হেঁশেলেও থাকতে পারতেন। তবে পরীক্ষাগারই টেনেছে তাঁদের বেশি। অন্যরা যখন ভাবত পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছেলেদেরই মানায় বেশি সেই তখন থেকেই সংশ্লেষণ-বিয়োজনে মগ্ন হয়েছেন তাঁরা। রসায়ন গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য দেশের ১০ নারী রসায়নবিদকে সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি। তাঁদের নিয়ে লিখেছেন আরাফাত শাহরিয়ার ও রাহাতুল রাফি
অধ্যাপক রওশন জাহান মান্নান
অধ্যাপক রওশন আরা জাহান মান্নানের শৈশব কেটেছে কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সপরিবারে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে। ১৯৬১ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। নাসার গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি এবং বিশ্বের একজন নামকরা ইলেকট্রোকেমিস্ট হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি দেশে ফিরে যোগ দেন ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি পড়াতেন এবং এমফিল গবেষকদের কার্যক্রম তদারক করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরিবারসহ তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন।
১৯৭৩ সালে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। তিনি পোস্ট-ডক্টরেট ফেলোশিপ নিয়ে ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। একটি ইলেকট্রিক্যাল গাড়িকে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় উন্নীত করার কাজে নিয়োজিত থাকেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে । ১৯৯৯ সালে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের চেয়ারপারসন ছিলেন। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ঢাকা কেন্দ্রে গবেষণা করেছেন এই রসায়নবিদ। বাংলাদেশ মহিলা বিজ্ঞানী সমিতির আজীবন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। বাংলাদেশ রসায়ন সমিতিরও আজীবন সদস্য।
১৯৬৮ সাল থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের অ্যালট্রুসা ক্লাবের সম্মানিত সদস্য। অধ্যাপক রওশন দেশের বিখ্যাত পদার্থবিদ বাংলাদেশ পরামাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আবদুল মান্নানের স্ত্রী। তাঁদের দুই ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত। আন্তর্জাতিক রসায়ন বর্ষ ২০১১-তে এই রসায়নবিদের প্রতি সম্মান জানাতে পেরে গর্ব বোধ করছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ এবং বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি।
ড. সফুরা নূরুন নবী
ড. সফুরা নূরুন নবী ১৯৩৫ সালের ২২ মে পাবনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেন পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে লাভ করেন এমএসসি ডিগ্রি। ১৯৬৭ সালে অজৈব রসায়ন বিষয়ে পিইএচডি ডিগ্রি অর্জন করেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৬০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সিএসআইআরের ঢাকার ইস্ট রিজিওনাল ল্যাবরেটরির বেঙ্গল গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকসে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজে যোগ দেন তিনি। সেখানে সাফল্যের সঙ্গে রিসার্চ কেমিস্ট, রিসার্চ অফিসার, সিনিয়র রিসার্চ অফিসার এবং প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ঢাকা ল্যাবরেটরিজ অব বিসিএসআইআরের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৯২ সালে তিনি অবসরে যান। 'রসায়ন এবং শিল্প রসায়নের প্রয়োগ' নিয়ে গবেষণায় ড. সফুরা তাঁর সুদীর্ঘ গবেষণাজীবন উৎসর্গ করেন। তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার মধ্যে রয়েছে তড়িৎ বিশ্লেষণের দ্বারা পিওর অ্যান্টিমনি মেটাল নিষ্কাশন, ফসফরাস-নাইট্রোজেনের চাক্রিক যৌগের ওপর মৌলিক কাজ, শিল্পক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উৎপাদের ব্যবহার, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন ধাতু নিষ্কাশন, সিলিকন ও সিলিকেটস এবং ক্লে মিনারেলসের প্রয়োগ। ড. সফুরা বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। বাংলাদেশ সিরামিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও তিনি। তিনি বাংলাদেশ নারী বিজ্ঞানী সংগঠন, উইমেন ইন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এশিয়া অঞ্চল, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সায়েন্টিটস অ্যান্ড সায়েন্টিফিক প্রফেশনসের আজীবন সদস্য। নারী বিজ্ঞানীদের বাচ্চাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ডে কেয়ার সেন্টার। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্সের রসায়ন শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এই নারী। সুবিচার সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও তিনি, যা বিসিএসআইআরে কর্মরত নারী বিজ্ঞানীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করে।
অধ্যাপক নিলুফার নাহার
