বাবা-মা বেরিয়েছে সেই সকালে। এখনও ফেরার নাম গন্ধ নেই। সন্ধ্যাও প্রায় হয়-হয়। আশেপাশে কোনো শিকার না পাওয়ায় ছানা-খঞ্জনা দুটির পেট করছে চোঁ-চোঁ। শেষ পর্যন্ত খিদের জ্বালায় কাঁদতে-কাঁদতে তারা ঘুমিয়ে পড়ে।
অন্য দিকে বাবা-মাও অস্থির হয়ে ছুটে আসছে অন্ধকার ভেদ করে। দুজনের মুখেই খাবার। ছানাপোনাদের খাওয়াতে হবে। অন্ধকার ঠেলতে-ঠেলতে শেষ পর্যন্ত তারা ফিরে এলো সরু লতা আর ঘাস দিয়ে বানানো কাপের মতো বাসার কাছে। প্রথমে মা-খঞ্জনা ঢুকে পড়ে বাসায়। ছানা-খঞ্জনারা জেগে উঠেছে মায়ের সাড়া পেয়ে। চিঁউ-চিঁউ করছে ছানারা। বাবার আর তর সয় না। সেও ঢুকে পড়ে বাসায়। বাবা-মা দুই ছানার ঠোঁটে খাবার গুঁজে দেয়। ছানা দুটি আবারও চিঁউ-চিঁউ করে ধন্যবাদ জানায় তাদের বাবা-মাকে।
তারপর তারা চারজন কী যেন শলা-পরামর্শ করে কিছুণ। বাবা তার মেয়ে-ছানার এবং মা তার ছেলে-ছানার গাল ঘষে দিয়ে বলে, “চলো, আমরা বাইরে যাই।”
যেই বলা সেই কাজ। খঞ্জনারা চারজনই বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। দ্রুত তারা চারজনই পাখা মেলে দেয় আকাশের দিকে। বাবা-মার জোগানো সাহসে যেন ছানা-খঞ্জনারা পূর্ণ শক্তি পেয়েছে। পূর্ণ যৌবন পেয়েছে। তারপর তারা দেিণর দিকে ছুটে যায় অবিরাম।
বাবা-মা তাদের ছানাদের জানিয়েছে, “শীত আসছে। যে শীত এখন লাগছে গায়ে, তার চেয়েও ভয়াবহ শীত পড়বে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে। আনন্দে লেজ নাচাতে-নাচাতে ছুটে গিয়ে পোকা ধরি যে নদীর তীরে, সেখানে বরফ জমবে। খেলতে-খেলতে কেঁচো খুঁজে বেড়াই যে মাঠে, সেখানে বরফ পড়ে শাদা হয়ে যাবে। ছোট-ছোট পোকা আর কেঁচো মরে সাফ হয়ে যাবে। এখনই কমতে শুরু করেছে খাবার, আগামী কিছুদিন পর তার ছিটেফোঁটাও পাওয়া যাবে না। তাই আমরা ছুটছি অন্য একটি দেশে।”
মাকে জিজ্ঞেস করে ছেলে-খঞ্জনা, “সেই দেশ কেমন, মা?”
“আমরা এমন একটি দেশে যাব, যেই দেশে আমাদের দেশের মতো শীতের তীব্রতা নেই। অনেক খাবার পাওয়া যায়।” মা জানায় ছেলেকে।
বাবাকে জিজ্ঞেস করে মেয়ে-খঞ্জনা, “সেই দেশ কি দেিণ, বাবা?”
