
আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ১
আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ২
আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ৩
আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ৪
আফগানিস্তান ও শতাব্দির ইতিহাসঃ পর্ব ৫
সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে বিমান হামলা চালানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র তালিবান সরকার কে ওসামা বিন লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দিতে বললে তালিবান সরকার বন্ধুকে শত্রুর হাতে তুলে দেয়া আফগান রীতির পরিপন্থী বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থাব নাকচ করে দেয়। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম নামে আফগানিস্তানে হামলা শুরু করে। যদিও আন অফিশিয়ালি যুদ্ধ টুইন টাওয়ার হামলার ১৫ দিন পরেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখন সি আই এ সদস্যরা আফগানিস্তানে ঢোকে এবং উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে সংগঠিত করতে শুরু করে ও অস্ত্র সরবরাহ শুরু করে। এ সময় উত্তরাঞ্চলীয় জোটের উপদেষ্টা ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রব্বানি। আফগানিস্তানে হামলায় যুক্তরাষ্ট্র এ সময় তার উপসাগরীয় ঘাটি গুলি ব্যবহার করে এবং পাকিস্তানের আকাশ সীমা ব্যবহার করে। ন্যাটো সেনারা আফগানিস্তানে প্রবেশ করলে রশদ সরবরাহের জন্য পাকিস্থানের ভূমি ও বিমান ঘাটি ব্যবহার করে। অনিচ্ছা সত্বেও পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করে। অবশ্য বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা নেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের উপর্যুপরি বিমান হামলার আড়ালে উত্তরাঞ্চলীয় জোট ও ন্যাটো সেনারা দ্রুত আফগানিস্থানের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নেয়। নভেম্বরের শুরুর দিকে কাবুল তালিবানের হাতছাড়া হয়ে গেলে বুরহানুদ্দিন রব্বানী কাবুলে ফিরে আসেন এবং ন্যাটো ও উত্তরাঞ্চলীয় জোটের সমর্থনে ১৩ নভেম্বর ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবার দায়িত্ব নেন। নভেম্বরের মধ্যে বেশিরভাগ এলাকা তালিবানের হাতছাড়া হয়ে যায়। ৫ ডিসেম্বর হামিদ কারজাই কে পরিবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্ধারন করা হয় এবং ২২ ডিসেম্বর ২০০১ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। হামিদ কারজাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করলে তালিবানের একটা অংশ তার কাছে আত্বসমর্পন করার প্রস্তাব দিলে প্রসিডেন্ট বুশ তা মেনে না নেয়ায় তা আর সম্ভব হয় নি। তবে মোল্লা ওমর ইতিমধ্যে কান্দাহারে আত্মগোপন করেন।
বলা হয়ে থাকে যুদ্ধের শেষ দিকে অনেক তালিবাল, আলকায়দা ও আই এস আই এজেন্ট কুন্দুজ প্রদেশে আটকে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে হামলার পরিকল্পনা করলে পাকিস্থান সেখান থেকে তার এজেন্টদের উদ্ধারে এয়ারলিফটের অনুমিতি চায়। অনুমতি পেলে সেখানে আটকে পড়া শত শত তালিবান ও আলকায়দা নেতাদের এয়ারলিফটের মাধ্যমে নিরাপদে পাকিস্থানের চিত্রাল ও গিল্গিট এয়ারবেজে উড়িয়ে আনে। ভারত এ ব্যপারে অনেক হইচই করলেও যুক্তরাষ্ট্র কখনো তা স্বীকার করেনি।
হামিদ কারজাই ক্ষমতা গ্রহনের পর যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি এসিস্ট্যানস ফোর্স গঠন করে হামিদ কারজাই সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য। ইতিমিধ্যে তালিবান ও আল কায়েদা নেতারা দুর্গম পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ পাকিস্তান সহ অন্যান্য দেশে পালিয়ে গেছে। সাধারন তালিবান যোদ্ধারা কেউ দেশ ছেড়েছে কেউবা কৃষিকাজ সহ তাদের পূর্ববর্তী পেশায় ফিরে গেছে। ইসলামী আইন জাড়ি, পশতু রীতির প্রতি সমর্থন ও আমেরিকার মত শক্তির বিরুদ্ধে দাড়ানোও আফগানিস্থানের পশতু অধ্যুশিত অঞ্চল গুলোতে তখন ও তালেবানের ব্যপক সমর্থন থাকায় তালিবান যোদ্ধাদের পালিয়ে থাকায় ও পুনর্বাশিত হওয়ায় তেমন কোন সমস্যা হয় নি। অনেকের মতে আই এস আই তালিবান পতনের পরেও নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। আবার অনেক তালিবান যোদ্ধা মনে করেন দুঃসময়ে পাকিস্তান তাদের ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
এদিকে ন্যাটো বাহিনী আফগান সেনাবাহিনীর পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে। তাদের ট্রেইনিং ও অস্ত্র সরঞ্জামের পিছনে বিলিয়ন ডলার খরচ করে। অন্যদিকে তালিবান যোদ্ধারা আবার পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। তাদের আধ্যাত্মিক নেতা মোল্লা ওমর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিভৃতে আত্মগোপনেই থেকে যান।
