“না, না, এটা তো সম্ভব না, তাই না? কিভাবে সম্ভব, তুই বল?’
নিশি মেনে নিতে পারছে না। চুক চুক শব্দে মাথা নাড়াচ্ছে। কোনভাবেই যে সম্ভব না, তা নিশিকে দেখেও স্পষ্ট।
আর আমি চুপ। হঠাৎ করেই জীবনটা কেমন যেন উলটে-পাল্টে গেছে। দুমড়ে মুচড়ে গেছে সবকিছু।
নিশি আবার বলা শুরু করেছে।
‘দ্যাখ রোদ, একটু বোঝার চেষ্ঠা কর। এটা কিভাবে সম্ভব?’
‘রোদ’ নামটা নিশির দেয়া। কখনো সখনো সে এই নামে ডাকে।
আমি এক পলক নিশির দিকে তাকালাম।
ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নিশির অসম্ভবের প্রতিবাদ করি। কিন্তু আমি জানি, আমার জন্য এখন তাও অসম্ভব।
আমার কাধে একটা হাত রাখে নিশি। যেন সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গি।
‘শোন্। একটু বুঝার চেষ্টা কর। আমার দিকে একটু তাকা।’
কিন্তু আর কিছু কি শোনার বাকি আছে? যা বলার, মুখের উপর তো নিশি সবকিছু স্পষ্টভাবে বলেই দিয়েছে। আমি সব বুঝে গেছি। আর তাকিয়ে কি দেখবো? অনেক তো দেখেছি। অনেক দেখেছি।
আমি নিশির হাতটা সরিয়ে উঠে পড়লাম। একটিবারও নিশির দিকে তাকালাম না। পা দুটো যেন এগুতে চাইছে না। তবুও হনহন করে হাটছি। শেষে নিশির কণ্ঠটা আরো একবার কানে এসেছিল।
‘প্লিজ। প্লিজ শোন। তোকে বুঝতে হবে। তুই-ই বল, কিভাবে সম্ভব এটা?’
উঠে আসার সময় আমাকে থামতেও বলে নি। হাতটাও টেনে ধরে নি। পিছু পিছুও আসে নি। নিশি শুধুই বসে ছিল? থাকুক বসে। অসম্ভবের ঢালা নিয়ে সে বসে থাকুক। নিশিই তো প্রথমে কত ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞেস করছিল -পছন্দের কেউ আছে কিনা, কাউকে ভাল লাগে কিনা, প্রেমে পড়েছিস কিনা, হাবলা কাবলা কত্তকিছু...। অথচ কত অবলীলায় ‘অসম্ভব’ বলে গেল সে! নিশি পারল এভাবে বলতে? পারল সে?
নাহ। কিছুই ভাবতে পারছি না। আজও না বললেই হতো। আমার ব্যাপার, আমার কাছেই থাকতো। কি দরকার ছিল।
নিশির চাপাচাপিতে একদিন একপ্রকার স্বীকারোক্তিই দিয়েছিলাম। ‘হ্যা, প্রেমে পড়েছি।’
‘বলিস কী?
সাথে সাথেই চোখ কপালে তুলেছিল নিশি। একগাদা প্রশ্নতীর ছুড়ে দিয়েছিল। তারপর রুটিন করে ঘ্যানর ঘ্যানর করা।
‘তুই প্রেমে পড়েছিস? তুই? কার প্রেমে পড়েছিস? কিভাবে পেরেছিস এটা? কখন কি হয়েছে? কিভাবে হয়েছে? কবে থেকে? বল, আমাকে বল? বল, কার প্রেমে পড়েছিস?’
অনেকবার তাকে থামিয়েছি। ‘চুপ কর। বাদ দে।’ আরও কতকিছু।
নিশি বারবার সময়ে অসময়ে বায়না ধরে। যুক্তিতে তুলোধোনা করে ফেলে আমাকে। ‘এটা তো হয় না, রোদ। তুই প্রেমে হাবুডুবু খাবি আর আমি জানব না। না না এটা তো হবে না। এটাতো হতে দেওয়া যায় না। তাই না? বল কার প্রেমে পড়েছিস?’
কখনো আবার নিচু কন্ঠে আবেগে জর্জরিত নিরুত্তাপ প্রশ্নবান ছুড়ে।
‘একবার ভেবেছিস, তুই কত স্বার্থপরের মত একটা কাজ করলি, নিজে নিজে প্রেমে পড়ে গেলি। প্রেমে পড়েছিস ভালো। বলছিস না কেন, কার প্রেমে পড়েছিস আমাকে বল? হ্যা, আমাকে বল।’
এত অনুনয় বিনয়ের পরও কি আমি না বলে থাকতে পারি? অবশেষে ঘটা করেই নিশিকে বললাম।
কিন্তু নিশি কি বলল? সম্ভব না। কোনভাবেই সম্ভব না। নিশি যে এটা বলতে পারবে একবারও কি ভেবেছিলাম? ভাবি নি। একটি বারের জন্যও ভাবি নি।
রাতে নিশির ফোন। রিসিভ করলাম না। আবার ফোন। আবার। ফোনটা ধরেই বললাম- ‘কিছু মনে করিস না। এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রাখি।’
‘রাগ করিস ক্যান, রোদ? দ্যাখ, তোর বুঝা উচিত।’
তারপর দুজনেই চুপ। নীরবতা ভাঙ্গে নিশি।
‘ব্যাপারটা তোর একটু ভাবা উচিত। তোকে বুঝতে হবে। কোনটা সম্ভব অসম্ভব তোর বুঝতে হবে।’
কলটা কেটে দিয়েই ফোন অফ করে দিলাম। জীবনের সবচে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম। ওর সাথে আর কথা বলব না। আমার ভালোবাসা আমার কাছেই থাক।
সকালে দেখি অনেকগুলো এসএমএস। অনেক কিছু লেখা। সবকথার সারকথা একটাই। সম্ভব না।
পরদিন ক্লাসটেস্ট ছিল।
কোনমতে পরীক্ষাটা শেষ করেই ক্যাম্পাস ছাড়ছি। কিন্তু না, শেষ রক্ষা হয় নি। চত্ত্বরের সামনে গতিরোধ করল নিশি।
‘এভাবে মাথা নিচু করে হনহন করে কই যাচ্ছিস? রিকশা চাপা পড়বি তো।’
কিছু বললাম না। চুপ করে চলে যাচ্ছি। নিশি একপ্রকার টেনে ওদিকটায় নিয়ে গেল। আমাকে পাশে বসিয়ে ব্যাগ থেকে আচার বের করে দিব্যি খেয়ে যাচ্ছে নিশি। একটু বসে নি:শব্দে উঠে চলে আসলাম।
আজ দেড় মাস হতে চলল। প্রতিদিনই দেখা হয়। সে কথা বলতে চায়। আমি চাই না। নিশি এখনও প্রায়ই বলে ‘তুই যা বলেছিস, তা তো সম্ভব না। অসম্ভব।’
আমি সেদিনের পর তাকে আর কিছু বলি নি। তবুও সে প্রতিনিয়ত খুব আগ্রহের সাথে ‘অসম্ভব’ বলেই যাচ্ছে।
বলুক, মন্দ কী!
[email protected]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