“হ্যাঁ, দেিণ। ওই দেশে গরমও কম, শীতও কম। বরফ পড়ে না আমাদের দেশের মতো। অনেক নদী আছে সেই দেশে। বনে-বনে ভরা সেই দেশ। গাছে-গাছে সবুজ সেই দেশ। গেলেই বুঝতে পারবে কত মজার দেশ সেটি।” বিশদ বর্ণনা করে বাবা।
নদীতে-নদীতে আঁকাবাঁকা হয়ে জড়ানো স্বপ্নের দেশের কথা কল্পনা করে ছেলে-খঞ্জনা। হাজারও গাছ, লতাপাতার সবুজে ডুবে থাকা দেশটির কথা কল্পনা করে মেয়ে-খঞ্জনা। বাবা-মা ভাবে, গত বছরও তারা এসেছিল। নদীর পাড়ে-পাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে অবলীলায়। বনে-বনে ঘুরে বেড়িয়েছে মনের আনন্দে। এতদিনে নিশ্চয়ই দেশটি আরও সবুজ হয়েছে, সুন্দর হয়েছে। হাওড়-বাওড়ে, নদীর পাড়ে আরও বেশি খাবার পাবে। নিজেদের কথা বাদ দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটির কথা ভাবতে থাকে বেশি করে। ওরা নিশ্চয়ই অনেক-অনেক খাবার খেয়ে আরও মোটা-তাজা হবে। মনের আনন্দে বনে-বনে ঘুরে-ঘুরে খেলাধুলা করতে-করতে আরও চটপটে হবে।
উড়তে থাকে ওরা চারজন। কেবল উড়তে থাকে। হঠাৎ ফেলে আসা দেশটির দিকে ফিরে তাকায় ছেলে-খঞ্জনা। দেখাদেখি পেছনে তাকায় মেয়ে-খঞ্জনা।
কী অদ্ভুত! তাদের পেছন-পেছন ছুটে আসছে হাজার-হাজার পাখি। এ যে সব পরিচিত পাখি! অধিকাংশই হাঁস। গিরিয়া, ভুতি, সুলঞ্চ, চখাচখি, পানডুবি, বালিহাঁস, রাজহাঁস, সরাল, দীঘর, খুনতে, নীলশির, রাঙামুড়ি, নাকটাসহ কত রকমের হাঁস। তাছাড়াও আছে গাঙচিল, আবাবিল, কাজল, নানা রকম থ্রাস, পিপিট, এমনকি ছোট্ট ফুটকিও।
ছেলে জিজ্ঞেস করে মাকে, “ওরা কোথায় যায়, মা?”
উড়তে-উড়তে মা বলে, “খাবারের আকাল পড়েছে দেশে। ওরাও যাচ্ছে জীবন বাঁচাতে। খাবারের খোঁজে।”
মেয়ে জিজ্ঞেস করে বাবাকে, “ওরাও কি আমাদের সাথে যাবে?”
“ওরা যে সবাই আমাদের সাথে যাবে এমন কথা নেই। যার যে দেশে ইচ্ছে যাবে। কেউ যাবে আর্জেন্টিনায় বা আমাজান অববাহিকায়, কেউ যাবে দণি আফ্রিকায়, কেউ যাবে ভারতে। অবশ্য আমরা যাব বাংলাদেশে। যারা আমাদের পেছন-পেছন উড়তে শুরু করেছে, তারা অনেকেই আমাদের মতো বাংলাদেশে যাবে। তবে তোমাদের একটি কথা না জানালেই নয়, শীত নামার সাথে-সাথে সবাই প্রস্তুতি নেয় একসাথে বিদেশে যাওয়ার। কিন্তু কেউ রওনা দেবে না, যতণ না আমরা রওনা দিয়েছি। এই জন্যই অন্যান্য পাখি আমাদের বলে পথ-প্রদর্শক।” বাবা ব্যাখ্যা করে।
“আমাদের জাত ভাইয়েরা কি সবাই বাংলাদেশে যাবে?” জিজ্ঞেস করে ছেলে-খঞ্জনা তার মাকে।
“না, সবাই বাংলাদেশে যাবে না। এক-এক দল এক-এক দেশে যাবে।”
“তুমি না বলেছ বাবা, বাংলাদেশে অনেক খাবার। বাংলাদেশ অনেক সবুজ। সবাই যদি একসাথে থাকতাম খুব মজা হতো, তাই না?” মেয়ে-খঞ্জনা বলে বাবাকে।