ইতিমধ্যে ধ্বংশপ্রাপ্ত আফগানিস্তানের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় তাও ধ্বংশ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখলের পর আফগানিস্তনে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অনাহারে প্রচুর মানুষ মারা যায়। এ সময়ে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলি আবার আফগানিস্তানে ফিরে আসে। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হলে ২০০২ সাল থেকে শরনার্থীরা আবার আফগানিস্তানে ফিরতে শুরু করে। ধীরে ধীরে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ দেশে ফেরে। যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা গঠিত আফগান বাহিনী ও ন্যাটো বাহিনী বিভিন্ন স্থানে তালিবানের বিদুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। তালিবান বাহিনীও ভিতরে ভিতরে সংগঠিত হতে থাকে।
২০০৪ সালে লয়া জিরগায় সংবিধান পরিবর্তন করে দেশের নাম ইসলামিক রিপাব্লিক ওফ আফগানিস্তান করা হয়। ২০০৯ সালে প্রথম বারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় যা ব্যপক বিতর্কিত ছিল। হামিদ কারজাই ই সে নির্বাচনের পর ক্ষমতায় থেকে যান। ২০০৯ সালে যখন মার্কিন ড্রোন হামলায় ব্যপক হারে সাধারন মানুষ হতাহত হতে থাকে তখন হামিদ কারজাই তালিবানের সাথে আলোচনায় বসতে চান, কেননা তিনি এ ড্রোন হামলার পক্ষে ছিলেন না। তবে তা ওবামার অনিচ্ছায় করা সম্ভব হয় নি। তালিবান হামলায় ও এসময় ন্যাটো সেনা ও বিদেশি কন্ট্রাকটররা ব্যপক ক্ষয় ক্ষতির শিকার হয়।
২০১১ সাথে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংখ্যক সেনা (১,৪০,০০০) অবস্থান করে। এ সময় ক্ষমতাশীন নেতা ও সরকারী কর্মকর্তারা ব্যপক অনিয়ম ও দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ করা হয়। ২০১৪ সালে আফগানিস্তানের ইতিহাসে প্রথম বারের মত জনগনের ভোটে প্রেসিডেন্ট পরিবর্তিত হয় এবং আশরাফ ঘানি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। তার সরকার ও দূর্নীতি মুক্ত থাকতে পারে নি। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ন্যাটো আনুষ্ঠানিক ভাবে ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি এসিস্ট্যানস ফোর্স সমাপ্ত ঘোষনা করে আফগানিস্তানের নিরাপত্তার দায়িত্ব আফগান সরকারকে সমর্পন করে এবং অপারেশন রিসোলিউট সাপোর্ট শুরু করে।
এ সময়ে মার্কিন ও আফগান বাহিনীর উপর তালিবান হামলা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে তালিবান ও মার্কিন বাহিনীর মধ্যে কোন গোপন সমঝোতা হয় বলে ধারনা করা হয়। ডোনাল্ট ট্রাম্প ক্ষ্মতায় আসার পর আফগানিস্থান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন এবং ২০১৮ সাল নাগাদ মাত্র ১৮০০০ ন্যাটো সেনা আফগানিস্তানে থাকে আফগান সেনাদের প্রশিক্ষন ও মার্কিনিদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী কাতারে যুক্তরাষ্ট্র ও তালিবান একটি শান্তিচুক্তি করে যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার ও মার্কিন সেনাদের উপর তালিবানের হামলা না করার কথা বলা হয়।
শান্তিচুক্তির প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১ মে থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে এবং তালিবান সে এলাকাগুলি দখল করতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের শেষ প্লেন আফগানিস্তান ছাড়ার আগেই ১৫ই আগষ্ট সকালে তালিবান যোদ্ধারা পায়ে হেটে কাবুলে প্রবেশ করে এবং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দখল নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রেসিডেন্ট আসরাফ ঘানি এর পুর্বেই বিপুল অর্থসহ দেশ ছেড়ে আরব আমিরাতে পাড়ি জমান। আফগান সেনাবাহিনী বরাবরই শ্রোতের অনুকূলে থেকেছে, এবার ও তারা প্রথা অনুযায়ী তালিবান যোদ্ধাদের বিনা বাধায় কাবুল দখন করতে দিয়েছে।
১৭ই সেপ্টেম্বর ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ পানশিরে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষনা দেন এবং আহম্মদ মাসুদের অনুসারী ৬০০০ যোদ্ধা নিয়ে এন্টি তালিবান ফোর্স গঠন করে আন্তর্জাতিক সহায়তা চান। ৬ সেপ্টেম্বর তালিবান পানশিরের নিয়ন্ত্রন নিলে তারা তাজিকিস্তানে পালিয়ে যান। ৭ সেপ্টেম্বর হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা সুপ্রিম লিডার ও হাসান আখুন্দ অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রি হিসেবে দায়ত্ব নেন এবং দেশকে আবার ইসলামিক এমিরেটস অফ আফগানিস্তান হিসেবে ঘোষনা দেন। বলা হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষে অপেক্ষাকৃত লিবারেল নেতা হাসান আখুন্দকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে। তালবান মন্ত্রীসভায় এবারো কোন নারীকে রাখা হয় নি। তালিবান ক্ষমতা নেয়ার পর আই এম এফ ফান্ড বন্ধ করে দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকে দেয়। এসময়ে পাকিস্তান, চীন ও কাতার তালিবান সরকারকে সহযোগিতা দেয়। যদিও এখনো তাদের সরকার কোন দেশের স্বীকৃতি পায় নি তবে জাতীসংঘ ও বেশ কিছু দেশ তালেবানকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাশিয়া শুরু থেকেই তালিবান সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে।
গত ২০ বছরে প্রায় আফগানিস্তানে ১,৪৭,০০০ সশস্র ও ১,৭০,০০০ সাধারন মানুষ নিহত হয় বলা হলেও বাস্তবে এর কয়েকগুন বেশি মানুষ নিহত হয়েছে
শেষ……
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২২ রাত ১:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




