‘ঠক-ঠক-ঠক..’ এতো রাতে আবার কে এলো? বারোটা বাজতে মাত্র শুয়েছি। অগত্যা উঠলাম। দরজা খুলে দেখি রাসেলভাই। ‘কংগ্রাচুলেশনস্!’ বলেই আমার দিকে হাতে ধরা পলিথিন ব্যাগের মিষ্টির প্যাকেট দুটি বাড়িয়ে দিলেন। ব্যাপার কি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। ‘আরে ইন্টারমিডিয়েটে কমার্স থেকে স্টার পাওয়া সামান্য কথা? তোমার জন্য মিষ্টি এনেছি, নাও নাও, ধরো।’ আমি তাজ্জব! আমার বন্ধুরা যারা ফার্স্ট ডিভিশন এমনকি সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছে তাদের বাসায় আজকে ধুমছে মিষ্টি খাওয়া চলেছে, বাড়ি বাড়ি মিষ্টিও বিলানো হয়েছে। অথচ আমার বাসায় আনা হয় নি। বিকেলে রেজাল্ট জেনে এসে আব্বাকে জানালাম, তিনি খুশি হলেন কিন্তু মিষ্টি কেনার ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। আমিও নীরব রইলাম। ভাবলাম, কদিন ধরে সংসারে টানাটানি যাচ্ছে, তাছাড়া মা নানার চল্লিশা খেতে গ্রামে গিয়েছে, খামখা অযথা খরচে লাভ কী? ‘নাও খাও, আরে লজ্জা পাচ্ছো কেন?’ রাসেলভাই একটি প্যাকেট থেকে কমলা আকৃতির একটি সন্দেশ নিয়ে নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দিতে চাচ্ছেন। লজ্জা পাওয়ারই কথা। আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে কখনো জন্মদিন পালন হয় না, সুতরাং টিভিতে বাংলা ছবিতে দেখা নায়িকার জন্মদিনে বাবা-মা-বন্ধুরা যেমন তাকে কেক খাইয়ে দেয়Ñ সে ধরণের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। জড়তা তো থাকবেই! এমন আপেল কমলা আকৃতির সন্দেশ খাওয়ার ভাগ্যও আমার কখনো জোটে নি, কেবল রাস্তায় যেতে কাচ ঘেরা মিষ্টির দোকানে দেখেছি। রাসেলভাই শুধু সন্দেশ না, আরকেটি প্যাকেট খুলে মিষ্টিও খাওয়ালেন। ঘটনার তাৎক্ষণিক মুহূর্তে আনন্দে আমার চোখে পানি আসার উপক্রম। এই আমাদের বড়লোক বাড়িওয়ালার ছোট ছেলে রাসেলভাইÑ যিনি কিনা তিন তিন বার মেট্রিক ফেল, উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেদের মতোই সরাদিন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়ান, নেশা-পানি করেন বলেও শোনা যায়। অবশ্য এলাকার কাউকে তাকে খারাপ বলতে শুনি নি। ভদ্রঘরের ছেলের আচরণ তার মধ্যে স্পষ্টÑ গুরুজনদের সাথে কথা বলতেন চোখ নামিয়ে জড়সড় ভঙ্গিতে। ‘খালাম্মা তো দেশে গেছে..তুমি এক কাজ করো..মিষ্টি আমাদের ফ্রিজে রেখে আসো, তাইলে নষ্ট হবে না।’ রাসেলভাইর প্রশস্ত হৃদয়ের পাশাপাশি দায়িত্বশীলতার এহেন পরিচয়ে আমি তো যারপরনাই বিস্মিত। তখন আমাদের ফ্রিজ ছিল না। অতএব রাসেলভাই চলে গেলে সে রাতেই কিছু মিষ্টি-সন্দেশ বাড়িওয়ালার বাসায় দিয়ে বাকিটা তাদেরই ফ্রিজে রেখে আসলাম।
ইন্টারমিডিয়েট পাশের বছরই মানে ১৯৯৯ সালে নাগরিক প্রয়োজনে আমরা রাসেলভাইদের বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। তারপর রাসেলভাইর সাথে দু-তিনবার দেখা হয়েছে। নির্মল হেসে তিনি বলতেন, ‘ভালো মতো পড়াশুনা করবে, পড়া ছাড়া জীবনে কিছু করতে পারবে না।’ কিছুদিন আগে কানে আসলো, রাসেলভাই নাকি এখন ভালো হয়ে গেছেন, বন্ধু-বান্ধব একদম বাদ, বাবার ব্যাবসায় গিয়ে বসেন আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। শুনে খুবই ভালো লেগেছিল সেদিন। সত্যি বলতে কি মনটাকে কীভাবে বড় করতে হয় এ শিক্ষা আমি তার কাছ থেকেই নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার এই প্রিয় মানুষটার নতুন জীবন বেশিদিন স্থায়ী হলো না। গত সপ্তায় পত্রিকায় সাভারে একটা সড়ক দুর্ঘটনার কথা দেখলাম। এরকম কতই তো হয়! আমি চোখ বুলিয়ে পাতা উল্টে যাই। গতকাল মা বললো, ‘জানিস? আমাদের সেই বাড়িওয়ালার ছেলে রাসেল মারা গেছে। সাভারে মাল কিনতে গেছিল। রাস্তা পার হতে গিয়ে...’

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




