তখন বেলা দ্বিপ্রহর। অর্ধ দিবস কর্মের সুবাদে লোকটা সবেমাত্র রাজপথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, আষাঢ়ে সূর্য আনাবশ্যক ভাবে তাপ বিকিরন করিয়া প্রস্তর নির্মিত শহরটিকে অযথাই উত্তপ্ত করিয়া তুলিয়াছে।কাঠফাটা রোদে রাজপথে পা রাখাই কষ্টকর হইয়া গিয়াছে। সড়কের পিচগুলো যেন তরলিত হইবার প্রমাদ গুনিতেছে।অদ্ভুত রোদ যানবাহনের কাঁচে প্রতিফলিত হইয়া চোখ ঝলসাইয়া দিতেছে।
লো্কটা কিঞ্চিত বিস্মিত হইয়া গগনের দিকে তাকাইল, আষাঢ়ের আকাশে মেঘের লেশ মাত্র নাই। রোদের পর রোদ সর্বত্র প্রতিফলিত হইয়া ঝলমল করিয়া মানুষ্য সৃষ্ট ঢাকা শহরকে উপহাস করিয়া চলিতেছে।লোক্ টি মনে মনে ভাবিল আজিকে ত্রিচক্রযান পাওয়া বড়ই মুশকিল হইবেক।হইলও তাহাই। প্রায় সকল চালকই রোদ্র তেজ থাকিয়া নিস্কৃতি পাইবার প্রত্যাশায় শহরের যথাসামান্য ছায়ায় আশ্রয় নিয়াছে। কেহ কেহ কুন্ডলি পাকাইয়া ত্রিচক্রযানের ভিতরে বসিয়া হাপাইতেছে। লোকটা বুঝিল এইবেলা ত্রিচক্রযান পাইবার আশা দুরাশা মাত্র, তথাপি সে অগ্নিকুন্ড ন্যায় রাজপথে ত্রিচক্রযানের আশায় রহিল।
ঠিক এইসময়েই পথিক লোকটার দৃষ্টি আকর্ষন করিল।লোকটা পূর্ণ দৃষ্টি তে পথিকের দিকে তাকাইল।সবু্জ রঙের লুঙ্গি তার উপরে খয়েরি রঙের ফুলহাতা শার্ট, গামছা শক্ত করিয়া কোমড়ে বাঁধা।মাঝারি একহারা গড়ন, খালি পা। বোঝা যায় সদ্য্ শহরে আগত, গ্রামের কোমলতা ও সারল্য এখনো চেহারা হইতে মলিন হইয়া মিলাইয়া যায় নাই। পথিক দ্বিতীয় বারের মত লোকটাকে জিজ্ঞাসিল, “মহাশয় গাবতলী যাইবার পথ বলিতে পারিবেন?” লোক্ টা এই ভরদুপুরে মাঝ শহর থেকে গাবতলী যাইবার পথ না বাতলাইয়া জিজ্ঞাসিল, “গাবতলী যাইবেন, সেত অনেক দূ্রের পথ, কিভাবে যাইবেন পদব্রজে?যানে গমন করিতেছেন না কেন?”
পথিক অতিশয় বিরক্ত হইয়া লোকটির পানে তাকাইল।বলিল আমি পোস্তাগোলা হইতে এইঅব্দি হা্ঁটিয়া আসিয়াছি, আর বাকিটুক যাইতে পারিব না? লোক টি আবারো শুধাইল যানে গমন করিতেছেন না কেন? পথিক বলিল তাহার বাড়ি কুস্টিয়া, ঢাকায় আসিয়াছিল কাজের খোঁজে, ধারনা ছিল ঢাকায় আসলেই কাজ পাওয়া যাইবে।ঢাকায় কিছুক্ষন থাকিয়াই তাহার শখ মিটিয়াছে। সঞ্চিত টাকা পয়সা ঠগ আর বাটপারে লইয়া যাইবার পর, সে এখন নিজালয়ে ফিরিবার পন্থা খুঁজিতেছে।ইতিমধ্যে সে একদফা কমলা্পুরে থাকিয়া বি আর টি সি যানে গ্রামে ফিরিবার জন্য কাকুতি মিনতি করিয়াছে, কিন্তু অর্থ নাই বলিয়া তাহারা তাহাকে বহন করিতে রাজি হয় নাই।নিরুপায় হইয়া একন সে হাঁটিয়া গাবতলী যাইতেছে, এই আশায় যে কোন সদয় চালক নিশ্চিত তাহাকে বহন করিবে। লো্কটি এইবারে শুধাইল অর্থ নাই? পথিক অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল নাহ নাই, আপনি দেবেন? লোক টা বুঝিল এই শহরের মানুশের কাছে চাইয়া হয়ত পথিক সামান্য সাহায্য পায় নাই। মানুশের আর দোষ কি, কাহারই বা সময় আছে কারো কাহিনী শুনিবার, সবাই যে নিজেকে লয়েই ব্যস্ত।
