বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, চোখ মেলতেই দেখি_আমার বিছানায় পড়ে আছি আমি---একটা লাশ হয়ে!
বিছানাটা একেবারেই দুমড়ে-মুচড়ে আছে। বালিশের পাশে ১৩টি মিসড-কল সমেত নিথর পড়ে আছে আমার মোবাইল ফোন। এই যুগে হাত ঘড়ি খুব বেশি লোকে পড়ে না, আমিও পড়তাম না, যদি না সেটার সঙ্গে আমার বাবার ব্যক্তিগত স্মৃতি জড়িয়ে থাকত; সেই হাত ঘড়িটাও উল্টে পড়ে আছে এক পাশে। বিছানা-লাগোয়া ড্রেসিং টেবিলের ওপরে আধ গেলাশ পানি। পাশে এলোমেলো পড়ে আছে ওষুধের ছোট বাক্সো। আমার লাশটার একটা হাত গেলাশের দিকে বাড়ানো। হয়তো শেষ মুহূর্তে প্রচণ্ড জলতৃষ্ণা পেয়েছিল আমার।
মাথার ওপর একবুক বিরক্তি নিয়ে ঘঁ-ঘোঁ শব্দ করতে করতে ঘুরতে থাকা ফ্যান আর দেয়াল ঘড়ির কাঁটা বাদ দিয়ে সব কিছু কেমন যেন স্থির হয়ে আছে। স্থির হয়ে আছে শিকার-সন্ধানী টিকটিকি। স্থির হয়ে আছে ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে আসা ল্যাস্পপোস্টের আলো। স্থির হয়ে আছে দেয়ালে ফটো হয়ে ঝুলে থাকা আমার মলিন বাবা। স্থির হয়ে আছি আসলে আমি নিজেই, বলা ভালো আমার নিথর দেহটা।
মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মরবার সময় খুব বেশি কষ্ট হয়নি আমার। মুখটা কেবল একটু ফাঁক হয়ে আছে_শেষ নিঃশ্বাসটুকু নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টায়। শরীরটা কেমন জানি কুঁড়ড়ে আছে। বেঁকে আছে পা জোড়া। আমি মরে গেলাম!
বেঁচে থাকতে নিজের জীবন নিয়ে কত শাপশাপান্তই না করেছি। এখন মরে গিয়ে আমার প্রথম যে অনুভূতিটা হলো, 'আহা, বেঁচে থাকাটা কষ্টকর হলেও কী আনন্দটাই না ছিল!
আমার জীবন, শুকতলা য়ে যাওয়া জীবন, অচল পয়সার মতো অনাদরে পড়ে থাকা জীবন, উচ্ছিষ্টের জীবনটাকেও তার পরও কত ভালোই না ছিল! হয়তো জীবনের জন্যই একটা মোহ তৈরি করে রেখেছিল জীবন। আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল ত। বাইরে রঙচঙা বাহার। কত হাভাতে স্বপ্ন ছিল। ছিল টিনের তলোয়ার নিয়ে লড়াইয়ে নামার নির্বোধ সাহস।
আমি কবি হতে চেয়েছিলাম। এক পৃথিবী লিখব বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম ঘর থেকে। আমি বিপ্লবী হতে চেয়েছিলাম। আমার বিপ্লবের মটরসাইকেলের চাকা বনবন ঘুরতে চেয়েছিল এশিয়া থেকে আফ্রিকা। শেষ পর্যন্ত আমি ঘাড়কুঁজো মধ্যবিত্তের জীবনটাই বেছে নিয়েছিলাম। আহা, সেই জীবনটাও আর কোনোদিনই ফিরে পাব না!
একটু কান্না কান্না লাগছিল। কিন্তু সেই অনুভূতি স্থায়ী হলো না বেশিণ। কারণ দ্রুতই একটা ভয় আমাকে গ্রাস করতে শুরু করল। চোখ মেলতেই কেউ যদি প্রথম একটা লাশ দেখে, হোক না সেই লাশ তার নিজেরই, কেমন অনুভূতি হয় বলুন!
আমিও ঘুমের ঘোর থেকে এক ঝটকায় গা ঝাড়া দিয়ে যেন জেগে উঠলাম। এক দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম শোবার ঘর থেকে। ঝড়ের বেগে ছুটলাম বাথরুমের দিকে। ছুটতে গিয়ে পায়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে পড়ে গেল ময়লার ঝুড়ি। সেদিকে ভ্রূপে না করে এক ঝটকায় খুলে ফেললাম বাথরুমের দরজা। ভেতরে শরীরটাকে সেঁদিয়ে দিয়েই বেসিনের কলটা ছেড়ে তার নিচে এলিয়ে দিলাম মাথা। এই মুহূর্তে মাথায় শীতল জলের প্রস্রবণ খুবই জরুরী। মাথাটা আগে ঠান্ডা করা চাই।
ট্যাপের পানি আমার চুল ভেজালো, আমার কপাল ভেজালো। চোখ, আমার গাল, থুতনি, ঘাড় বেয়ে হরিণীর চঞ্চলতা নিয়ে জল ছুটে গেল আমার পিঠে, বুকে। একটু ধাতস্থ হয়ে এলে আমি ভাবতে শুরু করলাম--কাল রাতে আসলেই কী ঘটেছিল?