অধ্যাপক নিলুফার নাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করছেন। তিনি কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহার ও জৈবদূষণ এবং হারবাল ওষুধের ওপর বিশেষ অবদান রাখায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই বিষয়ের ওপর তাঁর এক শরও বেশি প্রবন্ধ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক নিলুফার নাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে ১৯৭১ সালে বিএসসি অনার্স ও ১৯৭২ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি চালিয়ে যান কার্বোহাইড্রেট ও ন্যাচারাল প্রডাক্ট কেমিস্ট্রির ওপর গবেষণা। সুইডেনের স্টকহোমের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ১৯৮৫ সালে এমএসসি ও ১৯৮৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। অধ্যাপক নিলুফার নাহার বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রিসার্চ কোলাবরেশন গঠন করেন। তিনি সুইডেন ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের স্বল্পমেয়াদি ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বারডেমের সঙ্গে রিসার্চ কোলাবরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। অধ্যাপক নিলুফার অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকায় গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। রসায়ন ও রাসায়নিক গবেষণায় খুবই সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন এই নারী। তিনি বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির আজীবন সদস্য। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সবচেয়ে বড় সিম্পোজিয়াম 'টেন্থ এশিয়ান সিম্পোজিয়াম অন মেডিসিন প্লান্ট, স্পেসিস অ্যান্ড আদার ন্যাচারাল প্রোডাক্টস'-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকা থেকে ১৯৯৯ সালে পেয়েছেন সায়েন্টিটস অ্যাওয়ার্ড।
অধ্যাপক আয়েশা সিদ্দিকা রহমান
১৯৬১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন রসায়নশাস্ত্রের মতো বিষয়। দেশের অন্যতম বায়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আয়েশা সিদ্দিকা রহমান স্কুলবেলা থেকেই ছিলেন দারুণ মেধাবী। ১৯৫১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বাদশ স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। ইন্টারমিডিয়েটে অধিকার করেন অষ্টাদশ স্থান। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে লাভ করেন বিএসসি ডিগ্রি। ১৯৬০ সালে তিনি একই বিভাগ থেকে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ইডেন কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন অধ্যাপক আয়েশা। ১৯৬৭ সালে তিনি যোগ দেন বদরুন্নেছা কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সামার সায়েন্স সেমিনারে যোগদান করেন। প্রতিযোগীদের মধ্যে তিনি প্রথম বিবেচিত হন। ১৯৭৭ সালে রসায়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন জগন্নাথ কলেজে। তিতুমীর কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। দীর্ঘ শিক্ষকতাজীবনে তিনি শিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমেও নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তাঁর কলেজগুলোতে রসায়নের পরীক্ষাগার উন্নত করার পদক্ষেপ নেন। পরীক্ষাগারের সহকারীদের প্রশিক্ষণের বিষয়েও আগ্রহ ছিল তাঁর। তিনি তাঁদের শিখিয়েছেন কিভাবে ও কী কী উপায়ে কেমিক্যাল, টঙ্ডি কেমিক্যাল পরিচালন করতে হয় এবং কিভাবে কেমিক্যালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। অধ্যাপক আয়েশা পরীক্ষাগারের বিভিন্ন সমস্যার ওপর পরীক্ষণ শুরু করেন। সবার সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগানোর বিষয়েও উৎসাহিত করেন। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যামিক ও স্নাতক পর্যায়ের বিভিন্ন তাত্তি্বক কোর্সেরও পুনর্বিন্যাস করেন তিনি। আয়োজন করেন বিজ্ঞান সেমিনারের। তিনি রসায়ন পড়ে এবং পড়িয়ে প্রমাণ করেছেন, প্রচেষ্টা থাকলে মেয়েরাও রসায়ন পড়ে ভালো পর্যায়ে যেতে পারে।
সুফিয়া আমিরুল
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনে দীর্ঘ ৩১ বছর কাজ করেছেন সুফিয়া আমিরুল। কাজই তাঁকে বসিয়েছে করপোরেশনের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপকের আসনে। বিসিআইসির সম্পাদকও ছিলেন তিনি। দীর্ঘ বর্ণিল কর্মজীবন শেষে সম্প্রতি অবসরে গেছেন সুফিয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে বায়োকেমিস্ট্রিতে বিএসসি অনার্স এবং ১৯৭৬ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। তিনি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার হিসেবে কাজ করে প্রধান রসায়নবিদ পদমর্যাদায় স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। এ সময়টায় বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়। তিনি স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, আগুন ও বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনা প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন। বিভিন্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেছেন, চট্টগ্রাম সিমেন্ট মিলের মতো প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ ও নিরাপত্তা কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পরিবেশ নিরাপত্তা বিষয়ে নানা প্রশিক্ষণ তাঁকে এ বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। কর্মজীবনে বিসিআইসির বিভিন্ন উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মাগুরা পেপার মিলসের প্রথম নারী নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সার কারখানায় উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পরিবেশ নিরাপত্তায় বিসিআইসি ও বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছেন। বিভিন্ন স্বাস্থ্য ও পরিবেশ নিরাপত্তা নীতি প্রণয়নের কাজও করেছেন তিনি। তিনি বিসিআইসির পরিবেশ নিরাপত্তা নীতি প্রণয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রসায়নবিদদের সংগঠিত করার কাজটি তিনি এখনো করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির আজীবন সদস্য এবং একই সঙ্গে সমিতির সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল অথরিটি ফর কেমিক্যাল উইপনস কনভেনশনেরও সদস্য তিনি।
অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলামের পরিচিতি পাঠদান ও গবেষণার পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে। ছাত্রকাল থেকেই তিনি তুখোড় মেধাবী। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৬ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। বিএসসি ও এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এমএসসিতে পড়াশোনার সময়ই তিনি অধ্যাপক এম এ নওয়াবের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করেন 'কঠিন পদার্থের গ্যাস শোষণীকরণ' বিষয়ের ওপর গবেষণাকর্ম। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। একই বছর তিনি ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এবারডিনে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য কমনওয়েলথ বৃত্তি পান। গ্যাসীয় গতিতত্ত্বের ওপর গবেষণা করে তিনি ১৯৭৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
দেশে ফিরে গতিবিদ্যা, আলোকরসায়ন ও পরিবেশদূষণের ওপর গবেষণা সুবিধা বাড়ানোর জন্য তিনি ভৌত রসায়ন বিভাগে অনেক উদ্যোগ নেন। ১৯৮১-৮৩_এ দুই বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে নিয়োজিত থাকেন। ২০০৫ সালের দিকে কিছুদিন তিনি জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন। ন্যানো পদার্থের সংশ্লেষণ, জলীয় মাধ্যম থেকে বিষাক্ত ধাতব দূরীকরণ, রঙিন বস্তুর আলোকপ্রভাবীয় বিয়োজন বিষয়ে বর্তমানে তিনি সক্রিয়ভাবে গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। বিভিন্ন মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ও সামসুন্নাহার হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক তাজমেরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিনের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর ৩০টির মতো নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক শামীম আক্তার
অধ্যাপক শামীম আক্তার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। ১৯৭২ সালে ডা. খাস্তগীর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। কুমিল্লা বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় অর্জন করেন চতুর্দশ স্থান। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে সম্মিলিত মেধাতালিকায় ষোড়শ স্থান অর্জন করেন। তুখোড় এই ছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য বেছে নেন রসায়ন। ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৯ সালে বিএসসি অনার্স ও ১৯৮১ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। দুই পরীক্ষায়ই অর্জন করেন প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান। ভালো ফল করার জন্য কুমিল্লা বোর্ড তাঁকে মেধাবৃত্তি প্রদান করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করে স্নাতকোত্তর বৃত্তি।
বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও উচ্চশিক্ষায় পিছপা হননি। স্বামী জাপানের একটি বৃত্তি পেলে তিনি স্বামীর সঙ্গে জাপানে চলে যান। সেখান থেকে অর্জন করেন মাস্টার্স ও ডক্টরেট ডিগ্রি। দেশে ফিরে ১৯৮৭ সালে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ১৯৯৪ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৯৯ সালে অধ্যাপক হন।
প্রয়াত অধ্যাপক এম এ সালেহর অধীনে গবেষণাদলে যোগ দেন অধ্যাপক শামীম আক্তার। মিশ্র দ্রবণ ও থার্মোডাইনামিকসে সম্পাদন করেন বিশ্বমানের গবেষণা। মেলে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমী অব সায়েন্স এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা মঞ্জুরি। তিনি লিকুইড ও লিকুইড-লিকুইড সিস্টেম এবং অ্যাকুইজ ও নন-অ্যাকুইজ সিস্টেমের সঙ্গে ফিজিক্যাল ও মলিকুলারের আন্তসম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেন। দেশের একজন প্রথম সারির ফিজিক্যাল কেমিস্ট, আমেরিকান বায়োগ্রাফিক ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা পরিষদের সম্মানিত সদস্য ড. শামীম আক্তার বিজ্ঞান বিষয়ক প্রকাশনার জন্য পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
ড. হুসনা পারভীন নূর
ড. হুসনা পারভীন নূর বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর)
পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক। একই সঙ্গে গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি।