লো্কটি সাত ঘাটের জল খাইয়া বড় হইয়াছে বলিয়াই আসল নকলের পার্থক্য অন্তর দিয়া অনুধাবন করিতে পারে। দেশে বিদেশে থাকিবার সময় তার মানুষ চিনিবার ক্ষমতা হইয়াছে। লো্কটা উপলব্ধি করিতে পারিল পথিক শঠ নহে, প্রানহীন এই শহরে অনেক স্বপ্ন নিয়া আসিয়া, স্বপ্ন ভঙ্গের পর বেদনার্ত হ্দয়ে এখন বাড়ি ফিরিবার পথ খুঁজিতেছে।
লো্ক টা সামান্য চাকুরে, মাসের বেতন দিয়া উচ্চমূ্ল্যের বাজারে পরিবার লইয়া কোন রকমে দুর্বিষহ দিননিপাত করিতেছে। প্রয়োজনের খাবার জুটাইতেই তাহার নিশ্বাস প্রায় বাহির হইয়া যাইতেছে।তথাপি তাহার পথিক কে দেখিয়া বড় মায়া হইল। পকেট হইতে দুইশত টাকা বাহির করিয়া লো্ক টা পথিকের পানে বাড়াইয়া দিল। পথিক বিস্ফো্রিত নয়নে মুখ তুলিয়া লো্ক টির পানে চাহিল।কিঞ্চিত ইতস্তত করিয়া অর্থ গুলি নিয়া লো্কটার মুখপানে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল।লো্ক টি পথিক কে অর্থ পকেটস্থ করিতে বলিলে যেন পথিক সম্বিত ফিরিয়া পাইল।সে অর্থ পকেটে রাখিয়া এইবার সজোরে লোক টির হাত চাপিয়া ধরিয়া তাহার আদ্যপান্ত ঠিকানা বলিয়া গেল।তাহার পরে লোক টিকে জিজ্ঞাসিল “আপনার বাড়ি কোথায়?”, লো্ক টা ভ্রুক্ষেপ না করিয়া বলিল, আপনাকে অতিশয় ক্ষুধার্ত দেখাইতেছে, কিছু অর্থ দিয়া আহার করুন বাকিটা দিয়া বাড়ি ফিরিয়া যান।পথিক তথাপিও একচুল সরিল না। লো্ক টার পানে সে একদৃষ্টে চাহিয়াই রহিল।
লো্ক টা এইবার কিছু না বলিয়াই আবার ত্রিচক্রযান খুজিতে মনোনিবেশ করিল।পথিক সেইসময়েও লো্ক টার দিকে অপলক নেত্রে তাকাইয়া রহিয়াছে।লো্ক টা মনে মনে বলিল “আহা রে”। কিঞ্চিত সময় পরে পথিক কিছুদুর আগ্রসর হইয়া আবার পিছন পানে লো্ক টার দিকে তাকাইলো।চোখে তখনো বিস্ময়ের ঘোর, চেহারাতে অবিশ্বাস।
এমনি সময় এক সদাশয় ত্রিচক্রযান চালক লো্ক টিকে গন্ত্যেব্যে পৌছাইয়া দিতে সম্মত হইল।ততক্ষনে গগনের রঙ পাল্টাইয়াছে।কাল মেঘের দলের আনাগোনায় গগন মুখরিত, আষাঢ়ে বাতাস ধুলো ঝড়ে ঢাকিয়া দিতেছে শহরের সমুদয় লাজ।লো্কটার ত্রিচক্রযান ততক্ষনে চলিতে আরম্ভ করিয়াছে, কিচ্ছুক্ষন পর বৃষ্টির ঝাপ্টা আসিয়া তাহার মুখে লাগিলেও সে পাথরের মত বসিয়া রহিল,বৃষ্টির জল তাহার কপো্ল বাহিয়া একবিন্দু অশ্রুর সহিত একাকার হইয়া ঢাকা শহরের নরদমায় আশ্রয় লইল।