সিমু ভাইয়ের বাসায় বিদেশি পানীয়রও লোভনীয় প্রস্তাবটি কি শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করেছিলাম? নেই, কিচ্ছু মনে নেই। স্মৃতিঘরে শুধুই শূন্যতা--আমার ব্যাংক-হিসাবের মতো। প্রাণপণে ভাবতে চাইলাম, আমি আসলে একটা ঘোরের মধ্যে আছি। নেশার ঘোর।
হয়তো কাল সন্ধ্যায় সিমু ভাইয়ের বাসায় গলা পর্যন্ত মদ গিলে এসেছি। এমনও হতে পারে, রাতে ঘুম আসছিল না বলে ঘুমের ওষুধ দু-চারটা বেশিই গিলে ফেলেছি। কিংবা কিছুই নয়, আসলে এখনো ঘুমের মধ্যেই আছি, দেখছি দুঃস্বপ্ন। যেন এুনি জেগে উঠে দেখব--সব ঠিক আছে।
যা কিছুই হোক না কেন, 'আমি মরে গেছি' এই ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। কে পারে বলুন!
আমি তাই এবার বেসিন থেকে মাথাটা সরিয়ে শাওয়ারই ছেড়ে দিলাম। বাথরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে হু হু ঢুকছে ঘুমভোরের নিষ্পাপ বাতাস। সূর্যও যেন আড়মোড়া ভেঙে কেবল জাগছে ঘুম থেকে। রাত কেবলই ভাঙছে। এখনো কেটে যায়নি পুরো অাঁধার। জেগে ওঠেনি কর্কশ কাকের দল। অদ্ভুত ঘোর লাগা একটা সময়। মায়াবী সময়। বিভ্রান্তি জাগানিয়া সময়।
অদূরের মসজিদের মাইকটারও ঘুম ভাঙল সহসাই। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে নামাজের আহ্বান জানাচ্ছেন মুয়াজ্জিন। আহা, কতদিন ভোরের আজান শোনা হয় না! পাপ ধুয়ে যাওয়ার মতো শুদ্ধতা এনে দিল ভোরের স্নান। পাশে ঝুলে থাকা কদিনের বাসি লুঙ্গিটাই টেনে নিলাম। আমার মতো ঘোরতর নাস্তিকও ঠিক করে ফেলল, যদি মরে গিয়ে না থাকি, যদি সত্যি সত্যিই চোখ মেলে দেখা প্রথম ছবিটা ভুল হয়ে থাকে, আগামীকাল থেকেই নামাজ পড়তে শুরু করে দেব। না, আগামীকাল নয়, আজ থেকেই!
প্রায়শ্চিত্যবোধ পেয়ে বসল আমাকে। হু হু কান্নায় ভেঙে পড়লাম। কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে বসলাম বসার ঘরে, সোফায়। শোবার ঘরে ঢোকার সাহসটাও আর পাচ্ছিলাম না। ওখানে যে জলজ্যান্ত একটা লাশ পড়ে আছে। নাহ্, ভুল বলা হলো। লাশ আবার 'জ্যান্ত' হয় কী করে! হোক না নিজের লাশ, তার পরও লাশ তো!
আচ্ছা, আমি কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি? অপ্রকৃতস্থ? সিজোফ্রেনিয়ার রোগী?
আমার মৃতু্যর খবরটা জানানো দরকার। এমনিতে একলা থাকি। আশেপাশের ফ্যাটের লোকদের সঙ্গেও তেমন পরিচয় নেই, শুধু মুখ চিনি। আমার লাশ এভাবে পড়ে পড়ে পঁচে দুর্গন্ধ না বেরোলে কেউ খবরই নেবে না। কিন্তু কীভাবে খবর দেব। কাকেই বা দেব? দ্রুতই পরিচিত কয়েকজনের তালিকা করে ফেললাম মনে মনে। এদের সবাইকে মেসেজ পাঠাতে হবে মোবাইলে। কিন্তু মোবাইলটা পড়ে আছে লাশের পাশে। নিয়ে আসার ইচ্ছাটা কোনো মতেই জাগাতে পারলাম না।
সেটা পরে দেখা যাবেখন। আপাতত মনে মনেই মেসেজের একটা খড়সাও তৈরি করে ফেললাম দ্রুত: 'প্রিয় বন্ধু, শুনে দুঃখ পাবে, আজ ভোর রাতে আমি মারা গেছি। আমার লাশ পড়ে আছে মোহাম্মদপুরে আমার ফাটে, শোবার ঘরের বিছানায়। আমার শেষ কোনো চাওয়া ছিল না, ছিল না ইচ্ছা। তবে তোমাদের কাছে এইটুকু দাবি_আমার মরে যাওয়ার খবর প্রায়মৃত আমার মায়ের কাছে পেঁৗছে দিও না। এমনিতেই আমার মা ধরে নিয়েছে, তাঁর একমাত্র ছেলে হারিয়ে গেছি। আমি না হয় হারিয়ে গিয়েই বেঁচে থাকি...'
