দু-এক দিনের মধ্যেই নজরুলের সাথে জুটুর ভাবসাব হয়ে গেছে। একজনকে ছেড়ে আর একজন থাকতে পারে না। এই তো কয়েক দিন হলো মাত্র, নজরুল এসেছে কলকাতা থেকে। নজরুলের সাথে জুটুর এমন গলায়-গলায় ভাব হয়ে গেল যে, সময় পেলেই নজরুল জুটুকে নিয়ে মেলায় যায়, দিঘির পাড়ে যায়, আবার হাঁটে গিয়ে লজেন্স কিনে দেয়, পুতুল দিনে দেয়, খেলনাপাতি কিনে দেয়, জুটুকে নিয়ে কবিতা লেখে, আরও কত কি?
নজরুল কবিতা-টবিতা লেখে। ইদানীং তার সুনামও হয়েছে প্রচুর। বাংলা-ভারত উপমহাদেশের সেরা দৈনিক ‘নবযুগ’-এ প্রকাশিত তার বেশ কয়েকটা কবিতা সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে। তার এসব কবিতা পড়ে ব্রিটিশ সরকারেরও টনক নড়ে উঠেছে। ব্রিটিশ সরকার উঠে-পড়ে লেগেছে যেমন করে হোক, নজরুলকে গ্রেফতার করতে হবে। নজরুলও গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়ানোর জন্য এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
কুমিল্লার ইন্দ্রমোহন সেন খুব নামিদামি লোক। একজন বড় জমিদার। জমিজমা অনেক আছে। জমিদারি গরিমার চেয়ে তার দেশাত্মবোধই বেশি। এর মধ্যে দৈনিক নবযুগে নজরুলের কবিতা পড়ে তিনি নজরুলের একজন ভক্ত হয়ে যান। তা ছাড়াও অনেকের কাছে নজরুলের কথা শুনে তিনি তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। এবার যায় কোথায়। সেই সেন বাবুর বাড়িতেই একদিন নজরুল ঠিকই এসে পড়ল।
দুপুর বেলা। একটু-একটু গরম পড়ছে। ঘরের ভেতর শুয়ে থাকতে-থাকতে যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। নজরুল ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বারান্দায়। হাতে একটি খাতা ও পেন্সিল। বারান্দায় একটি পুরানো দিনের সোফা। দেখলেই বোঝা যায় সোফাটা সেন বাবুর দাদার বা তার পূর্বপুরুষ কারও সময়ের হবে। বাড়ির দণি দিকের বাগান থেকে শুরু করে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। আশেপাশে কেউ নেই। একটা ফুরফুরে বাতাসের ঝাপটা তার মুখে আলতো পরশ দিয়ে চলে গেল। নজরুল সোফাটাকে টেনে নিয়ে বসে পড়ল। কোলের উপর খাতাটাকে ফেলে দুহাত দিয়ে চেপে রাখল। তারপর চোখ বুজে গুন-গুন করে কী যেন একটা গান গাইতে লাগল। হঠাৎ কোত্থেকে জুটু এসে হাজির এখানে। জুটু তার দিদির কাছে শুনেছে, ঘরে যে একজন অতিথি এসেছে সে নাকি ‘কবি’। অনেক দিন ধরে জুটুরও একটা কবি দেখার শখ ছিল। দুপুর বেলায় যখন পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে তখন জুটু তার মাকে ফাঁকি দিয়ে সোজা চলে এসেছে কবির কাছে।
“শুনছ?”
গলার আওয়াজ শুনে নজরুল বুঝতে পেরেছে একটা ছোট্ট খুকি তার ঘরে এসেছে। কিন্তু নজরুল চোখ না খুলে আগের মতোই বসে রইল। যেন সে কিছুই শুনেনি। জুটু আবারও ডাক দিল, শুনছ?
নজরুল আগের মতোই চোখ বন্ধ করে রাখল। জুটুর ডাকটা অন্য রকম হওয়ায় সে বুঝতে পারল আর একটু হলেই কেঁদে দেবে খুকিটা। তাই নজরুল বলল, “কে তুমি?”
“আমি জুটু। চোখ খুলবে?”
“আগে বলো, তুমি কি করো?”
“কেন, পুতুল খেলি।”
“তুমি পড়ো না?”
“হ্যাঁ, কত বই পড়ি।”
“তুমি ছড়া পড়ো?”
“হ্যাঁ, পড়ি। তুমি চোখ খুলবে না? আমি কিন্তু এখন চলে যাব।”
“আগে একটা ছড়া পড়ো তো?”
জুটু একটি ছড়া মনে করার চেষ্টা করল কতণ। তারপর বলল, “পড়ব?”