ড. হুসনা পারভীন নূরের জন্ম ১৯৫৫ সালে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে ১৯৭৭ সালে বিএসসি অনার্স এবং ১৯৭৯ সালে অজৈব রসায়নে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ১৯৮০ সালে বিসিএসআইআর ল্যাবরেটরিতে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন। একই সঙ্গে অধ্যাপক এম টি রহমানের তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে 'অরগানো মেটালিক কম্পাউন্ড'-এর ওপর পিএইচডি গবেষণা চালিয়ে যান। ১৯৯৪ সালে পিএইচডি লাভ করেন তিনি। তিন দশকের কর্মজীবনে ড. হুসনা বিভিন্ন দেশে রসায়নের বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মশালায়। ফাইবার ও পলিমারের ওপর গবেষণার কাজও করেছেন তিনি। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্লাস্টিক, পেইন্ট, রাবার, টেঙ্টাইলস, ডাইস ও পিগমেন্টসের মান নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও করেছেন। পলিমার ও রাসায়নিকের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির আজীবন সদস্য ও সাধারণ সম্পাদক। ৩০ বছর যাবৎ পলিমার রসায়ন নিয়ে কাজ করার জন্য এ সম্মান পেয়েছেন তিনি।
ড. হুসনা গিব্রেলিক এসিড ও সাইটেকিনিমভিত্তিক উদ্ভিদ বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রণ উৎপাদনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন করেন। বাকি দুটি প্রক্রিয়া হচ্ছে দীর্ঘ পরীক্ষিত অ্যালকাইড রেজিনের তেল এবং ইউরিয়া-ফরমালডিহাইড রেজিন।
অধ্যাপক নুরুন নাহার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুন নাহার। পড়াশোনা করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিএসসি ও এমএসসি_দুই পরীক্ষায়ই লাভ করেন প্রথম স্থান। তিনি জাপানের সাগা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনবুশো বৃত্তি পান এবং সেখান থেকেই ১৯৯৬ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে বেঙ্মিকো ফার্মাসিউটিক্যালে মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। ১৫ মাস কাজ করার পর তিনি চলে আসেন ঢাকার পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে। প্রথম ৯ বছর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পরে জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে উন্নীত হন। সেখানে তিনি পারমাণবিক ও অপারমাণবিক পদ্ধতিতে দাগাঙ্কনকারী পদার্থের বিশ্লেষণবিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়নকাজ করেন।
রাশিয়া ও জাপানে অনুষ্ঠিত পারমাণবিক প্রক্রিয়াবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ কর্মশালায়ও অংশ নেন তিনি। ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ড. নাহার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৫ সালে তিনি অধ্যাপক হন।
ড. নাহার একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তড়িৎ রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা তাঁর গবেষণার প্রিয় ক্ষেত্র। তাঁর ১৭টি গবেষণাপত্র বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন সমিতির আজীবন সদস্য, জাপানিজ ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের আজীবন সদস্য। জাহাঙ্গীরগর ইউনিভার্সিটি জার্নাল অব সায়েন্সের সম্পাদনা পর্ষদেরও সদস্য তিনি। প্রীতিলতা হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করছেন ড. নাহার।
অধ্যাপক ফরিদা আক্তার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন অধ্যাপক ফরিদা আক্তার। স্নাতকোত্তর শেষে তিনি ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি নিয়ে গবেষণা করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমপিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করার পর ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৭২ সালে সেখান থেকে যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যপ্রতিষ্ঠিত রসায়ন বিভাগে। এই সময়টায় শিক্ষা, গবেষণা ও গবেষণাগার উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। লন্ডনের ইমপিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, জার্মানির ম্যাঙ্ প্লাংক ইনস্টিটিউট, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব রিডিং, ইউনিভার্সিটি অব কেন্টে তিনি গবেষণার কাজ করেছেন। এসব বিদ্যাপীঠে গবেষণালব্ধ জ্ঞান তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দেশে প্রথমবারের মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি। অধ্যাপক ফরিদা আক্তার ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রসায়ন পড়াচ্ছেন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী_সবার কাছেই তিনি প্রিয়মুখ। ফরিদা আক্তারের সাম্প্রতিক কাজ হলো বায়োফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি। তাঁর এই গবেষণা ড্রাগ রিঅ্যাকশনের কার্যকলাপ বুঝতে সাহায্য করে। সম্প্রতি জৈব ও অজৈব_উভয় পলিমারের সঙ্গে ড্রাগ-পলিমার, জৈব এসিড-পলিমার, সারফেকট্যান্ট-পলিমারের সংযোগ বিষয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। তাঁর অধীনে এমএসসি ও পিএইচডি গবেষণা করছেন অনেক শিক্ষার্থী। ৬০টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ আছে তাঁর, যা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
(সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ Click This Link)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




