না হওয়াতে আমরা উনার দোকানে থাকা (প্রায় খাওয়ার অযোগ্য) লোকাল কিছু বিস্কুট, চানাচুর, চিপ্স কিনে নিয়ে তার দাম চুকিয়ে দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে আমাদের গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম এবং আর কোনো ঝামেলা ছাড়াই পৌছে গেলাম।
বি.দ্র. : ছবিটি সফর শেষে ফেরার দিন তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০২৩ বিকাল ৪:২৪