“পড়ো।”
জুটু পড়তে শুরু করে-
ভোর হলো দোর খোলো
খুকুমণি ওঠোরে,
ওই ডাকে জুঁই শাখে
ফুল খুকি ছোটোরে।
খুলি হাল তুলি পাল
ওই তরী চলল,
এইবার এইবার
খুকু চোখ খুলল।
আলসে নয় সে
ওঠে রোজ সকালে,
রোজ তাই চাঁদা ভাই
টিপ দেয় কপালে।
চট করে চোখ খুলে ফেলে নজরুল। এটা তো তার নিজের লেখা। এ ছড়া জুটু কোথায় পেয়েছে? কোত্থেকে শিখেছে?
ছড়া পড়া শেষ করে জুটু তাকাল নজরুলের দিকে। নজরুলের চোখ খোলা দেখে জুটুর ছড়া পড়া বন্ধ হয়ে যায়। নজরুল ল করল তাকে দেখে জুটু থমকে গেছে। জুটুর চোখগুলো বড়-বড় হয়ে গেছে।
শাদার উপর লাল বুটি-বুটি প্রিন্টের একটা ফ্রক জুটুর গায়ে। সুন্দর পুতুলের মতো জুটু সত্যিই যেন প্রাণহীন পুতুল হয়ে গেল। তাকে দেখে জুটু নির্বাক হয়ে যাবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। জুটুর এ অবস্থা দেখে নজরুল একটু হাসল। তারপর বলল, “কী দেখছ জুটু?”
“তোমার চোখগুলো খুব সুন্দর।”
“সত্যি!”
“কবিদের চোখ এমন সুন্দর হয় নাকি?”
“তা হবে কেন? তোমার চোখও তো খুব সুন্দর।”
“ধ্যাৎ, কে বলল আমার চোখ সুন্দর।”
“কেন, আমি বললাম? আচ্ছা জুটু, ‘ভোর হলো দোর খোলো’ ছড়াটা তুমি কোত্থেকে শিখলে?”
“ওটা আমার দিদি শিখিয়েছে।”
“তোমার দিদি তোমাকে ছড়া শেখায়?”
“হ্যাঁ, কত্ত ছড়া শেখায়।”
“তোমার দিদির নাম কী?”
“আমার দিদির নাম প্রমীলা দেবী।”
“তোমার দিদির নাম না খুব সুন্দর। তবে তোমার নামটাও খুব সুন্দর। আচ্ছা জুটু ‘ভোর হলো দোর খোলো’ কবিতাটি কে লিখেছে, জানো?”
“বাহ্, তাও জানো না? কাজী নজরুল ইসলাম।”
“ওকে তুমি চেনো?”
“নাহ্। তবে ও কেমন তা আমি বলতে পারব।”
“কেমন?”
“নিশ্চয় ও খুব সুন্দর! ইয়া বড় সে। হাতির চেয়েও মোটা।”
“চোখগুলো কেমন?”
“চোখগুলো তারার মতো। না-না, চাঁদের মতো।”
“চুলগুলো?”
“চুলগুলো ইয়া লম্বা-লম্বা। তোমার চুলের চেয়ে লম্বা।”
খুব ভোরে উঠে জুটু গেল বাগানে। এভাবে সে প্রতিদিন আসে। বাগানে ঘুরে বেড়াতে তার খুব ভালো লাগে। প্রতিদিন প্রমীলা দিদি সাথে আসলেও আজ জুটু একা।
সে বাগানের এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল। হঠাৎ কিসের একটা খটাখট আওয়াজ শুনে উপরের দিকে তাকাল জুটু। দেখল, একটা কাঠবেড়ালি পেয়ারা গাছের ডালে বসে একটা পাকা পেয়ারা চিবুচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে নজরুল এলো বাগানে। বাগানে এসে দেখল, এখানে তার আগেই জুটু এসে গেছে। নজরুলের ইচ্ছে ছিল পিছন থেকে গিয়ে জুটুর চোখ ধরে লুকোচুরি খেলবে। কিন্তু নজরুল মুহূর্তেই জুটুর ভাবভঙ্গি আবিষ্কার করে ফেলল। দেখল, জুটু পেয়ারা গাছের ডালে বসা কাঠবেড়ালির সাথে কী সব কথা বলছে। নজরুল আর এগিয়ে গেল না সামনের দিকে। সে ফিরে এলো ঘরে। এসে কাগজ ও পেন্সিল নিল। নিয়ে আস্তে-আস্তে বাগানের দিকে গেল। জুটুর কাছ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে নজরুল লিখে ফেলল কাঠবেড়ালির সাথে বলা জুটুর মনের কথাগুলো।
এবার একটু কাশি দিল নজরুল। হঠাৎ বাগানে কার একটা কাশি শুনে জুটু চমকে উঠল। পেছনে ফিরে দেখে, কবি এসেছে। সে দৌড়ে কবির কাছে এলো।
“কী করছিলে বাগানে?” নজরুল জিজ্ঞেস করল।
“কাঠবেড়ালি দেখছিলাম। ও আমার পাকা পেয়ারাটা চুরি করে খেয়ে ফেলেছে। আমিও একটা চাইলাম। কিন্তু সে দিল না।”
“কেন দিল না?”