এই মেসেজ পাওয়ার পর কার কী প্রতিক্রিয়া হবে সেটা ভাবতেই হাসি পেল। সাদেক ভাই অবশ্য খুশি হতে পারেন। ওনার কাছে আমার বেশ কিছু টাকা পাওয়া পড়ে ছিল বহুদিন। সেই টাকাটা আর শোধ দিতে হবে না, সাদেক ভাই নিশ্চয়ই স্বস্তিই পাবেন।
কিন্তু কেউ কি কাঁদবে না আমার মৃতু্যতে? কে বেশি দুঃখ পাবে? আদৃতা? নাকি নীলিমা? যাদের দুজনকেও ভালোবেসেও শেষ পর্যন্ত ভালোবাসতে পারিনি। হয়তো এঁদের কেউই নয়, সবচেয়ে বেশি দুঃখটা পাবে আমার মা, যদি শেষ পর্যন্ত জেনে যান আমার মৃতু্যর খবর। হঁ্যা মা-ই কষ্ট পাবে সবচেয়ে বেশি। চুলোয় জ্বাল ঠেলতে ঠেলতে, ধোঁয়ায় খুক খুক কাশতে কাশতে ঘোলাটে চোখ নিয়েও যিনি উজ্জ্বল স্বপ্ন দেখেছেন আমাকে নিয়ে_ছেলে তার সুদিন এই আনল বলে।
বাড়িঅলাও দুঃখ পেতে পারেন। এ মাসের বাড়ি ভাড়াটা তো গচ্চা গেলই। উল্টো পুলিশি হাঙ্গামায় পড়তে হতে পারে তাঁকে। এ ধরনের কেসে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা কামাতে পুলিশরা খুবই ওস্তাদ।
ভালো কথা, আমি নিজে পুলিশি কোনো ঝামেলায় পড়ব না তো! ও ঘরে পড়ে আছে লাশ, হোক না সেটা আমারই, আর এই ঘরে আমি। পুলিশ যদি দরজা ভেঙে ঢুকলে লাশের সঙ্গে তো প্রথমে আমাকেই আবিষ্কার করবে এ ফ্যাটে।
বাংলাদেশের নির্বোধ পুলিশ। হয়তো আমাকেই আমার খুনের অপরাধে হাতকড়া পড়াবে। পত্রিকায় হবে শিরোনাম: নিজেকেই খুন করেছে ২৭ বছর বয়সী যুবক! র্যাব দেবে বিবৃতি, 'কুখ্যাত কালা জাহাঙ্গীরের ডানহাত অমুক অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার।'
কে জানে, হয়তো আমাকে নিয়ে শুরু হয়ে যেতে পারে রাজনীতিও। চাই কি দু-তিন দিন হরতালও ডেকে বসতে বিরোধী দল। আমাকে নিয়ে নাগরিক শোকসভা কি হবে? হতেও পারে। নিতান্ত ঘরোয়া আয়োজনে লোক দেখানো চোখের জল ফেললে আখেরে নিজের দামই বাড়ে_দুবর্ুদ্ধিজীবীদের এ ভালোই জানা। হয়তো আমার বন্ধু দেবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর ব্লগে লিখবে দরদ উপচানো একটা লেখা: 'সেই রুটি, সেই পাঁচ টাকা, সেই ছেঁড়া লাল গেঞ্জি...সবই আছে_শুধু তুই নেই।'
ধুর, কীসব ভাবছি! আপাতত এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা খোঁজাটাই বেশি জরুরী। আচ্ছা আমি ঠিক দেখেছিলাম তো? চোখ মেলে একটা লাশই তো দেখলাম? আমার লাশ! নাকি ঘুমের ঘোর? এই ধাঁধার সহজ সমাধান শোবার ঘরে আবার যাওয়া। শোবার ঘরে ঢুকলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। পরিষ্কার হয়ে যাবে, আমি জীবিত নাকি মৃত। কিন্তু পা জোড়া একদমই শক্তি পাচ্ছে না ও ঘরে যাওয়ার জন্য।
শেষ পর্যন্ত সব দ্বিধা ঝেড়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। ভিরু পায়ে এগিয়ে গেলাম শোবার ঘরের দিকে। ভয়ে-শিহরণে চোখ বন্ধ হয়ে এল আপনাআপনি। আন্দাজে হাতলটা ধরে আধভেজানো দরজা ঠেলে দিলাম ওপাশে। বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, চোখ মেলতেই দেখি...!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