মেয়ের কথা শুনে বাবা গম্ভীর হয় একটু যেন। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখে একবার। যাওয়ার নিশানা ঠিক আছে কিনা দেখে নেয়। বাবা-খঞ্জনার ইশারায় বাকি তিনজন তাদের দিক পরিবর্তন করে সামান্য। বামের দিকে রওনা দেয় তারা। আকাশের তারকারাজি দেখে তারা দেশভ্রমণ করে কিনা তাই। কেবল উড়তে থাকে তারা। পেছন-পেছন হাজার-হাজার পাখি।
মা-খঞ্জনা শেখায় ছেলেকে, বাবা-খঞ্জনা বাতলায় মেয়েকে-কী করে দেশ ভ্রমণ করতে হয়, কী করে পথের মাপ নিতে হয়, কোন্ তারকা কোথায় আছে ইত্যাদি।
প্রায় দুই মাস উড়তে-উড়তে খঞ্জনা চারটি সাইবেরিয়া থেকে অতিথি হয়ে আসে বাংলাদেশে।
এ দেশে এসেই বাবা-খঞ্জনা থ।
বাংলাদেশে এসে মা-খঞ্জনা বিমূঢ়।
কারও মুখে কোনো কথা সরে না। যে আনন্দ-ফুর্তি ছিল আসার সময় ওদের চারজনের মধ্যে, তার ছিটেফোঁটাও নেই এখন। এক বছরের মধ্যে কত পরিবর্তন হয়ে গেছে বাংলাদেশের। নদনদী যেখানে-যেখানে ছিল, সবই ঠিক আছে। কিন্তু হাওড়-বাঁওড়গুলো সব দখল করে নিয়েছে মানুষেরা। ভরাট করে ঘরবাড়ি তৈরি করে নিয়েছে অধিকাংশই।
যেই সবুজ বাড়ার কথা ছিল দেশে, তাও বাড়বে দূরে থাক, য়েই গেছে যেন সব।
উড়তে-উড়তে তারা একটি নদীর পাড়ে এসে বসে। নদীর দুই পাশে ঘন বন।
বনের ভেতরের দিকে একটু নজর রাখার চেষ্টা করে বাবা-খঞ্জনা। কয়েক জন মানুষ গাছ কাটছে। কয়েক জন মানুষ গাছের গুঁড়িকে ঠেলতে-ঠেলতে নদীর দিকে নিয়ে আসছে। কয়েক জন মানুষ মোটা-মোটা কয়েকটি গাছে খোঁচা দিয়ে কিসের যেন দাগ কাটছে।
নদীর পাড় বরাবর দূরের দিকে তাকিয়ে দেখে মা-খঞ্জনা, কয়েক জন মানুষ এগিয়ে আসছে এদিকে। একজনের হাতে বন্দুক। তার মাথায় সাহেবি ক্যাপ। একজনের হাতে কয়েকটি মরা পাখি, সম্ভবত সাহেব শিকার করেছে এ সব পাখিদের।
খিদে পেয়ে যায় মেয়ে-খঞ্জনার।
খিদে পায় ছেলে-খঞ্জনার।
“কী সুন্দর দেশ ছিল একদিন এই বাংলাদেশ!” বাবা-খঞ্জনা ভাবে।
“কী অনাবিল শান্তি ছিল একদিন এই দেশে!” মা-খঞ্জনা আপসোস করে।
দ্রিম-দ্রিম করে হঠাৎ কিসের যেন শব্দ পাওয়া গেল। চার খঞ্জনা উড়াল দিয়ে ঢেউতোলা নদীর অন্যপাড়ে চলে গেল। দূর থেকে দেখল, যে লালমাথা রাঙামুড়ি হাঁস তাদের পেছন-পেছন ছুটে এসেছে, তার একটি গুলি খেয়ে ছটফট করছে। অন্য সব হাঁস, যারা সঙ্গী ছিল এই রাঙামুড়ির, তারা কাঁদতে-কাঁদতে চলে গেল দূরে। অনেক...অনেক দূরে
বাবা-খঞ্জনা মেয়েকে বলে, “চলো মা, আমরাও চলে যাই অন্য কোনো দেশে।”
মা-খঞ্জনা ছেলেকে বলে, “এ দেশে থাকার জায়গা নেই আর। থাকলে বাঁচা যাবে না।”
হাজার-হাজার খঞ্জনা চার খঞ্জনার সাথে চলে যেতে শুরু করেছে। মনে হয় একটি পাখিও পাওয়া যাবে না আগামীকাল। নদীর পাড়ের কলকাকলি থেমে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ১১:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