“সে পচা।”
“থাক, ওর কথা বলে আর লাভ নেই। ও তো পচা!”
“তুমি ওকে মারো।”
“ওকে মারব কী করে? মারার আগে যে পালিয়ে যাবে!”
“তাহলে কী হবে?”
“কিচ্ছু হবে না। তুমি একটা কবিতা শোনো। আমি একটা কবিতা লিখেছি।”
“বেশ করেছ।”
“আহ্হা, একবার কবিতার নাম তো জিজ্ঞেস করবে?”
“কী?”
“কবিতার নাম দিয়েছি ‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’।”
“ধ্যাৎ, এটা আবার কবিতা হলো।”
“কেন হবে না?”
“কাঠবেড়ালি নিয়ে বুঝি আবার কবিতা হয়?”
“হ্যাঁ, হয়। দেখবে?”
“দেখি, পড়ো তো?”
একটু কেশেকুশে নজরুল পড়া শুরু করে-
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবিনেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?-
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুকু,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবিনেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস-পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
কাঠবেড়ালি! বাঁদরিমুখি! মারবো ছুড়ে কিল?
দেখবি তবে? রাঙাদাকে ডাকবো? দেবে ঢিল!
পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা!
তাই তে তো তোর নাকটি বোঁচা!
হুতমোচোখি! গাপুস গুপুস
একলাই খাও হাপুস হুপুস!
পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!
হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
ইস! খেয়ো না মস্তপানা ওই সে পাকাটাও!
আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!
কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছ্ডোুদি হবে? বৌদি হবে? হুঁ!
রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঃ!
এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো?
ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?
আর খেয়ো না পেয়ারা তবে,
বাতাবিনেবুও ছাড়তে হবে!
দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ যে ছুট? অ’মা দেখে যাও!-
কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!
পুরো কবিতাটা শুনে জুটু হতভম্ব হয়ে গেল। এ যেন কবি তার মনের কথাগুলোই বলে ফেলল। জুটু আর দেরি করল না। চট করে নজরুলের হাত থেকে খাতাটা কেড়ে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল বাড়ির দিকে। একেবারে অন্দরে। জুটুর চোখে-মুখে আনন্দ আর দুষ্টুমি দেখে নজরুলও খুব খুশি হলো।
এ কয়দিনে জুটু কবির আসল পরিচয়টা পায়নি। কবিতাটা নিয়ে যখন অন্দরে প্রমীলা দিদির কাছে গেল, তখনই দিদি জুটুকে জানাল, যে কবি অতিথি এ বাড়িতে এসেছে সেই কবি অতিথিই কাজী নজরুল ইসলাম।
আবার ছুটে এলো জুটু। নজরুলকে আর এক নজর ভালো করে দেখে নিল। তারপর এক সময় দুজনেই হেসে দিল একসাথে। হেসে হেসে একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরল।
নজরুল জুটুকে কোলে তুলে নিয়ে আদরে-আদরে ভরে দিতে লাগল। জুটু বলল, “ভোর হলো দোর খোলো যে লিখেছে সে ইয়া বড়ো নয়। ইয়া মোটা নয়। তার চোখগুলো তোমার চোখের মতো, খুব সুন্দর কোঁকড়ানো চুল। আর, দেখতে ঠিক তোমার মতো। ... আর ... আর...”
“আর কি?”
“আর সে আমাকে চেনে। আমাকে খুব আদর করে।”
“আর?”
“আমাকে নিয়ে সুন্দর একটা কবিতা লিখেছে।”
“আর?”
“নাম দিয়েছে, ‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’।”
“আর?”
“আর ... আর হচ্ছে... আর কিচ্ছু না।”
বলেই জুটু নজরুলের চুলগুলো টানতে-টানতে, হাসতে-হাসতে অন্য এক পৃথিবীতে হাজির হলো, সেখানে রয়েছে নজরুল ও জুটুমণিদের অনেক-অনেক ভালোবাসা, অনেক-অনেক আদর।
আলোচিত ব্লগ
হাদিকে গুলি করলো কে?
হাদিকে গুলি করলো কে?

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন
মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইতিহাসের সেরা ম্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমি আর এমন কে

যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।